• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

সুধীর চক্রবর্তীকে স্মরণ


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩, ০১:২৭ পিএম
সুধীর চক্রবর্তীকে স্মরণ

সুধীর চক্রবর্তী ভালো না বেসে পারা যায় না। আমার এই যে গান নিয়ে লেখার আগ্রহ, গানকে বোঝার চেষ্টা, গানের ইতিহাস জানবার আকাঙ্ক্ষা এসব সব কিছুই পেয়েছি সুধীর চক্রবর্তীর কারণে। বাংলা গানকে নিয়ে যদি ভাবতে চান, তবে সুধীরবাবুর বই পড়তেই হবে। এখানেও কৃতিত্ব লীনাপুর, তিনি আমাকে কিনে দিয়েছিলেন সুধীর চক্রবর্তীর বই, বাউল ফকির ও লৌকিক ধর্ম নিয়ে একটা বই। বইটা এত দারুণ, এত অনুকরণীয় গদ্য শৈলী। আমি পড়ে মুগ্ধ।

এরপর সুধীর চক্রবর্তীর অনেক কিছুই পড়েছি, নানান জনের থেকে নিয়ে ব্রাত্য লালন বিষয়ক বই কিংবা নিজের সংগ্রহে সাহিত্যের লোকায়ত পাঠ অথবা বিভিন্ন কবিতা নিয়ে তার আলোচনা মূলক বই। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তার অনেক লেখা আছে, সেসব আমার কম পড়া হয়েছে। কিন্তু তার নিজস্ব রবীন্দ্র ভাবনার জায়গাটা আমি বুঝি, সেটা গভীর ভাবে সুধীর চক্রবর্তীকে পাঠের কারণেই।

সুধীর চক্রবর্তী একটা বয়স পর্যন্ত গান শিখেননি। রেডিও ও গ্রামোফোন কিছুই তার ছিল না বাসায়। তার বাবা একটা ছোট সরকারি চাকরি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে তাদের কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে আসতে হয়। জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি কৃষ্ণনগরেই কাটিয়েছেন। কলকাতায় এসেছিলেন উচ্চশিক্ষায়। কিন্তু কৃষ্ণনগরে এক কলেজে ফাংশনে গান গাওয়ার পর, কলেজ প্রিন্সিপাল জিগ্যেস করেন, ‘কার কাছে গান শিখো?’ তিনি জানান, ‘কারো কাছেই না, শুনে শুনে।’ তখন সেই প্রিন্সিপাল সপ্তাহে একদিন করে তাকে নিয়ে বসতেন। প্রিন্সিপাল ছিলেন জ্ঞানী সাধক, দিলীপ রায়ে শিষ্য। অতুলপ্রসাদ, ডিএল রায়, নজরুল, রজনীকান্ত সেনদের গান শেখাতেন। রবীন্দ্র সংগীতের ব্যাপারে একটু উন্নাসিক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার সময় তার রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে খুব আগ্রহ জন্ম নেয়। তখন রবীন্দ্র সংগীতের অন্যতম সেরা সময় চলছিল। কণিকা, সুচিত্রা, দেবব্রতরা সমানে গান গেয়ে শ্রোতাপ্রিয় হচ্ছেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীতের টেক্সট পড়া শুরু করেন। তিনি পাইওনিয়ার যে রবীন্দ্রনাথের গানকে শুধু গান হিসেবে না দেখে তাকে এক ধরনের কাব্য হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন ও সিরিয়াসভাবে এসব নিয়ে লিখেছেন। তার আগে রবীন্দ্রনাথের গানের তাল ও সুর, গাওয়ার রীতি এসব নিয়েই শুধু আলাপ হতো।

এখনকার ছেলেমেয়েরা কালচারাল এনথ্রপলজির জিকির করে। তিনি এসবের আগেই এই অঞ্চলে অন্যতম বড় নৃতাত্ত্বিক। বাংলার বিভিন্ন ছোট ছোট লোকধর্ম থেকে শুরু করে টেরাকোটার মন্দির সব নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। এমন এমন অদ্ভুত সব ছোট প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা তিনি জানিয়েছেন, যাদের কথা তিনি না বললে আমি অন্তত জানতাম না। মেহেরপুরে এক হাড়ি জনগোষ্ঠীর কথা তিনি জানিয়েছিলেন। যারা সবাই কৃষক ও ক্ষেত খামারে কাজ করে। হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের লোকেরাই আছে। দুনিয়াকে তারা একটা বড় হাঁড়ির সঙ্গে তুলনা করেন। সপ্তাহের দুদিন তারা এক হাড়িতে খিচুড়ি রান্না করেন। ভক্তরা সবাই খান। গান বাজনা হয়। কী সাবলীল আমাদের লোকাচারগুলো। এসব খবর আমি ওনার মাধ্যমেই পেয়েছি। দীর্ঘ ১২ বছর তিনি কৃষ্ণনগর থেকে ধ্রুবপদ নামের এক পত্রিকা বের করতেন। সেখানে তারা কোনো বিজ্ঞাপন নিতেন না। কারণ সুধীর বাবু আবিষ্কার করলেন, সাত আটবার বিজ্ঞাপনের জন্য যাওয়া আসা একটা অযথা শ্রম। তিনি শুভানুধ্যায়ী বের করলেন, যারা দশ হাজার টাকা দেবেন। তাদের থেকে টাকা নিয়ে তিনি লেখকদের দিতেন, আর পত্রিকা বিক্রি করে আবার টাকা জমাতেন। এভাবে টাকা জমিয়ে তিনি এক লাখ বিশ হাজার টাকা ১২ বছরে জমিয়েছিলেন। পরে পুরোটাই ধ্রুবপদ বন্ধ করার সময় তিনি দান করে দেন। পত্রিকা বের করার সময় তিনি দুটো আদর্শ মাথায় রাখতেন। এক, নিজের লেখা ছাপাবেন কম। দুই, লেখকদের টাকা দিতে হবে, মনোযোগী নতুন লেখকদের লেখা ছাপানো।

আমার কাছে সুধীর চক্রবর্তীর আরেকটা বড় কাজ মনে হয়, আধুনিক বাংলা গান নিয়ে। তিনি আজকাল পত্রিকার জন্য লিখতেন কলাম। গানকে তিনি শুধু বিনোদনের জন্য ভাবতেন না। গান নিয়ে, গীতিকার ও সুরকারের সেই সময় এসব নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতেন। আমি সুধীর চক্রবর্তীর মারফতই জেনেছি, মান্না দে কোনোদিন কফি হাউজে যাননি। গানটা দরদ দিয়ে গাইলেও তার সঙ্গে কফিহাউজের আবেগ নেই। নচিকেতা ঘোষের ছেলে গানটায় মূলত আড্ডার গল্প লিখেছিলেন। এমন অনেক মানুষ আছে যারা জীবনে কফিহাউজে বসেন নাই, তাদেরও প্রিয় গান এটি। জটিল বাবুর গান, এ কোন সকাল কিভাবে এলো? নকশাল আন্দোলনে যখন চারিদিকে খুনাখুনি তখন নিজের বাসার কাছে রবি শংকরের এক সেতার শুনে তিনি গানটা প্রস্তুত করেন ২০ মিনিটে। এসব তথ্য তিনি না বললে কই পাবো? প্রতুল বাবু আমি বাংলায় গান গাই, গানটার নতুন জনপ্রিয়তা নিয়ে কীরকম হতাশ ছিলেন, এসব গল্পও আছে। সুধীর চক্রবর্তীর মতো আমার জ্ঞান নাই। আমার সেরকম বিপুল পাঠ ও গবেষণাও নাই। আর তার মতো গদ্য অনেক সেরা সাহিতিকদেরও নেই। কিন্তু আমি তার মতো গান নিয়ে ভাবতে চাই, বিনোদনের বাইরে গানকে নিয়ে লিখতে চাই। এই শিক্ষাটা আমি তার কাছে পেয়েছি। তার বন্ধু ছিল সুনীল, সন্দীপন, তারাপদ, দীপক মজুমদারের মতো রথি মহারথীরা। এসব নিয়ে তার কোথাও গল্প পাবেন না, তিনি একাগ্র চিত্তে যেসব নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন, করে গিয়েছেন জীবনভর। লোকগান, গৌন ধর্ম ও লোক সুর থেকে লোকনৃত্য সবকিছুই তিনি নিজের মতো করে খুঁজেছেন। বরং তার কাছে পাবেন, পথের মানুষ কিংবা বাউলদের গল্প। শেষবয়সে এক ধাবায় তিনি চা খাচ্ছিলেন একদিন। যে ছেলেটা কাজ করে, তাকে জিগ্যেস করলেন, বাবু তোমার নাম কী? ছেলেটা পৃথিবীর সমান অন্ধকার মুখে নিয়ে জানিয়েছিল, নাম জেনে কাজ নাই, আমি মুসলমান। সুধীর বাবু এই গল্পটা লেখার সময় বলেছিলেন, এই অন্ধকার কিশোরের মুখটাই একটা ভারত। তাই সুধীর চক্রবর্তীর কাছে আমার অনেক ঋণ। সেই দায় নিয়েই এই সামান্য লেখাটা জন্মদিনে।

Link copied!