রাজধানীর একটি তৈরি পোশাক কারখানায় সহকারী কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করেন মো. রাশেদুল ইসলাম। ঈদের ছুটিতে গাইবান্ধায় গিয়ে আটকে পড়েন কঠোর বিধিনিষেধের ফাঁদে। শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় পরিবারের সঙ্গে ভালোই সময় কাটছিল তার। কিন্তু হঠাৎ কল-কারখানা খুলে দেওয়ায় ভোগান্তি নিয়ে ঢাকায় ফিরতে হয় তাকে।
রাশেদুল ইসলাম জানান, শিল্প-কারখানা খোলার ঘোষণা আসার পর শনিবার (৩১ জুলাই) রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। গাইবান্ধা থেকে প্রথমে বাসে গাজীপুরের চান্দারা পর্যন্ত আসেন। এ জন্য ভাড়া গুনতে হয় এক হাজার ৬শ টাকা। অথচ সাধারণ সময়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় আসতে তার খরচ হয় মাত্র ৮০০ টাকা।
গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় আসতে শুধু বাড়তি ভাড়াই দিতে হয়নি রাশেদুলকে। মাঝে ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে অনেক। চান্দারা বাস থেকে নামার পর কিছু পথ সিএনজিতে, কিছুটা অটো রিকশায় এবং বাকি পথ ট্রাকে করে আসতে হয়। শেষে রাজধানীর মহাখালী থেকে পায়ে হেঁটে ভোরে কারওয়ান বাজার আসেন তিনি। এরপর কাজে যোগ দেন।
মুখে বিষণ্ণতার ছাপ নিয়ে এই গার্মেন্টসকর্মী বলেন, “আমি যেভাবে পরিশ্রম করে ঢাকায় এসেছি, এত পরিশ্রম করে কেউ আসে না। সারারাত রাস্তায় থাকায়, খাবার পর্যন্ত খেতে পারিনি। সকালে কাজে যোগ দিতে না পারলে হয়তো চাকরিই থাকতো না। সরকারের হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি।”
একই কর্মস্থলে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কাজ করেন রমজান আলী। শিল্পকারখানা খোলার ঘোষণা শুনে তিনিও ছুটে এসেছেন শেরপুর থেকে। শনিবার (৩১ জুলাই) বিকাল ৫টায় গ্রামের বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছেন শেষ রাতে। যাত্রাপথে বেশ কয়েকধাপে যানবাহন পাল্টানোর পাশাপাশি হাঁটতে হয়েছে প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাস্তা। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় দুই হাজার টাকা।
রমজান আলী জানান, সাধারণ সময়ে সবচেয়ে ভালো বাসে আসতেও তার খরচ হয় ৫০০ টাকা। ট্রেনে এলে খরচ মাত্র ২৮০ টাকা। তিনি বলেন, “একদিকে যেমন কষ্ট করেছি, তেমনি অন্যদিকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে। গার্মেন্টস খুলে দেওয়ায় বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে।”
বেতনের বড় অংশই চলে গেছে কর্মস্থলে ফিরতে
শিল্প-কারখানা খোলার ঘোষণার পর রমজান আলী বা রাশেদুলের মতোই ভোগান্তি নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। অধিকাংশেরই সারা মাস কাজ করে যে বেতন পান তার বড় অংশ চলে গেছে ‘লকডাউনে’র মধ্যে কর্মস্থলে ফিরতে। তারপরও চাকরি বাঁচাতে তাদের এই জীবন সংগ্রাম। সরকারের এই বিবেচনাহীন সিদ্ধান্তকে গরীবের ওপর জুলুম বলে অবহিত করছেন তারা।
করোনার সংক্রমণ মোকাবেলায় গত ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। গণপরিবহনের পাশাপাশি বন্ধ রাখা হয়েছিল শিল্পকারখানা। কিন্তু শিল্পকারখানার মালিকদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে শুক্রবার (৩০ জুলাই) হঠাৎ করেই রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা খোলার ঘোষণা দেয় সরকার। রোববার (১ আগস্ট) থেকে শিল্পকারখানা খোলার ঘোষণা আসার পরপরই রাস্তায় নামে মানুষের ঢল। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ট্রাক, সিএনজি, অটোরিকশা ও ফেরিতে গাদাগাদি করে এবং হেঁটে কর্মস্থলে ফিরতে থাকেন শ্রমজীবীরা। এমন পরিস্থিতিতে শনিবার রাত ৮টা থেকে রোববার বেলা ১২টা পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টা গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। তবে এতে শ্রমজীবীদের ভোগান্তি তেমন একটা কমেনি। কারণ অধিকাংশই গণপরিবহন চালুর আগে কষ্ট করে ঢাকায় ফেরেন। যারা গণপরিবহন চালু হওয়ার পর ফিরেছেন তাদেরকেও পড়তে হয়েছে দীর্ঘ যানজটে। গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া।
গণপরিবহন আগে খুলে দিলে ভোগান্তি কমতো
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গার্মেন্টসের এডমিন ম্যানেজার বলেন, “দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে শিল্পকারখানা খোলা রাখা খুবই প্রয়োজন। কারণ বিভিন্ন দেশ থেকে বায়ারদের অর্ডার আছে। সেগুলো সময়মতো দিতে না পারলে অর্ডার বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সময়মতো পোশাক রপ্তানির জন্য সেগুলো তৈরি করতে হয়। যেটা গার্মেন্টস বন্ধ থাকলে বা কর্মী না থাকলে সম্ভব নয়।”
এই এডমিন ম্যানেজার আরো বলেন, “গণপরিবহন না থাকায় শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফিরতে অনেক কষ্ট হয়েছে। ঈদেও মানুষ এমন কষ্ট করে গ্রামের বাড়ি যায়, আবার ফিরে আসে। তারপরও শিল্পকারখানা খোলার অন্তত দুইদিন আগে গণপরিবহন খুলে দেওয়া উচিত ছিল। এতে শ্রমিকদের ফিরে আসতে কষ্ট কিছুটা হলেও কম হতো।”
গার্মেন্টস ট্রেন চালু করা যেত
এদিকে গণপরিবহন বন্ধ রেখে শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সরকারের সমন্বয়হীনতা বলছেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, “সরকারের এই পদক্ষেপটি খুবই হতাশাজনক। করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে হঠাৎ করে শিল্পকারখানা খোলার প্রয়োজন ছিল না। খুললেও সেটার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। আম পরিবহনের জন্য যেমন ম্যাঙ্গো ট্রেন চালু করা হয়েছে, তেমনি শ্রমজীবী মানুষদের পরিবহনের জন্য গার্মেন্টস ট্রেন চালু করা যেত। গণপরিবহন খোলা থাকলে শ্রমজীবী মানুষদের এত ভোগান্তি নিয়ে, অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে আসতে হতো না। এতে গণপরিবহন শ্রমিকদের কিছুটা রুটি-রুজির ব্যবস্থা হতো।”
ডা. বে-নজির আহমেদ আরো বলেন, “সরকার চায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে, দারিদ্র দূর করতে, উন্নয়ন করতে, দেশের মানুষকে ভালো রাখতে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কিছু কর্মকর্তাদের অদক্ষতার জন্যই বারবার সরকারের ভালো উদ্যোগগুলো ভেস্তে যাচ্ছে। সরকারের উচিত দক্ষ জনবল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। নইলে প্রতিবারই এমন সমস্যার সৃষ্টি হবে।”