গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বুধবারের পদযাত্রা বা সমাবেশটি ছিল পূর্ব ঘোষিত। এর আগে তারা উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৩০ জেলায় তাদের ‘জুলাই পদযাত্রা’ শেষ করেছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) এনসিপির নেতারা গোপালগঞ্জে যাবেন, সমাবেশ করবেন, সব কিছুই আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
এ সমাবেশকে ঘিরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। এ পরিস্থিতির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই দায়ী করেছেন পর্যবেক্ষকরা।
এদিন পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন সতর্ক। তারপরও বুধবার সকাল থেকে জেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ- নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সদস্যরা এনসিপিকে ঠেকাতে পথে পথে ব্যারিকেড দেয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার উলপুর-দুর্গাপুর সড়কের খাটিয়াগড় চরপাড়া এলাকায় পুলিশের গাড়িতে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। এ ঘটনায় পুলিশের তিন সদস্য আহত হন।
এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িতেও হামলা চালানো হয়। গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কের কংশুর এলাকায় এ হামলা চালানো হয়। যদিও তখনও এনসিপির নেতারা গোপালগঞ্জে পৌঁছাননি।
দুপুরে এনসিপির নেতারা গোপালগঞ্জে সমাবেশস্থলে পৌঁছানোর আগেই সেখানে হামলা চালান আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। তখন থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরে গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কের সমাবেশে এনসিপির নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশ শেষ করে গোপালগঞ্জ থেকে বেরিয়ে মাদারীপুরে যাওয়ার পথে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। বিকাল পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে গাড়িবহরে হামলা করা হয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে এনসিপির নেতারা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। বিকাল ৫টার দিকে সেনাবাহিনীর এপিসিতে করে তাদের গোপালগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, রাত সাড়ে ৭টার দিকে তারা নিরাপদে খুলনায় পৌঁছান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চার জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে বিবিসি। তবে এ ঘটনায় মোট কতজন নিহত হয়েছেন রাত ৮টা পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা জানাতে পারেনি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এরই মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলার সর্বত্র কারফিউ জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সেখানে চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারী অভিযোগ করে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পুলিশের তরফ থেকে তাদের সহায়তা করা হয়নি এবং হামলার সময়ও তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বিবিসিকে বলেছেন, ‘ধৈর্য ধরে তারা (পুলিশ) গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছেন। লিথ্যাল (প্রাণঘাতী অস্ত্র) কোনও কিছু ব্যবহার না করায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটু সময় লেগেছে।’
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে ও নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বুধবার দুপুরে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গোপালগঞ্জে খুনি হাসিনার দালালেরা আমাদের ওপরে আক্রমণ করেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে নাটক দেখছে, পিছু হটছে। আমরা যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি, তাহলে মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরবো, না হয় ফিরবো না।’
বুধবার বিকালে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনুভা জাবীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনা করে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বলেছেন, ‘গোপালগঞ্জে আসা মাসব্যাপী জুলাই পদযাত্রা’র অংশ। গত ১৫ দিন ৩০টার বেশি জেলায় শান্তিপূর্ণ ও সফলভাবে সভা-সমাবেশ শেষে আজকে গোপালগঞ্জে শিডিউল ছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে এরকম নারকীয় হামলা। তাও পুলিশ-আর্মির উপস্থিতিতে। এতজন সেনা সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নিজের শরীরের চেয়ে অস্ত্রের সাজ-সরঞ্জাম বেশি। তাও আমরা শান্তিপূর্ণ সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন করতে বাধা পেলাম। আমরা অবরুদ্ধ। কোনও ড্রোন শো লাগবে না, কোনও দিবস লাগবে না, কোনও প্রণোদনা লাগবে না। এ দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফেরান। গণতন্ত্রকে ফেরান।’
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। বুধবার (১৬ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘এর জন্যে তোদের চরম মূল্য দিতে হবে, এই গভর্নমেন্টকেও। একটা জেলায় জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা করবে নির্বাচন!’ এসময় ‘আগে দেশ নিয়ন্ত্রণ করারও’ আহ্বানও জানান তিনি।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা বাংলা বলেন, ‘এনসিপির এটা পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল। পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবারই বিষয়টা জানা ছিল। গোপালগঞ্জ নিয়ে সবারই বাড়তি নজর থাকার কথা। কিন্তু গোয়েন্দারাই বা কী করলেন। তাদের কাছে কী আজকের পরিস্থিতির কোনও তথ্য ছিল না? গোয়েন্দা তথ্য থাকলে আরও বাড়তি প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে আজকের এ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো যেত।’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী এ এস এম নাসিরউদ্দিন এলান বলেন, ‘বুধবারের পরিস্থতি এড়াতে গোপালগঞ্জের স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, ওই এলাকা একটি বিশেষ ও স্পর্শকাতর এলাকা। সেখানে আগে থেকেই বাড়তি প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল।’
এদিকে বুধবার রাতে খুলনা সার্কিট হাউজে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্লিয়ারেন্স নিয়েই সেখানে গিয়েছিলাম। তারা যে পথে যেতে বলেছেন, সেই পথেই গিয়েছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সন্ত্রাসীরা হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ স্যাবোটাজ করেছে কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। ঘটনার পর তারা যে তৎপরতা দেখাচ্ছে—সেটা আগে দেখালে ভালো হতো।’