চীনকে হটিয়ে মিয়ানমারের বিরল খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় আমেরিকা। মঙ্গলবার চারটি সূত্রের বরাতে এ তথ্য দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। প্রতিবদেন বলছে, দেশটির সবচেয়ে বেশি খনিজ সম্পদ রয়েছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত কাচিন রাজ্যে।
চীনের সম্পর্ক ভালো হলেও গোষ্ঠীগুলো মূলত পশ্চিমপন্থী। আর এ সুযোগেই, ওয়াশিংটন বিদ্রোহীদের সঙ্গে খনিজ চুক্তি করতে পারে।
এ নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনটা ঘটলে বেইজিং তা ভালোভাবে নেবে না। কারণ, এখনো মিয়ানমারের খনিজ সম্পদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন।
এদিকে উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশটির বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুলেছে, বিরল খনিজ সম্পদ ছাড়া মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনায় আছে কি না!
জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের বাজারের ৪১ শতাংশ। এই জোট ও তাদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বে ছড়ি ঘোরানোর ক্ষেত্রে এই সক্ষমতা বিশেষভাবে কাজে লাগিয়েছে। এখন ভবিষ্যতের জ্বালানি হিসেবে বহুল আলোচিত বিরল খনিজের যে আলাপ, সেখানে বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চীনের হাতে।
বিশ্বের মোট বিরল খনিজের ৬০ শতাংশ আকরিকের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, ৮৫ শতাংশ আকরিকের উৎপাদন চীনের নিয়ন্ত্রণে। আর বিরল খনিজ থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদনের হিসাব ধরলে এ নিয়ন্ত্রণ ৯৫ শতাংশ।
বিরল খনিজ নিয়ে বেশ তো আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে–এই বিরল খনিজ আসলে কী? কী কাজেই‑বা লাগে? এক কথায় উত্তর দিতে গেলে বলতে হয়, এই সময়ে বিরল খনিজ ও তা ব্যবহারে তৈরি নানা পণ্য মানুষের জীবনের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হাতে থাকা সেলফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন, গাড়ি থেকে শুরু করে বিচিত্র সব প্রযুক্তি পণ্য, যার ভেতরে চুম্বক থাকে বা যা তৈরিতে চুম্বক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তার সবকিছুতেই রয়েছে এই বিরল খনিজের উপস্থিতি। যোগাযোগ ব্যবস্থা তো বটেই, চিকিৎসা সরঞ্জাম, সামরিক সরঞ্জাম, টেকসই জ্বালানি রূপান্তর–এই সবকিছুই আসলে নির্ভর করছে এই অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতার ওপর।
এবার একটু গভীরে যাওয়া যাক। বিরল খনিজের মধ্যে আসলে কোনগুলো পড়ে? প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে কোনগুলোই‑বা কাজে লাগে?
বিরল খনিজ কোনগুলো
ল্যানথেনাইড সিরিজের ১৫টি মৌল এবং স্ক্যান্ডিয়াম ও ইত্রিয়াম মিলিয়ে ১৭টি ধাতুকে একসঙ্গে বিরল খনিজ বলা হয়। এর মধ্যে ল্যানথেনাইড সিরিজের মৌলগুলোকে একযোগে বলা হয় বিরল মৃত্তিকা ধাতু। এই শ্রেণির নামকরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, মাটিতে এই মৌলগুলো পাওয়া যায়। এমনিতে একে বিরল বলার তেমন কারণ নেই। তবে এর প্রক্রিয়াকরণ জটিল এবং পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় এগুলো ‘বিরল’ খেতাব পেয়েছে। মূলত বাণিজ্যিকভাবে এসব মৌলকে বা এগুলোর অক্সাইড উৎপাদনেই মূল জটিলতা। সব ধরনের পরিবেশগত বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে গেলে এর উৎপাদন ব্যয় যায় বেড়ে।
এই ১৭টি বিরল মৌলের মধ্যে রয়েছে–স্ক্যান্ডিয়াম, ইত্রিয়াম, সেরিয়াম, প্রাসিওডিমিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, টারবিয়াম, ল্যানথেনাম, গ্যাডোলিনিয়াম, থুলিয়াম, ইটারবিয়াম, নিওডিমিয়াম, ইউরোপিয়াম, প্রোমিথিয়াম, হলমিয়াম, লুটেসিয়াম, আরবিয়াম ও সামারিয়াম।
তবে এই ১৭ মৌলের মধ্যে মোটাদাগে পাঁচটির গুরুত্ব অন্যগুলোর চেয়ে বেশি। খনি সম্পর্কিত ওয়েবসাইট মাইনিং ডটকমের তথ্যমতে, এই ১৭ বিরল খনিজের মধ্যে নিওডিমিয়াম, ইউরোপিয়াম, টারবিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম ও ইত্রিয়ামের ব্যবহার তুলনামূলক বেশি।
সে যাক। মোটাদাগে এই বিরল খনিজের জন্য গোটা বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তি এখন হন্যে হয়ে ঘুরছে। এটা অনেকটা ফ্রাঙ্ক হারবার্টের সিনেমা ‘ডিউন’‑এর সঙ্গে তুলনাযোগ্য। সেখানে দেখানো হয়, ‘স্পাইস’ নামের বিশেষ একটি উপাদানের কল্যাণে মানুষ মহাকাশে নিজেদের বিস্তার ঘটাতে পেরেছে। অর্থাৎ, মানুষের এই পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে ঘাঁটি গাড়ার পেছনে আছে বিশেষ এক পদার্থ। বাস্তব পৃথিবীতে বিষয়টি হুবহু এমন নয়। তবে আধুনিক প্রযুক্তি বলতে আমরা যা কিছু জানি, তার সঙ্গে কিন্তু এই বিশেষ এক ধরনের উপাদানের যোগ রয়েছে। এটি অবশ্য একক কিছু নয়। আগেই বলা হয়েছে, ১৭টি মৌল নিয়ে এই বিরল খনিজের দুনিয়াটি গড়ে উঠেছে। আলোচনা আরেকটু গেলে বোঝা যাবে এই বিরল খনিজের হাতছানি মানুষকে মহাকাশেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে আলোচনা যথাস্থানে আসবে।
আধুনিক প্রযুক্তি ও বিরল খনিজ
আধুনিক প্রযুক্তি দুনিয়া অনেকাংশেই বিরল খনিজের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান সম্পর্কিত ওয়েবসাইট সায়েন্সনিউজ ডটকমে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ ধরা হলেও সেরিয়াম পেট্রোলিয়াম পরিশোধনে ব্যবহৃত হয়, আর নিউক্লিয়ার চুল্লিতে নিউট্রন ক্যাপচারের জন্য ব্যহৃত হয় গ্যাডোলিনিয়াম।
তবে বিরল খনিজের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার আলো বিকীরণ ও চৌম্বক ধর্মের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের হাতে হাতে আজ যে স্মার্টফোন, তার রঙিন স্ক্রিন, কানে থাকা হেডফোন, ব্যাঙ্কনোটের গোপন নিরাপত্তা সংকেত, ক্ষেপণাস্ত্রের শরীরে থাকা তাপসংবেদী কাঠামো, কিংবা সাগরতলে থাকা ফাইবার অপটিক সরবরাহ লাইন–এই সবকিছুতেই ব্যবহৃত হয় বিরল খনিজ। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য চুম্বক তৈরির পেছনেও রয়েছে এরা। আর যদি বায়ুশক্তি, বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির (ইভি) মতো টেকসই প্রযুক্তির কথা বলা হয়, তবে এই বিরল খনিজ ছাড়া উপায়ই নেই। এমনকি কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে এই এত এত যে গবেষণা, তা হয়তো আর ভবিষ্যৎ দেখবে না, যদি এই বিরল খনিজ না থাকে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, বিরল খনিজভুক্ত এই ১৭ মৌলের কী এমন বিশেষত্ব যে, তারা এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাদের বিশেষত্ব মূলত তাদের পরমাণুর কাঠামোর ভেতরে। এই প্রতিটি মৌলের পরমাণুর কাঠামোতে রয়েছে অপূর্ণ এফ অর্বিটাল। বিস্তারিত আলাপে না গিয়ে বলা যায়, পরমাণুর কাঠামোর মধ্যে থাকা এফ অর্বিটালের ইলেকট্রনগুলো উত্তেজিত অবস্থায় ওপরের স্তরে যেতে পারে, যা শক্তি বিকীরণের মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেট বা আগের স্তরে ফিরে আসে। এই বিকীরিত শক্তিই আসলে তার থেকে পাওয়া নানা বর্ণিল আলোর উৎস। আবার অপূর্ণ অর্বিটাল হওয়ায় এসব পরমাণুর বহিস্তরে ইলেকট্রনগুলো সমরূপ (একই দিকে স্পিন করা) দশাপ্রাপ্ত হতে পারে বেশি। ফলে সহজেই এগুলো চৌম্বক ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে। এ নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের একটু রসায়ন ঘাটতে হবে। এ নিয়ে বহু প্রবন্ধ একটু নেট ঘাটলেই পাওয়া যাবে।
কম্পিউটার মনিটর, টেলিভিশন স্ক্রিন কিংবা স্মার্টফোনের স্ক্রিন রঙিন করতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় টারবিয়াম ও ইউরোপিয়াম। এগুলোতে থাকা এফ‑ইলেকট্রনের কল্যাণেই তাদের এই ব্যবহার। আবার ইত্রিয়ামের ব্যবহার রয়েছে উচ্চ সক্ষমতার লেজারে। মূলত ইত্রিয়াম‑অ্যালুমিনিয়াম‑গারনেট বা ওয়াইএজি ব্যবহার করা হয়। আর এর সাথে যদি নিওডিমিয়ামকে জুড়ে দেওয়া হয়, তবে এর ব্যবহারিক বৈচিত্র্য বেড়ে যায় বহুগুণে। কী কী ক্ষেত্রে? স্টিল কাটা থেকে শুরু করে শরীরে ট্যাটু আঁকা–সবকিছুতেই এর ব্যবহার আছে। একইভাবে আরবিয়াম‑ওয়াইএজি লেজার ব্যবহার করা হয় চিকিৎসায় নানা ধরনের অস্ত্রোপচারের সময়।
ল্যানথেনামের ব্যবহার রয়েছে নাইট ভিশন গগলসে। আরবিয়ামের কল্যাণেই বাধাহীন ইন্টারনেট সেবা সারা দুনিয়ায় পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে তথ্যপ্রবাহের সঙ্গে আমরা যুক্ত, তা যে আলোক তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানো হয়, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১৫৫০ ন্যানোমিটার, আরবিয়ামও একই দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ বিকীরণ করে।
যে লেখাটি এখন কি‑বোর্ড চেপে লেখা হচ্ছে, সেই কম্পিউটার হয়তো এভাবে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতই না, যদি বিরল খনিজের নানামাত্রিক ব্যবহার না করা হতো। ১৯৪৫ সালে বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রাম্যাবল কম্পিউটার ইনিয়াকের ওজন ছিল মোটামোটি চারটি হাতির সমান। সেই কম্পিউটার এখন ঘরে ঘরে শুধু নয়, কাঁধে বা পকেটে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষের সাথে।
এটি সম্ভব হয়েছে বিরল খনিজের বিস্ময়কর চৌম্বক শক্তির কারণে। অতি ক্ষুদ্রকায় চুম্বক এর মাধ্যমে তৈরি করা যায়, যা সেই বৃহদাকায় চুম্বকের সমমাত্রার কাজ করতে সক্ষম। ঠিক কী পরিমাণ শক্তি? ধরা যাক নিওডিমিয়াম‑আয়রন‑বোরন চুম্বকের কথা। এ ধরনের ৩ কেজির একটি চুম্বক অনায়াসে ৩০০ কেজির বেশি ওজন তুলতে পারে। বিশ্বের স্থায়ী চুম্বকের ৯৫ শতাংশের বেশি এই শঙ্কর দিয়ে তৈরি।
স্মার্টফোনের ভাইব্রেশন, হেডফোনের বা ইয়ারবাডসের শব্দ, হার্ড ডিস্কে তথ্য সংরক্ষণ কিংবা এমআরআই মেশিনে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরিতে এই নিওডিমিয়াম‑আয়রন‑বোরনের শঙ্করে গড়া চুম্বক ব্যবহার করা হয়। এর সাথে যদি আরেক বিরল খনিজ ডিসপ্রোসিয়াম জুড়ে দেওয়া হয়, তবে এই চুম্বক হয়ে উঠবে তাপসহ, যা ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন বিদ্যুচ্চালিত যানবাহনের মোটরে। তবে এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় সামারিয়াম‑কোবাল্ট ম্যাগনেট। এর ব্যহার রয়েছে উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে নানা ধরনের যানবাহন, জেনারেটর, স্পিড সেন্সর, রাডার সিস্টেম, কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটে।
আসা যাক বায়ুবিদ্যুৎকলের কাছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব ক্রমে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। এ ক্ষেত্রে উইন্ডমিল ও সোলার প্যানেল মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে। এ দুই ক্ষেত্রেই রয়েছে বিরল খনিজের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে আজকের যে হইচই, তার উন্নয়নেও বিরল খনিজ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রেও এর এফ‑ইলেকট্রন ও এফ অর্বিটালে থাকা ফাঁকা স্থান বিশেষ হয়ে উঠেছে। কারণ, এই ফাঁকা স্থানই এই মৌলগুলোকে বাড়তি তথ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা দিচ্ছে।