রাজধানীর পল্লবীতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে (৫০) গুলি করে হত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। ঘটনার পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সোহেল ওরফে ‘পাতা সোহেল’ (মনির হোসেন) এবং মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম, তারাই এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। কিলিং মিশনে তারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আড়াই মাস আগে দুবাই থেকে দেশে আসা সোহেল ওরফে ‘পাতা সোহেল’ ও মাসুম ওরফে ‘ভাগিনা মাসুম’ যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যার পরিকল্পনাকারী। তাদের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসায় গোলাম কিবরিয়াকে হত্যা করা হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পল্লবীতে অপরাধ জগৎ, চাঁদাবাজি ও নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন ‘পাতা সোহেল’। দুবাই থেকে দেশে ফেরার পর তিনি এলাকায় আগের প্রভাব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেন। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়।
একটি সূত্র জানিয়েছে, একসময় ‘পাতা সোহেল’ ও গোলাম কিবরিয়া দুজনেই ‘কিলার মামুন’-ঘনিষ্ঠ একটি চক্রের হয়ে কাজ করতেন। পরে কিবরিয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে সরে এসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান— এ বিষয়টি সোহেলের মধ্যে ক্ষোভের কারণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, পল্লবীর আলোচিত প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক ‘ফোর স্টার গ্রুপ’ গোলাম কিবরিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা গেছে। বিদেশফেরত সোহেলও এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী ছিলেন। এ প্রভাব ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বও হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ছয়জনের ‘কিলিং স্কোয়াড’, ভাড়াটে খুনি গ্রেফতার
পুলিশ জানায়, গোলাম কিবরিয়াকে টার্গেট করে ছয় সদস্যের একটি সুসমন্বিত কিলিং স্কোয়াড মাঠে নামে। হত্যাকাণ্ডের সময় স্কোয়াডের সব সদস্যই এলাকায় অবস্থান করেছিল বলে তদন্ত দল ধারণা করছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ভাড়াটে খুনি জনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে, যা বর্তমানে যাচাই–বাছাই চলছে।
এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন— জনি ভাড়াটে খুনি। তাকে গ্রেফতার করেছি। অন্যদেরও শনাক্ত করা গেছে।
গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার দিনা বলেন, সোহেল ওরফে ‘পাতা সোহেল’ (মনির হোসেন) এবং মাসুম ওরফে ‘ভাগিনা মাসুম’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাদের পূর্বপরিকল্পনা ও নির্দেশনায় আসামি জনি ভূঁইয়া, সোহাগ ওরফে কালু ও রোকন দোকানে ঢুকে শরীরের একাধিক স্থানে গুলি করে আমার স্বামীকে হত্যা করে।
দ্রুত রিকশা চালাতে না পারায় চালককে গুলি, স্থানীয়দের হাতে ধরা
গুলির পর আসামিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় রিকশাচালক মো. আরিফের রিকশায় উঠে দ্রুত রিকশা চালাতে বলে। রিকশাচালক আরিফ দ্রুত রিকশা না চালাতে পারলে আসামিরা তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এসময় জনিকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয়রা।
আহত অটোরিকশাচালক আরিফ বলেন, দুই যুবক হেলমেট পরা অবস্থায় দৌড়ে আমার রিকশায় ওঠে তার কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে দ্রুত চালাতে বলে। দেরি হওয়ায় তারা তাকে গুলি করে। পরে এক পথচারী তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন। আরিফ পল্লবীতে থাকেন।
আজ মঙ্গলবার কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার দিনা পল্লবী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামিরা হলেন— মো. জনি ভূঁইয়া (২৫), সোহেল ওরফে পাতা সোহেল ওরফে মনির হোসেন (৩০), সোহাগ ওরফে কাল্লু (২৭), মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম (২৮) ও রোকন (৩০)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৭/৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামি পাতা সোহেল ও আসামি মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। তারা পূর্ব পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিলে আসামিদের মধ্যে এক নম্বর আসামি জনি ভূঁইয়া, সোহাগ ওরফে কালু ও রোকন ওই দোকানে অতর্কিতভাবে প্রবেশ করে। কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যে পিস্তল দিয়ে চোয়ালে, গলার ডান পাশে, বাম কানের পেছনে, ঘাড়ের পেছনে, বুকের ডান পাশে, বুকের বাম পাশে, ডান হাতের বাহু, বাম হাতের কনুই, বাম হাতের কবজিসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলির পর রক্তাক্ত অবস্থায় দোকানের ফ্লোরে পড়ে গেলে আসামিরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
কিবরিয়ার ছোট বোন স্মৃতি বলেন, আমার ভাইয়ের সঙ্গে কারো কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। হুট করে এসে ভাইরে মাইরা দিলো। কোনোদিন বুঝতেও দেননি তার সঙ্গে কারো সমস্যা আছে। যাদের টাকা দিয়েছে তারা খুন করেছে, পেছনে মূলহোতা কারা আপনারা বের করবেন।
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান জানান, ঘটনার সময় জনি নামে একজনকে আটক করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে চিহ্নিত সন্ত্রাসী পাতা সোহেল, ভাগনে মাসুম, দর্জি মামুন, বোমা কালু ও রোকনের নাম উঠে এসেছে। তারা ছয়জন কিলিং মিশনে অংশ নেন।
ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক নাকি মাদক নিয়ে দ্বন্দ্ব তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশনের কোনো বিষয় রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হবে।
ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার দিনা পল্লবী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে। জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিবি ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। আসামি যেখানেই থাকুক ধরা হবে। আসামি গ্রেফতারের পর হত্যার আসল রহস্য জানা যাবে।
































