• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে আমাদের ঋণ


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২৩, ১১:৪২ এএম
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে আমাদের ঋণ

পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার দুতিন বছর পর এক দিবস ভিত্তিক ফাঁদে পড়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা। স্বার্থহীন ভাবে চর্চা করা হয় না তাদের জীবন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রয়াণ দিবসও চলে গেল (১৪ মে) আড়ম্বরহীন ভাবেই। আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের বিরলপ্রজ মানুষ, যার সঙ্গে বিভিন্ন প্রজন্মের বড় মানুষদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এমন কি অতি সাধারণ ছাত্রের কথাও তিনি ভুলতেন না। শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন আন্তরিক, বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষকেও তিনি চিনতেন গভীরভাবে। ওনার মতো মানুষদের একটা সমস্যা হয় কমিউনিকেশন ব্রেকডাউনের, আনিসুজ্জামানের সেই সমস্যাটা হয়নি। তিনি দেশে বিদেশে যেতেন, অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতেন, লেকচার দিতেন, এই আনুষ্ঠানিকতা তার খারাপ লাগতো না। তিনি চাইতেন দিকে দিকে মানুষ তাকে দেখে অনুপ্রেরণা হিসাবে যেন নেয়। এরচেয়ে ভালো আর কী?

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অসময়ে চলে গেছেন তা হয়তো কেউ বলবে না। কিন্তু তার মতো মানুষের চলে যাওয়া মানেই দুঃসময়। তিনি একটা এমন প্রজন্মের মানুষ, যে প্রজন্মে প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও বদরুদ্দীন ওমর ছাড়া আর দেশে এখন তেমন কেউ নেই। আবু হেনা মোস্তফা কামাল হয়ে আহমদ ছফা থেকে হালের মোহাম্মদ আজম তার স্নেহ ও পঠন পাঠন আড্ডা সমালোচনা থেকে বঞ্চিত হননি। আমাদের এই দেশে সব কিছুতেই আনিসুজ্জামানকে প্রয়োজন ছিল। জাতীয় কবি নজরুলের অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ উদযাপন, বাংলা একাডেমির প্রবন্ধ পাঠ, সবকিছুতেই তিনি। এমনকি আহমদ ছফার প্রয়াণ দিবসেও তিনি থাকতেন। হুমায়ুন আজাদ থেকে হুমায়ূন আহমেদ, সবাইকে নিয়েই তাঁর আছে আকর্ষণীয় কিন্তু ছোট রচনা। ব্রিটিশ সময়ে জন্ম পাকিস্তান আমলে বিকশিত এমন সব বুদ্ধিজীবীকে নিয়েও আছে তাঁর সুন্দর সব স্মৃতি আলেখ্য। ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সহকর্মী সবার স্মৃতি তিনি সংরক্ষণ করতেন, বলতেন ও লিখতেন। কারো স্মারকগ্রন্থ বের করার জন্য ওনাকেই সবাই ডেকে আনতো। সম্পাদনাতেও তিনি অনন্য।

‘কাল নিরবধি’ আর ‘বিপুলা পৃথিবী’ এই দুটো গ্রন্থ সবার পাঠ করা উচিত। বাংলাদেশের জাতি রাষ্ট্রের কালক্রম বোঝার জন্য এই দুটি বইয়ের বিকল্প নাই। এ দুটো বই পড়লে মনে হবে তিনি সবাইকে দেখতেন কি নৈর্ব্যক্তিকভাবে। সাদা কালোর বাইরেও একটা ‘গ্রে’ এরিয়া থাকে, সেটা তিনি বুঝতেন। অধ্যাপক পবিত্র সরকার তাকে নিয়ে বলেছিলেন, “রাশভারী চেহারাও নিয়েও কিভাবে ঋষিতুল্য মানুষ হওয়া যায় আনিসুজ্জামান সেটার প্রমাণ।”

সরকারি বেসরকারি দেশি বিদেশি বড় বড় পুরষ্কার প্রাপ্তির বাইরেও আনিসুজ্জামান আমাদের দেশের এক উজ্জ্বল খ্যাতিমান মানুষ। তার গবেষণা আর শিক্ষকতায় প্রবল সাফল্যের পরেও তিনি এমন মানুষ, যাকে পাশে পাওয়া যেত সবসময়। ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র শতবর্ষ উদযাপন, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধ, জাহানারা ইমামের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাতেই ছিল তার অংশগ্রহণ। শিক্ষা কমিশন আর খসড়া সংবিধানের বাংলা সব ব্যাপারেই রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। তার মতো আর কেউ নন। এই বাংলাদেশে যতদিন বাংলা থাকবে ততদিন তিনি থাকবেন সবার স্মরণে। নিজের অপরিহার্যতা তিনি জীবিত অবস্থাতেই কর্ম গুণে নিশ্চিত করে গেছেন। তাই আনিসুজ্জামানকে আমরা স্মরণ করবো একজন দেশপ্রেমিক অধ্যাপক, যিনি ভাষা দেশ কালের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। গুটিকয় অদ্ভুত মানুষ যারা নিজেরা একা একা ওপরে ওঠার চেষ্টা করতেন না। সবাইকে নিয়ে প্রজ্ঞা ও বিকাশের পথে হাঁটাই ছিল যার লক্ষ্য। গতকাল চলে গেল তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ এই কর্মবীরকে!

Link copied!