• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মুহররম ১৪৪৫

আমরা একটা মেকানিক্যাল জাতিতে পরিণত হচ্ছি : আনোয়ারা সৈয়দ হক


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২১, ০৬:২৩ পিএম
আমরা একটা মেকানিক্যাল জাতিতে পরিণত হচ্ছি : আনোয়ারা সৈয়দ হক

অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক একাধারে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও একজন কথাসাহিত্যিক। তিনি বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার রচনায় মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। সাম্প্রতিক নানা বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে কথা হয় এই মনোবিদের সঙ্গে। কথা বলেন সংবাদ প্রকাশের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক অঞ্জন আচার্য


সংবাদ প্রকাশ : সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, ঠুনকো বিষয় নিয়ে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করছে। এই যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আনোয়ার সৈয়দ হক : যখন একটা জনজীবন থেকে (জনজীবন বলছি কিন্তু, জাতীয় জীবন বলছি না) শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের মতো বিষয়ের অন্তর্ধান ঘটে, তখন এমন অবক্ষয় হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী হচ্ছে, নাটক-থিয়েটার হচ্ছে, পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে কবিতা প্রতিযোগিতা করছি। সবাই মিলে চড়ুইভাতি করেছি, ক্লাবের নাটক হচ্ছে, নাটক দেখতে যাচ্ছি। মেলা হচ্ছে— রথের মেলা, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তীর আয়োজন করছি। দলবেঁধে আমরা সেসব করেছি। এখন যেটা টেলিভিশনে দেখা যায়, তখন সেটা আমরা পাড়ায় পাড়ায় করতাম। সেসময় গল্পের বই পড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। কে কয়টা বই পড়লো, তা নিয়ে আলোচনা হতো। খুব ধীরে ধীরে আমরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে গেছি। এখন আমরা সবকিছু ঝটপট চাই। এখন পাশের লোকের যদি বড় একটা গাড়ি থাকে, যেভাবেই হোক আমারও বড় একটা গাড়ি দরকার হয়ে ওঠে। ওই যে ভেতরের বেড়ে ওঠা, অন্তরজগতের যে বৃদ্ধি, সেটাতো আমাদের ভেতর ছিল না। এটাতো অনেক দিন আগে অন্তরিত হয়েছে।

সংবাদ প্রকাশ : হ্যাঁ, তা ঠিক। সময় অনেকখানি পাল্টে গেছে।

আনোয়ারা সৈয়দ হক : তারপরে একটা ব্ল্যাংক হেকিং পিরিয়ড গেছে। আমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। পিতার পরিবারকে হরণ করা হয়েছে। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের জীবনে আর কী থাকলো? 

সংবাদ প্রকাশ : তখন একটা সংকটকাল গেছে সত্যি...

আনোয়ারা সৈয়দ হক : হ্যাঁ, আমাদের জাতীয় জীবনে প্রাপ্তি বলতে তো কিছু থাকলো না। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি দূরে চলে গেল। এখন সংগীত করা মানে, মুসলমান হয়ে সংগীত করা যাবে না, পাড়ার লোকেরা খারাপ বলবে— এসব শুনতে হচ্ছে। মুসলিম নারীরা এখন বোরকা পরে, নেকাব বা হেজাব পরে, ত্রিশটা রোজা হওয়ার পরে ৭টা অতিরিক্ত রোজা রাখে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্মান্ধতা কীভাবে বেড়ে গেছে। ভেতরকার শক্তিটা কোথায় যেন ভেঙে গেছে, যা রবীন্দ্রনাথ বা বিদ্যাসাগর থেকে আমরা একসময় পেতাম। আমার বাড়ির কোনো ছেলে বা মেয়ে বিদ্যাসাগর পড়েছে? আমার বাড়ির কথা বলছি, অন্য বাড়ির কথা ভুলে যাও। সুতরাং এটা বললে তো হবে না। এই সংস্কৃতি তো একদিনে পাল্টায়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। 

সংবাদ প্রকাশ : কেন এমনটা হলো বলে আপনি মনে করেন?

আনোয়ারা সৈয়দ হক : রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তারপরেও আমাদের রক্তহনন সারেনি। আমাদের মানসিকতা অত্যন্ত নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। নইলে তিন বছরের একটা বাচ্চা ছেলের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে দিয়ে মেরে ফেলছে, এটা কী ধরনের নৃশংসতা? এটা কোনো মানুষ করতে পারে? কোনো পশুও তো পশুকে এমনটা নৃশংসভাবে মারতে পারে না। এটা প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা বলছি। তাহলে এখন কী হচ্ছে? সেখান থেকে তো আমাদের উত্তরণ ঘটেনি। আমরা তো ফিরে যাইনি আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া অরণ্যের মতো। আগের সেই সমাজ, আগের সেই ভূমিকা, আগের সেই বাবা-মা— কিছুই আগের মতো নেই। এখনকার বাবা-মায়ের মন-মানসিকতা সম্পূর্ণ আলাদা। এখন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি কোথায়?
যে জাতির জীবন থেকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি উঠে যায়, শুধু টেলিভিশনে জড়ো হয় সেগুলো, সে জাতির এটাই হচ্ছে পরিণতি। আর কী?

সংবাদ প্রকাশ : তাহলে করণীয়?

আনোয়ারা সৈয়দ হক : তোমার পাড়ায় লাইব্রেরি আছে? এই যে এত বড় গুলশান এলাকায় আমি থাকি, যেখানে শুনি বড়লোকেরা ১২টার আগে ঘুম থেকে উঠে না, এখানে কোনো লাইব্রেরি দেখাও তো, যেখানে তুমি দুটো বাংলা বা ইংরেজি বই পাচ্ছো? এই যে, এত্তো বড় এলাকা, এখানে কোনো একটা লাইব্রেরি আছে? একটা বইয়ের দোকান খুলেছিল। তিন দিনও টিকতে পারলো না, লালবাতি দিয়ে চলে গেল। যে জাতির জীবন থেকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি উঠে যায় সেখানে তো অরাজকতা চলবেই। আমরা একটা মেকানিক্যাল জাতিতে পরিণত হচ্ছি। 
দেখতে পাই, বাবা মারা যাচ্ছেন করোনা হয়ে। ছেলে ফেসবুকে দেখাচ্ছে, আমার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আর সবাই বলছে, আহা তোর বাবাটা মরে গেল! তুমি দেখো ছেলে কতখানি মেকানিক্যাল! বাবা মারা যাচ্ছে, তার শেষ দৃশ্য পর্যন্ত সে শেয়ার করছে ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে। এখন লাইক আর শেয়ারের যুগ। এই হচ্ছে মানুষের জীবনে। লাইক দাও আর শেয়ার করো।

সংবাদ প্রকাশ : এখান থেকে উত্তরণের উপায় কি তবে নেই?

আনোয়ারা সৈয়দ হক : শোনো, আমাদের দেশে যে দুটো-পাঁচটা লোক একসঙ্গে বসে চিন্তা ভাবনা করবে, সেই উদ্যোগ তো হারিয়ে গেছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা ইউরোপ-আমেরিকায় থাকে। আমি বলি, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকো। আর কোনো উপায় নেই। ‘মিরাকেল মে হ্যাপেন’ বলে একটা কথা আছে, সেটা হলে কিছু একটা হতে পারে। 
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ হলো। ওইটা হচ্ছে মিরাকেল। তবে মিরাকেল কিছু হলে আমাদের দেশের সরকার যত দূর পারে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

সংবাদ প্রকাশ : রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে তো, সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

আনোয়ারা সৈয়দ হক : আওয়ামী লীগ তো সারাজীবন রাজত্ব করবে না। ফলে আওয়ামী লীগ গেলে কে রাজত্ব করবে? তুমি কি চাও যে জামায়াত রাজত্ব করুক? না। তুমি কি চাও বিএনপি রাজত্ব করুক, যারা বঙ্গবন্ধুকে মেরেছে, না। তাহলে তোমার বিকল্প পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি রাজত্ব করুক? কম্যুনিষ্ট পার্টির শিরদাঁড়া ভাঙা। তাদের এই মনোবল নেই, যে তারা রাজত্ব করবে। তারা সুযোগ পেয়েও সুযোগ হারায়। তাহলে তোমার বিকল্প পার্টি কে হবে? তোমার কি পার্টি হবে এরশাদের পার্টি? না, তাদের কোনো নীতি-আদর্শ নেই। তাহলে বিকল্প পার্টি কে আওয়ামী লীগের?

সংবাদ প্রকাশ : তাহলে বিকল্প কে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আনোয়ারা সৈয়দ হক : এত বছর আন্দোলন করে হেফাজত কি বিকল্প পার্টি হবে, বলো? তাহলে আমার বিকল্প পার্টি কে হবে? বিকল্প পার্টি হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চ হতে পারে, যাদের মুখের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। পুরো বাংলাদেশের মানুষের স্লোগান যখন ‘জয় বাংলা’ হবে, তখন বুঝতে হবে— আমরা একাট্টা। আমাদের ভেতরে বিভিন্ন রকমের পার্টি থাকবে, দল থাকবে, মতভেদ থাকবে। কিন্তু আমরা এক জায়গায় একাট্টা। সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর ‘জয় বাংলা’। তবে সেখানে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের ছেড়ে দিতে হবে। কারণ, বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন জাতীয় নেতা। উনি কোনো দলের নেতা নয়। দল থেকে উনার ঊর্ধ্বে গমন হয়েছে।
তোমরা তরুণ প্রজন্ম। ভবিষ্যৎ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এটুকু ভরসা করি, কোনো একটা সংকটকালে এই তরুণরাই এগিয়ে আসবে।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!