• ঢাকা
  • বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১, ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষার উদ্দেশ্য : বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে


মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২২, ০২:৫৪ পিএম
শিক্ষার উদ্দেশ্য : বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে

শিক্ষার উদ্দেশ্য কী?

এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে মানুষকে শিক্ষা কী দেয়, সেই বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। ‘মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার’ প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘শিক্ষার কাজ হচ্ছে বুদ্ধির উৎকর্ষ বৃদ্ধি, পরিমাণ বৃদ্ধি নয়।’ কিন্তু বর্তমানে এই কথাকে উপেক্ষা করে শিক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর দিকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো উদ্যোগ নেই। তাই শিক্ষা হয়ে উঠেছে সনদসর্বস্ব-চাকরিলোভী। এরসঙ্গে সুকুমারবৃত্তির কোনো সংযোগই ঘটছে না।  

শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ‘মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার’ প্রবন্ধে মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘অসংস্কৃত ও অসুন্দর বুদ্ধিতে সংস্কৃত ও সুন্দর তোলা শিক্ষার একটি বড় উদ্দেশ্য; না ভুল বলেছি, শিক্ষার মানেই তাই।’ এই মনীষীর সঙ্গে সহমত পোষণ না করার কোনো কারণ দেখছি না। তবে, বর্তমানকালে বুদ্ধির সংস্কারেই শিক্ষার লক্ষ্য শেষ হয়ে যায় না। শিক্ষার অন্তত তিনটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত। এগুলো হলো,  এক. অজ্ঞানতা, দুই. অন্ধকার ও  তিন. গোয়ার্তুমি দূর করা।

মানুষ জন্ম থেকেই সম্ভবত এই অজ্ঞানতা, অন্ধকার ও গোঁয়ার্তুমির সঙ্গে নিয়ে আসে। এই ৩ জিনিস সে সহজে ত্যাগ করতে চায় না। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই চিরকাল বহন করতে চায়। তাই বাইরে থেকে যখন তাকে শিক্ষা লাভ করার প্রেরণা দেওয়া হয়, তখন সে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। তার ভেতরের পাশবিকতা তাকে শিক্ষাবিরোধী করে তোলে। ভেতরের জন্তুটি তাকে শিক্ষা লাভের পথে বাধা দেয়। তাকে ভয় দেখায় এই বলে যে, তুমি দৈববাণীকে শিরোধার্য মানো। দৈববাণী মানলে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত। ভেতরের জন্তুর হুঁশিয়ারি হলো, মানুষের জীবন নিয়তির অধীন। তাই মানুষের জীবনে যা কিছু ঘটে, তার জন্য সে দায়ী নয়। কারণ, তার জীবনচক্রের বিধান আগেই লিখিত হয়েছে। তার নিয়তিনির্ধারক আকাশে থাকে, সেই সর্বশক্তিমানই মানুষের জীবনচক্র নির্ধারণ ও নির্বাচন করে দিয়েছে। ফলে নিজের ভাগ্যরেখা বদলানোর চেষ্টা মানুষের জন্য পাপের সামিল। সুতরাং মানুষ হতে হলে ভাগ্যরেখা পরিবর্তনের স্বপ্ন না দেখে নিয়তির ওপর নিজেকে সপে দিয়ে পরকালের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। জ্ঞানবিমুখ, অন্ধকারপ্রিয় গোঁড়া মানুষেরাও সেই নিয়তিনির্ধারিত বিধানকে বেদজ্ঞানে মেনে চলতো। এর বাইরে পা ফেলার কল্পনাও তারা করতো না।

এখনো কি নিয়তির বিধান লঙ্ঘন করে মুক্তচিন্তার কথা মানুষ ভাবতে পারে? নিয়তি কিংবা ভাগ্যলিপি মানুষকে বলে জ্ঞানের অন্বেষণ করো না, প্রশ্ন করো না। প্রশ্ন করা আর আত্মবিধ্বংসী কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া একই কথা। নিয়তির সেই ‘অমোঘবার্তা’কে মান্য করে মানুষ প্রশ্ন করার ইচ্ছাকে নিজের ভেতর কবর দিয়ে রাখে। তারা অবদমনকে সংযম হিসেবে মেনে নেয়। এর মাধ্য অজ্ঞানতাকে মেনে নিয়ে নিজেকে বিধাতার অনুগত-বিশ্বাসী সৃষ্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পরকালে স্বর্গলাভের এক দুর্মর বাসনা হৃদয়ে লালন করে মানুষ। তাই মানুষ প্রশ্নহীনতায়-অজ্ঞানতায় সুখ খোঁজে, শান্তি চায়। অজ্ঞানতাকে তারা জীবনদর্শন মানে, জ্ঞানার্জনে দেখে পাপ। এ কারণে তারা পাপ থেকে মুক্ত থাকতে, পুণ্যের আশায় জ্ঞানার্জনে অনীহ থাকে। এতে তাদের দুই ধরনের লাভ হয়। একটি পার্থিব, অন্যটি অপার্থিব। পার্থিব এই অর্থে যে, তারা সমাজে একই মনোভাবাপন্ন মানুষকে সম্মোহিত করে তাদের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সম-মানসিকতার সাধারণ মানুষ জ্ঞানার্জনবিমুখ সমাজপতিদের কথায় বিমোহিত হয়ে পড়ে এবং নিজেদের অর্থবিত্ত ও জমিজিরাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অপার্থিব এই অর্থে যে, প্রশ্নহীন তথা-দৈববাণী মেনে চলার মধ্যে পরকালের জন্য সঞ্চয় বাড়ে। সেই পুণ্যার্জনের ফলে পরকালে তাদের ভোগের জন্য অসংখ্য হুর, অপ্সরীসহ সুরম্য অট্টালিকা বরাদ্দ হবে। এসবই পাবে তারা নিয়তিকে প্রশ্নহীন মেনে নেওয়ার বিনিময়ে। তাদের কাছে ‘অজ্ঞানতাই সুখ, অজ্ঞানতাই পুণ্য’।

সাধারণত শিক্ষা মানুষকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, আলো-অন্ধকার, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্ম, গোঁড়ামি-প্রগতিশীলতার জ্ঞান দেয়।  এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে একজন মানুষ সমাজে টিকে থাকার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকা, সুস্থ থাকা, নির্বিঘ্ন থাকার উপায়গুলো শিক্ষার মাধ্যমে সে শেখে। কিন্তু  এসবই নিতান্তই প্রাথমিক স্তরের ও মৌলিক জ্ঞান। এসব জ্ঞান যে কেউ অর্জন করতে পারে। আর প্রথাগত শিক্ষা সেই জ্ঞানই দেয়। কিন্তু আজকের যুগে  শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, মানুষের এই ‘গোঁড়ামিসর্বস্ব ধারণা’কে বদলে দেওয়া। শিক্ষার বলা উচিত, অজ্ঞানতায় সুখ নেই। যা আছে, তা নিজেকে বঞ্চিত করে রাখার অপকৌশল। অতীতের 
ধর্ম-দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মনীষীর চিন্তা, কল্পনা ও কাজের বিবরণ তুলে ধরে উপস্থিতকালের মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তাহলে অন্তত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষিতজন, জ্ঞান ও মূর্খতার প্রভেদ বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে জ্ঞানের উপকারিতা, মূর্খতার ভয়াবহ দিক। অনেকে ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও বেশিরভাগ ‘শিক্ষিতজন’ই অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না। তারা জ্ঞানকে ধর্মদ্রোহ-রাষ্ট্রদ্রোহ বলে মনে করে। তারা বস্তুগত বিষয় ও ভাবগত বিষয়কে একই রকম দেখে। তাই তারা ধর্মের ভেতর বিজ্ঞান খোঁজে, বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করে ধর্মের সত্য দিয়ে। শিক্ষা ব্যক্তির এই ভ্রান্তি দূর করে তাকে প্রকৃত সত্য ও ভাববাদকে ভাববাদ দিয়ে, বস্তুবাদকে বস্তুবাদ দিয়ে ব্যাখ্যার কথা বলতে পারে। এর মাধ্যমে ব্যক্তির অজ্ঞানতা দূর হবে, সে হয়ে উঠবে চক্ষুষ্মান।

শিক্ষার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, অন্ধকার দূর করা। মানুষ মাত্রই সমাজবদ্ধ জীব। এর ওপর আছে রাষ্ট্রীয় সীমারেখা। সমাজ-রাষ্ট্রের বিধিবিধান অনুযায়ী চলতে গিয়ে ব্যক্তিকে কিছু প্রথা মেনে চলতে হয়।  এই সব প্রথা মানতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি থাকে অন্ধকারে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে ব্যক্তির মনের সেই অন্ধকারকে দূর করা। অবশ্যই শিক্ষা সেই কাজটিই করে। কিন্তু কথা হলো, ‘অন্ধকার’ কী? শিক্ষা কী ধরনের অন্ধকার তাড়িয়ে ব্যক্তিমনে আলো জ্বালাবে? এই প্রশ্নের জবাবে সহজে বলা যায়, ব্যক্তিমনে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞানবিষয়ে যে ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, সেই সব দূর করা। এরপর মানুষের মনে প্রগতির বোধ, বিজ্ঞানের বীজ বপন করে দেওয়া।

অজ্ঞানতা ও অন্ধকার দূর করলেই মানুষ সভ্য হয়ে যায় না। অজ্ঞানতা-অন্ধকার দূর হলে মানুষ বিদ্যার্জনের দ্বিতীয় স্তরে আরোহণ করে মাত্র। এটুকু অর্জন করলে ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিদ্যালাভ হয় না। পরিপূর্ণ বিদ্যার্জনের  জন্য ব্যক্তিকে গোঁয়ার্তুমিমুক্ত হতে হয়। সাধারণত মানুষ অল্পবিদ্যা অর্জনের পর এক ধরনের অহঙ্কারী হয়ে ওঠে।  অনেক কিছু শেখা হয়ে গেছে ভেবে ব্যক্তি তার চারপাশকে অবজ্ঞা করতে শুরু করে। ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ স্বভাব নিয়ে প্রাজ্ঞ-মনীষীদের সারাজীবনের অর্জন-জ্ঞানকেও চ্যালেঞ্জ করে বসে। অর্থাৎ নিজের ছটাকপরিমাণ জ্ঞান অন্যের হাজার মণ জ্ঞানকেও তাচ্চিল্য করে। অতীত ও উপস্থিতকালের সমস্ত জ্ঞানপ্রপঞ্চকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চায়।  এ কাজে সে তার সামান্য বিদ্যাকে পুঁজি করে যুক্তির পর যুক্তি দিতে থাকে, সেই যুক্তিতে না থাকে শৃঙ্খলা, না থাকে বাস্তবতার লেশ মাত্র।  এরপর আছে আরও ভয়ানক কর্ম।  ব্যক্তি এটুকু পুঁজি নিয়ে ভাবে, সে যা জানে, তাই চূড়ান্ত। তার জানার বাইরে জগতে কিছুই ঘটে না। ঘটতে পারে না। তার সেই গোয়ার্তুমিতে চারপাশের লোকজন সর্বদা তটস্থ থাকে। শিক্ষার উচিত ব্যক্তির সেই গোয়ার্তুমিকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। তাকে বোঝানো, সে যা জানে, তা নিতান্তই সামান্য, বরং তার জানার বাইরে রয়ে গেছে ৯৯ ভাগেরও বেশি। তাকে জানতে হবে। বুঝতে হবে।  জ্ঞানার্জনের পথে তাকে যাযাবরের মতো পথের পর পথ পাড়ি দিতে হবে পায়ে হেঁটে।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি এর সনদসর্বস্ব প্রবণতা। এই সনদ অর্জনের জন্য শিক্ষাপদ্ধতি ও কৌশলেও রয়েছে চরম ফাঁকি। অর্থাৎ শিক্ষার গোড়ায়ই গলদ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথমে পাঠ্যক্রমকে সংকুচিত করা হয় সিলেকশানের মাধ্যমে, এর আরও সংক্ষিপ্ত করা হয় সিলেবাস দিয়ে। সবশেষে থাকে সাজেশন নামের কিংভূতকিমাকার এক পদ্ধতির মাধ্যমে পাঠ্যবিষয়কেই এতটাই পঙ্গু করে দেওয়া হয় যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় পরিপূর্ণভাবে পড়ারই সুযোগ থাকে না আর। এই তিন ‘সিলেকশন’, ‘সিলেবাস’ ও ‘সাজেশন’ এই তিন ‘এস’-এর বৃত্ত শিক্ষাজীবনকে এতটাই ভালো ফলমুখী করে তোলে যে, ব্যক্তি জ্ঞানার্জন কিংবা আনন্দলাভকে তুচ্ছ করে তোলে। বিপরীতে ভালো ফলের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। ফল আশানুরূপ ভালো হলে একটি চাকরির চেষ্টায় আবার ব্যস্ত সময় কাটাতে শুরু করে। অর্থাৎ শিক্ষা-জীবনের প্রথম লক্ষ্য ভালো ফল, দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত লক্ষ্য ভালো চাকরি লাভ। যেন জীবনের আর কোনো চাওয়া থাকতে নেই, মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নেই। খাও-দাও, অর্থ উপার্জন করো, নিষ্প্রাণ-হৃদয়হীন বিত্তশালী হও; জীবনের সুকুমারবৃত্তিগুলোকে মেরে ফেলো, শিল্পকলাকে উপেক্ষা করো, জ্ঞানচর্চাকে করো চরম অবজ্ঞা। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় এর বাইরে আর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, হলফ করে কেউ বলতে পারবে না।

শিক্ষা মানুষকে যে জ্ঞান দেবে, তার ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রকেই। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়তিবাদ সংবলিত সব ধরনের রচনা পাঠ্যবই থেকে বাদ দিতে হবে। পরিবর্তে বিজ্ঞান, প্রগতি, শিল্পকলা, কারিগরি বিষয়াবলি পাঠ্যসূচিভুক্ত করতে হবে। আর বাদ দিতে হবে নিয়তিবাদী চিন্তাসর্বস্ব রচনাবলি। তাহলেই শিক্ষার উদ্দেশ্য অজ্ঞানতা,  অন্ধকার ও গোয়ার্তুমি দূরীকরণের পথে একধাপ এগিয়ে যাবে জাতি। অজ্ঞানতা ও অন্ধকারাচ্ছন্নতা মানুষের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে না। যেটুকু করে সেটুকু কেবল ব্যক্তি বিশেষের নিজেরই এবং তা স্বল্পমেয়াদি ক্ষতি। কিন্তু গোয়ার্তুমি ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে তার পারিপার্শ্বকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ক্ষতি করে দীর্ঘমেয়াদি। গোঁয়ার ব্যক্তিদের আত্মম্ভরিতার শিকার হন সাধারণ মানুষ। সুশিক্ষা গোয়ার্তুকি গুঁড়িয়ে দিয়ে সংহত রূপ এনে দিতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি কিংবা পিএইচডি ডিগ্রিধারী হয়ে নামের সামনে ড. যুক্ত করলেই কেউ প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে যায় না। প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে পুঁথিগত বিদ্যা ও পরীক্ষার ভালো ফলের সম্পর্ক গৌণ, মুখ্য হচ্ছে ব্যক্তিমনে সুকুমারবৃত্তির জন্ম দেওয়া।  যে শিক্ষা মানুষের মনকে কোমল করতে পারে না, তা শিক্ষা নয়, চাকরিলাভ ও ধনার্জনের উপায় মাত্র। মনুষ্যত্ববোধহীন, সুকুমারবৃত্তিশূন্য পালে পালে পিএইচডিধারী প্রসব করা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়; আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শুভবোধসম্পন্ন মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো।  শুভবোধশূন্য পিএইচডিধারীরা এতটাই গোঁয়ার হন, যে যুক্তিবোধের সঙ্গে তাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। তারা নিজের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে শ্রোতা কিংবা প্রতিপক্ষকে অকারণে হেনস্তা করতেও কুণ্ঠিত হন না। তুচ্ছ কারণে তারা মানুষের ওপর এমনভাবে রুষ্ট হয়ে পড়েন যে, তাদের ক্রোধ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তির সহজেই মুক্তি মেলে না। তাদের আক্রমণ ও মানসিক নিপীড়নের পরিমাণ এতই প্রচণ্ড আকার ধারণ করে যে, আক্রান্ত ব্যক্তিরা শেষপর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতেও বাধ্য হন। আত্মহননের পরও আক্রান্ত ব্যক্তিদের শেষরক্ষা হয় না। আত্মহনন কেন অযৌক্তিক তা নিয়ে এই আত্মম্ভরিতাপ্রবণরা বিদ্রূপ করতেও ছাড়েন না। জীবিত মানুষকে হেনস্তা করেও তাদের ক্রোধ শেষ হয় না, মৃতকে নিয়েও চলে তাদের টানাটানি। এই কারণে এই ধরনের শিক্ষিতজনকে ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ বললেও অত্যুক্তি হয় না।  কারণ এই শ্রেণীর সনদসর্বস্বদের নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়, নিরীহদের। অথচ এই অসভ্যদের মনে কোনো অনুশোচনা পর্যন্ত দেখা যায় না। এর কারণ ওই একটায়, গোয়ার্তুমি। এই গোয়ার্তুমি বিত্তশালীদের মতোই। বিত্তবানরা যেমন সম্পদের জোরে সাধারণ মানুষকে তাদের দাসের চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না, তেমনি এই সনদধারীরাও সমাজের আর দশজনকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানে না। এটা তাদের প্রকৃত শিক্ষার অভাব। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত, মানবমনের  অজ্ঞানতা, অন্ধকার ও গোয়ার্তুমিকে দূর করে, তাকে স্বচ্ছ সাদা কাগজে পরিণত করা। তাহলে ওই সাদা কাগজে সে সুকুমারবৃত্তির বীজ বপন করে মানবজাতিকে মঙ্গলের বার্তা শোনাতে পারবে। নিজের জীবনের লক্ষ্যও নতুন করে স্থির করতে পারবে।

লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক
 

Link copied!