• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৬

পঞ্চাশ বাংলাদেশের, অভিজিতের হবে না


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১, ০৫:২২ পিএম
পঞ্চাশ বাংলাদেশের, অভিজিতের হবে না

বেঁচে থাকলে আজ (১২ সেপ্টেম্বর) পঞ্চাশে পা দিতেন তিনি। চুয়াল্লিশে থেমেছে জীবনের চাকা। না, আদতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জীবনের চাকা থামেনি, বলা যায় থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারা দিয়েছে সে প্রমাণিত; ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি চাপাতির কোপ থামিয়ে দিয়েছে অভিজিৎ রায়ের জীবনকে। তাই চুয়াল্লিশেই সমাপ্তি ঘটেছে জীবনের। তার প্রাণ নাশ হলেও দেহটা রয়ে গেছে, রয়ে গেছে চিন্তাটাও। দেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে, চিন্তা অগণন মুক্তচিন্তকের চিন্তারেখায়।

অভিজিৎ রায়, মুক্তচিন্তকদের এক অনন্ত আক্ষেপের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছেন। আক্ষেপ মূলত তার দীর্ঘজীবন না পাওয়ার অপ্রাপ্তিতে। জন্ম তার একাত্তরের উত্তুঙ্গু সময়ে। বাবা মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. অজয় রায়। প্রয়াত। বিশাল হৃদয়ের অথচ ছোট্ট দেহে তিনি বয়ে নিয়ে গেছেন অভিজিতের মৃতদেহ। আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন বিচারের দাবিতে। দিয়েছেন সাক্ষ্যও। তবে শেষটা দেখে যেতে পারেননি। পুত্র হত্যার বিচারিক আদালতের রায় দেখার আগেই তিনি ছেড়েছেন পৃথিবী। তার আগে এই দেশকে স্বাধীন করে গেছেন একাত্তরে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ভারতের আসামে রেখে নিজে অংশ নিয়েছিলেন যুদ্ধে। লক্ষ্য একটাই দেশ স্বাধীন করা। তিনি স্বাধীন করতে পেরেছিলেন দেশ, কিন্তু স্ত্রীর গর্ভে যে সন্তান রেখে স্বাধীন দেশের নেশায় ছুটেছিলেন সেই সন্তানকেই তার স্বাধীন দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের চাপাতির কোপে নিহত হওয়া দেখতে হয়েছিল। অথচ এই ধর্মভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই ছিল তার আজন্ম সংগ্রাম। একাত্তরে তিনি জিতেছিলেন, বিশ পনোরোতে জিততে পারেননি।

অভিজিৎ রায় বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করেছিলেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে। পরিবার নিয়ে থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে। লেখালেখি করতেন বিজ্ঞান, দর্শন, নাস্তিকতা নিয়ে। দেশে মুক্তচিন্তার অনলাইন আন্দোলনে গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেন্দ্র মুক্তমনা ব্লগ। নিজে লেখালেখির পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবতাবাদী একটা পাঠকশ্রেণি গড়ে তুলেছিলেন, লেখকশ্রেণিও। একক ও যৌথভাবে লিখেছিলেন আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান, অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান, ভালবাসা কারে কয়, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, বিশ্বাসের ভাইরাস, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে শিরোনামের অনেকগুলো বই। তার এই লেখালেখির কারণে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন। দেশে ফিরলে হত্যা করা হবে এমন হুমকি সত্ত্বেও তিনি দেশে ফিরেছিলেন। এবং সেই হত্যাকারীদের দ্বারাই তিনি রাজধানীতে প্রকাশ্যে খুনও হন।

তার সঙ্গে আমার পরিচয় অনলাইন সূত্রেই। তিনি নিজে মুক্তমনা ব্লগে আমার আইডি খুলে দিয়েছিলেন। আমার লেখালেখির বিষয় বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা না থাকলেও তার মুগ্ধ পাঠক ছিলাম। আগ্রহ ছিল বিজ্ঞানে, এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধেই ছিল আমার অবস্থান। এসব কারণে অনলাইনের পরিচয়ের বাইরেও মনে হতো আমরা আদতে কাছাকাছিই। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি যেদিন অভিজিৎ রায় মৌলবাদীর চাপাতির কোপে নিহত হন, সেদিনই বইমেলায় শুদ্ধস্বরের স্টলে তার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রথম দেখাতেই তিনি যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিলেন মনে হচ্ছিল আমরা অনেক দিনের পরিচিত। সে-ই প্রথম দেখা আমাদের; আর ওই দিনই শেষ দেখা ঢাকা মেডিকেলে, রক্তাক্ত ও নিথর দেহের অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে।

শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে একটা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান শেষে আমরা যার যার মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে যখন শুনলাম টিএসসিতে আক্রমণের খবর, তখন বুকটা ধক করে ওঠেছিল অজানা শঙ্কায়। অভিজিৎ রায় নয়তো? এমন প্রশ্ন যখন আমাদের তখনই নিশ্চিত হই এটা মুক্তচিন্তার বাতিঘর অভিজিৎই! জ্ঞানের আধার বইয়ের লৌকিক সাহচর্য আর বইমেলা থেকে ফেরার পথ তার জন্য জীবনের শেষ পথ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তার মাথায় আঘাত করেছিল অন্ধকারের আততায়ীরা। সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছিল রক্ত। সেই রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। লুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি মাটিতে, তার রক্ত ছুঁয়েছিল দেশের মাটি। জন্মমাটি। নিজেদের মালিকানায় এই মাটিকে আনার জন্য একদিন তার বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, যুদ্ধজয় করে বাড়িও ফিরেছিলেন। বাবার ত্যাগে অর্জিত সেই মাটিতে লুটিয়ে পড়া অভিজিৎ শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারালেন। সমাপ্ত হয় এক অক্ষয় যুগের, থেমে যায় তার কলম; চিরদিনের জন্যে।

অভিজিৎ রায় অগ্রসর চিন্তার একটা পরিবার থেকে ওঠে আসা বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ বিনির্মাণে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আর প্রসার ঘটানো এক নাম। অজ্ঞতার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো সমাজ-মানসে পরিবর্তনপ্রত্যাশী আলোকের এক বহ্নিশিখা। তার মৃত্যুর আজ ছয় বছর হয়ে গেছে। মনে হয় এই ছয় বছরের অনেক দূর পিছিয়ে গেছি আমরা। তার মৃত্যুতে খুব টের পাওয়া যায় এ ধারার শক্তিশালী লেখকের অভাবের বিষয়টি। গত ছয় বছরে সংশয়, বিজ্ঞানলেখনী আর যুক্তি নিয়ে উল্লেখ করার মতো প্রকাশনা সামান্যই অথবা নাই, এমনটা বললে কি অত্যুক্তি হবে!

জন্মদিনে আজ যখন অভিজিৎ রায়কে নিয়ে লিখছি তখন তার লেখালেখির কথা স্মরণ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে তার যোগ খোঁজার চেষ্টাও করছি। তিনি মুক্তচিন্তা আর প্রগতির বাংলাদেশের যে স্বপ্ন এঁকে বিজ্ঞানমনস্কতা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেটা কি আদৌ সম্ভব? উত্তরটা কঠিন, বিবিধ প্রশ্নসাপেক্ষও বটে। তবে আশা করতে দোষ কী! এই আশাবাদের পালে হাওয়া লাগে যখন তার জন্মের সঙ্গেও বাংলাদেশে জন্মসালের মিল পাওয়া যায়। ডিসেম্বরের বিজয়ের আগে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন, তার বাবা ফিরেছিলেন বীরবেশে। কঠিন সে সময়, অসম্ভবপ্রায় অনেককিছুই; তবু ত সম্ভব হয়েছিল। ক্ষীণ হলেও যে আশাবাদরেখা সে কি অনুপ্রেরণার? সময়ই বলে দেবে! অনুপ্রেরণার আলোরেখার জানান দেওয়া এই দেশের পঞ্চাশ পূর্ণ হয়েছে। অভিজিতের পঞ্চাশ হয়নি, পঞ্চাশ পূর্ণ হবে না তার। যদিও দেহের বয়স পঞ্চাশ পেরোবে, যে দেহ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে স্বাধীন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে।

অভিজিৎ রায় কট্টরপন্থী ছিলেন না, ছিলেন মুক্তচিন্তক। তার লেখালেখির অন্যতম বিষয় ধর্ম হলেও ধার্মিকদের তিনি শত্রুজ্ঞান করেননি। তাই তিনি উচ্চারণ করতে পারেন—‘আমি নাস্তিক, কিন্তু আমার আশেপাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধুবান্ধবই মুসলিম। তাদের ওপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমি আনন্দিত হই। তাদের ওপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনের বা কাশ্মীরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াব। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।’

শুভ জন্মদিন অভিজিৎ রায়!

 

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

Link copied!