• ঢাকা
  • শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ঢাকার মতো এত কষ্টের শহর আমি আর একটাও দেখিনি


সিমু নাসের
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২১, ০৯:১৬ এএম
ঢাকার মতো এত কষ্টের শহর আমি আর একটাও দেখিনি

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি জন্মভূমির প্রতি প্রেম ও এর সৌন্দর্য বর্ণনায় খুবই চমৎকার একটি গান, আবেগী গানও বটে। বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি বলেই এটি আমাদের স্বপ্ন দিয়ে তৈরি। আর শৈশব আমাদের এখানে কাটে বলেই এটি নানান স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। গানটি শুনতে শুনতে তাই জন্মভূমির প্রতি আবেগে আমাদের চোখ ভিজে আসে। 

তবে গানের—আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি—এই একটি লাইনের মাঝে আমি শুধু একটা অংশ একটু যোগ করতে চাই।

জন্মের ওপর আপনার হাত নাই, কিন্তু মৃত্যুর ওপর মোটামুটি আছে। তাই কবির এই আকুতি আপনারও আকুতি হলে সমস্যা নেই। আমার ছোট্ট একটু আকুতি, জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানের পুরোটা সময়ই যেন আপনি শুধু দেশেই না কাটান। সুযোগ পেলে অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও অন্য কোনো জনপদে, অন্য কোনো নগরে কাটান, ঘুরে আসুন একটু। বইপত্র পড়া ও সিনেমায় দেখার বাইরে তাতে আপনি নাগরিক সুবিধা ও অধিকার বিষয়টা কী সে সম্পর্কে একটু হাতে-কলমে ধারণা পাবেন। 

নিরাপদ সড়ক, কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য একটু সুন্দর ব্যবস্থা, চিকিৎসা, পরিষ্কার পানি, গ্যাস, বিনোদনের জায়গার মতো খুবই বেসিক নাগরিক সুবিধা যে সরকার আপনাকে দিতে বাধ্য, এটা যে তার কর্তব্য, এটা যে আপনাকে অনুগ্রহ করে দেওয়ার জিনিস না সেটা মনে হয় আমাদের সবারই জানার একটু সময় হয়েছে। ঢাকা শহরের ভয়ংকর অমানবিক নাগরিক ব্যবস্থার মধ্যেও আমি অনেক মানুষকে সুখী হতে দেখেছি। আমি তাদের সুখ কেড়ে নিতে চাই না। শুধুই জানাতে চাই, এই কষ্ট আপনার প্রাপ্য নয়। 

পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের অন্তত দুই-আড়াইশো শহরের রাস্তায় হেঁটেছি-থেকেছি, ঢাকায়ও প্রচুর হেঁটেছি, সময় পেলেই হাঁটি, থাকি। কিন্তু নাগরিক সুবিধার দিক থেকে ঢাকার মতো এত খারাপ শহর, এত কষ্টের শহর আমি আর একটাও দেখিনি। এখন নতুন দেশের একটা নতুন শহরের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে আমি ইদানীং খুবই ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ি, আমার শুধু ঢাকার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আমার শীতের বিকেলের রাস্তার পাশের ধূলিপড়া বিবর্ণ পাতার কথা, কারওয়ান বাজারের স্যাঁতসেঁতে গন্ধের কথা, দুপুরের রোদে জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা ঘর্মাক্ত মুখগুলোর কথা, রাতের ঢাকা মেডিকেলের সিঁড়িতে-করিডোরে শুয়ে থাকা হতবিহ্বল মুখগুলোর কথা—শুধুই আমার মনে হয়, আমার নিজের শহরের পরিশ্রমী মানুষগুলো এত কষ্টে থাকা ডিজার্ভ করে না। অন্তত তাদের এটা জানা উচিত যে এটাই নাগরিক জীবন নয়। তাদের এই কষ্টের জন্য সে দায়ী নয়, সরকার দায়ী। 

বোগোতার খোলা রাস্তায় মধ্যরাতে শত শত মেয়ের হাসিঠাট্টায় ভরা আনন্দিত মুখ আমাকে আনন্দিত করে না এখন আর, এত কষ্ট দেয়, শুধুই মনে পড়ে আমার ঢাকার কথা, ঢাকার রাস্তায় গভীর রাতে কেন মেয়েরা হাসতে হাসতে হাঁটতে পারে না, কর্মব্যস্ত দিনের শেষে ফার্মগেটে কেন শত শত মেয়েকে অসহায় মুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, অসহ্য শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়ে কেন তাদের বাড়ি ফিরতে হয়। কেন দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়টাতে ফি বছর নতুন নতুন বিল্ডিং উঠলেও ছাত্রদের এখনো সেই গণরুমেই থাকতে হয়, কেন শীতের রাতে বারান্দায় থাকতে গিয়ে একটা ছাত্রকে নিউমোনিয়ায় মারা যেতে হয়। সাও পাওলোর ঝা চকচকে বাসে উঠে আমার শুধুই মনে পড়ে আমাদের ছালবাকলা উঠে যাওয়া আবাবিল-বিহঙ্গ-তরঙ্গ টাইপের বাসগুলোর কথা, তাদের এলোমেলোভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কথা, ধাক্কা দিয়ে বাসের যাত্রীকে ফেলে দিয়ে পিষ্ট করার কথা, তারপর সেটা নিয়ে সরকারের সাফাই গাওয়ার কথা। 
   
এসবকে আমরা আমাদের নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছি, শহর এমনই লড়াই করার, কষ্ট করার জায়গা। হাঁপ ছেড়ে একটু নিশ্বাস নিতে চাইলে গ্রামে চলে যেতে হবে, নগরে এই ব্যবস্থা থাকতেই পারে না—কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদরাও আমাদের এই ধারণাই দিয়েছেন। কিন্তু সেটা যে সম্ভব সেটা দেখার জন্য, জানার জন্য আপনার একটু ঘুরে দেখা উচিত। তাহলে অন্তত আমাদের এই বোধটুকু আসবে যে, রাজনীতিবিদরা আমাদের কী ধরনের মৃত নরকে রেখেছেন। যখন কেউ একজন প্রতিবাদী গলায় বলবে, ওহে সরকার বাহাদুর, আমার এই শহরটাকে নরক বানিয়ে আবার বড় বড় কথা বলছেন কেন—তখন কেউ যেন তাতে আর দ্বিমত করতে না পারে।  

ঢাকা যে একটা নরক এটা কিন্তু বিদেশ বিভূই ঘুরে আসা রাজনীতিবিদরা খুব ভালো করেই জানেন। তারা জানেন এর চেয়ে ঢের ভালো ব্যবস্থা আছে, তাই তারা তাদের ছেলেমেয়েদের কিন্তু কখনোই ঢাকায় রাখতে চান না। সিঙ্গাপুর, কানাডা, ইউরোপ, আমেরিকায় বাড়ি-গাড়ি কিনে পাসপোর্ট বাগিয়ে সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এমনকি তারা এটাও জানেন যে শেষ নিশ্বাস ফেলার জন্যও এই ঢাকা শহরটা ভালো না। তাই সারা বছর আমাদের জাতীয়তাবাদী—এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি—গাইতে বলে নিজেরা মরতে আসেন মাউন্ট এলিজাবেথে। আর আমার গ্রাম থেকে আসা প্রতিবেশী অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের সিঁড়িতে চাদর বিছাতে বিছাতে চোখের জল ফেলেন। উনি ধরেই নেন যে এই সিঁড়িই তার প্রাপ্য, এর বেশি কিছু নয়, তার কোনো অভিযোগও নেই। আমি অসহায়ভাবে চারদিকে শতশত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি—এই শহর আমাদের প্রত্যেককে চাওয়া-পাওয়া-ভাবনায় কেমন ঊনমানুষে পরিণত করেছে।

Link copied!