• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

মাছশূন্য হয়ে পড়ছে কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূল


নিনা আফরিন, পটুয়াখালী
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২২, ১০:৫০ এএম
মাছশূন্য হয়ে পড়ছে কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূল

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, পর্যটন কেন্দ্রের পলিথিন-চিপসসহ বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে ফেলা এবং সাগরে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় মাছশূন্য হয়ে পড়ছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূল। ফলে দাদনের জাঁতাকলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে এলাকা ছেড়েছেন অনেক জেলে। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অনেকে পেশা ছেড়ে এখন নতুন নতুন পেশায় ঝুঁকছেন। জাটকা সংরক্ষণ, কুসুম জাল ও ছোট ফাঁসের জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ, পর্যটন কেন্দ্রের বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা বন্ধ না করা হলে কুয়াকাটাসংলগ্ন সমুদ্র উপকূল মৎস্যশূন্য হয়ে যেতে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

মাছের বদলে পলিথিন

দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে সমুদ্রের সঙ্গে সম্পর্ক জাহাঙ্গীর মল্লিকের (৪৩)। বাপ-দাদার হাত ধরে সাগরে যাওয়া সেই ছোটবেলায়। রুপালি ইলিশকে ভালোবেসে এই পেশায় এলেও এখন বেরিয়ে এসেছেন এই পেশা থেকে। তিনি জানান, তার ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে যখন সমুদ্রে যেতেন, তখন শুধু ইলিশ শিকার করতেন তারা। বড় আকারের মাছ পেতেন কুয়াকাটাসংলগ্ন সমুদ্রের উপকূলীয় এলাকায়। তখন ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ তারা শিকার করতেন না। তাদের ইলিশের জালে লইট্টা, তুলার ডাডিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উঠত। সেসব মাছ নৌকায় না তুলে ফেলে দিতেন সমুদ্রের নোনা জলে।

স্মৃতি হাতড়ে জাহাঙ্গীর মল্লিক জানান, তারা মূলত খুটা জাল ফেলতেন। প্রতিটি গোনে গিয়ে মাছ নিয়ে আবার তীরে ফিরে আসতেন। কোনো কোনো সময় এমনও হয়েছে, এক গোনে যে মাছ পেয়েছেন, তার অর্ধেক তুলে বাকি মাছ আর তুলতে পারেননি। জাল কেটে দিয়ে আসা লেগেছে। এখন সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়।

সাগরের এত মাছ হারিয়ে গেল কোথায়—এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর জানান, পুরো উপকূলে এখন চর আর চর। আগে যেখানে ১০ বাম (এক বাম সমান পাঁচ হাত) পানি ছিল এখন সেখানে হাঁটুপানি। জাল ফেলার আর কোনো জায়গা নেই। চরের মাঝে মাঝে যে সরু চ্যানেল আছে, সেসব চ্যানেলে জাল পাতলে মাছ পাওয়া যায় না। মাছের বদলে জালে উঠে শুধু পলিথিন। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সব ধরনের পলিথিন, চিপস আর বিভিন্ন পণ্যের পলিথিন নির্বিচারে ফেলা হয় সাগরে। ভাসতে ভাসতে সেগুলো গভীর সমুদ্রে গিয়ে উঠে আসে জেলেদের জালে।

জাহাঙ্গীর জানান, পেশায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই টিকতে পারছেন না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আগে ইলিশের মৌসুম ছিল বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে এই সময়ের মধ্যে দুই দফা অবরোধ দেয় সরকার। প্রথম ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন থেকে এক মাস, পরে ৬৫ দিন। ২২ দিনের অবরোধ স্থানীয় জেলেরা সবাই মানে। কেউ সমুদ্রে মাছ শিকারে যান না। কিন্তু একই সময় ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে হাজার হাজার টন মাছ শিকার করে নিয়ে যান। অবরোধে দেশের জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটায়। কিন্তু ভারতের জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় ইলিশের উৎপাদন বাড়ে না। তার দাবি, মৌসুমের বিশাল একটা সময় মাছ ধরতে না পারা এবং আগের মতো মাছ না পাওয়ায় চার বছরে প্রায় ৬ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে তার। তাই বাধ্য হচ্ছেন পেশা পরিবর্তন করতে।

একই এলাকার আরেক জেলে জামাল আকন (৫২)। প্রায় ৪০ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু শেষে এক লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দুবাই চলে যান ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়।

দাদার হাত ধরে পেশায় এসেছিলেন মো. সোহেল (২৯)। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন পেশা ছাড়তে মরিয়া। তিনি বলেন, “সমুদ্রে যে মাছ পাই, তার শতকরা ১০ ভাগ আড়তদার কমিশন হিসেবে নিয়ে নেন। তাদের টাকা না দিয়ে কোনো উপায় নেই। গভীর সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝায় নৌকা ও জাল প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মেরামতের জন্য সময়-অসময়ে নগদ টাকার দরকার হয়। কোনো কোনো সময় শূন্য হাতে সাগর থেকে ফিরতে হয়। তখন বাধ্য হয়ে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিতে হয়।”

কেন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না

কুয়াকাটাসংলগ্ন সমুদ্র এলাকায় মাছ কমে যাওয়ার একাধিক কারণ বর্ণনা করেছেন স্থানীয় জেলেরা। জাহাঙ্গীর (৪৩), জামাল আকন (৫২), সোহেলসহ (২৯) একাধিক জেলে জানান, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে চর বিজয় নামক বিশাল এক চর। স্থানীয়দের কাছে যা হাইরার চর নামে পরিচিত। হাজার হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ চর শীতকালে পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। চলতি বছর এ চরে বৃক্ষ রোপণ শুরু করেছে স্থানীয় বন বিভাগ। পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত এ চরের কারণে রামনাবাদ মোহনাসহ প্রায় ১০টি নদীর মোহনায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর মূল চ্যানেল ভরে গিয়ে ছোট ছোট বিকল্প চ্যানেল দিয়ে পানি ওঠানামা করছে। জোয়ারের সময় এগুলো দেখা না গেলেও ভাটার সময় চরগুলো জেগে ওঠে।

জেলেরা জানান, উপকূলজুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে ওঠায় মাছের চলাচলের গতিপথ নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে আগে যেসব জায়গায় জাল পাতলে মাছ পাওয়া যেত, এখন সেসব স্থানে কোনো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা আরও জানান, পায়রা বন্দরের জাহাজ আসা যাওয়ার জন্য রামবনাবাদ চ্যানেলের মোহনা থেকে এক নম্বর বয়া পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার চ্যানেল ড্রেজিং করে নাব্যতা সংকট কাটানোর কাজ চলছে। সাগরের মাঝে প্রতিনিয়ত ড্রেজিং চলমান থাকায় এবং সাগর থেকে বালু তুলে আবার সাগরে ফেলায় মাছের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম পানি নদীতে ফেলায় রাবনাবাদ চ্যানেল অচিরেই মাছ শূন্য হবে বলে আশঙ্কা তাদের।  

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাজেদুল হক জানান, জেলেরা যে দাবিগুলো করেছে, এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা গবেষণা নেই। কয়েক মাস আগে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের একজন চায়নিজ প্রকৌশলী তাদের ক্যাম্পাসে গিয়ে রাবনাবাদ চ্যানেলে পানির নমুনা পরীক্ষা করিয়েছেন। বড় ধরনের কোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র লবণ পানির কোনো ঝুঁকিতে পড়বে কি না, সেটা ছিল পানি পরীক্ষার মূল কারণ।

ড. সাজেদুল হক আরও জানান, উপকূলের জেলেরা সাগরে মাছ না পেলেও ট্রলিংয়ে যারা মাছ শিকার করছেন, তারা কিন্তু মাছ পাচ্ছেন। এখন জেলেরা যে দাবিগুলো করছেন, এ বিষয়ে দ্রুত একটি গবেষণা করা প্রয়োজন। আসলেই পায়রা তাপবিদ্যুতের কারণে কোনো প্রভাব পড়ছে কি না, সেটা জানা দরকার। পাশাপাশি সমুদ্রে যে ছোট বড় চর জেগে উঠেছে, তার ফলে কী পরিমাণ মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে, তা-ও জানা প্রয়োজন।

পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, কুয়াকাটা সমুদ্রসংলগ্ন এলাকা থেকে কয়েক বছর ধরে ইলিশ মাইগ্রেট করে কক্সবাজার এবং ভোলা জেলাসংলগ্ন চর কুকরি মুকরি, পটুয়াখালীর সোনার চরের মোহনাগুলো দিয়ে পদ্মা মেঘনায় যাতায়াত করছে। এ কারণে কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মাছের পরিমাণ কম। তাছাড়া এই এলাকা থেকে মাছ অন্য এলাকা দিয়ে যাতায়াত করার ফলে পায়রা এবং রাবনাবাদ চ্যানেলে ইলিশের সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে যেহেতু ইলিশ এখান থেকে মাইগ্রেট করা শুরু করেছে ভবিষ্যতে অন্য সব মাছও এই নদীগুলো থেকে মাইগ্রেট করে অন্যত্র চলে যাবে। জেলেরা পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রকে দায়ী করছেন। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এলাকার পলিথিন এবং বর্জ্য সাগরে ফেলাকে দায়ী করছেন।

হঠাৎ করে মাছ কেন গতিপথ পরিবর্তন করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে এমদাদুল্লাহ জানান, এটা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। তবে স্বাভাবিক দৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সমুদ্র মোহনাগুলোতে চর পড়ে যাচ্ছে। চর বিজয়ের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন দৃশ্যমান। এটি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের বুকে চর জেগে ওঠার ফলে মাছের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। এক এলাকায় মাছ না পাওয়া গেলেও অন্য এলাকায় কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে। বছর শেষে দেখা যায় ইলিশের উৎপাদন প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

Link copied!