আইপিএল নিলামে তিনি ‘আনসোল্ড’! বাংলায় লেখা যায় ‘অবিক্রীত’। খুব রুক্ষ ও ক্যাটকেটে শোনালেও সোজাসুজি লিখে ফেলা ভালো; তাকে কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনতে চায়নি। কেনার আগ্রহ দেখায়নি। তিনি সাকিব আল হাসান। এ দেশের মানুষের কাছে উত্তুঙ্গ আবেগে মোড়ানো এক নাম। আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়েও এই মুহূর্তে তিনি শীর্ষ অলরাউন্ডারদের তালিকায় দুই নম্বরে। কিন্তু এবার আইপিএলে তার কোনো দল জুটল না! এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে এ দেশের ক্রিকেটানুরাগীদের মনে।
অন্ধ জাতীয়তাবাদ আর চরম আবেগ জড়ানো মন যা বলে, ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা বলে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাকিব আল হাসান আরাধ্য এক নাম। টানা বেশ কবছর ধরে তিনি আইপিএলে খেলছেন। সেই মৃগয়া ভূমিতেই তার স্বপ্ন মরীচিকা হয়ে হারিয়ে গেল! তার অনুরাগীরা আশাহত, ক্ষুব্ধ হতেই পারেন। আবার অনেকে তার দেয়ালের লিখন পড়তে শুরু করেছেন। বলতে শুরু করেছেন; সাকিবের উচিত মনপ্রাণ দিয়ে ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা দেশের হয়ে খেলা। আইপিএলে দল না পাওয়া সাকিবের মতো পেশাদার ক্রিকেটারের আত্মমর্যাদায় এবং একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসে একটা ধাক্কা। তবে সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। বিপিএলে ভালো খেলছেন। ব্যাটে-বলে দলকে টানছেন। ম্যাচ জেতাচ্ছেন। কিন্তু আইপিএলে থেকে গেলেন উপেক্ষিত!
তাহলে আইপিএল কি অন্য গ্রহের ক্রিকেট! অনেকটা তাই। ফরম্যাট টি-টোয়েন্টি। কিন্তু ব্র্যান্ডটা ভিন্ন। যেখানে টেকনিক, স্কিল, ফিটনেসের চেয়ে বড় করে দেখা হয় আগ্রাসী মেজাজকে। ফ্র্যাঞ্চাইজি তাকেই দলে রাখবে, যিনি শেষ ওভারে জয়ের জন্য ছত্রিশ রান দরকার হলেও করে দিতে পারবেন। মারদাঙ্গা মেজাজ আর বেসবল স্টাইলে ব্যাট চালালেই হলো। মালিকরা তেমন ক্রিকেটারের ওপরই বাজিটা ধরবেন নিলামে।
সত্যি কথা হচ্ছে, সাকিবের ভেতর ওই মারদাঙ্গা মেজাজের ঘাটতি আছে। পরিসংখ্যানও তার পক্ষে জোরালোভাবে কিছু বলছে না। ৭১ ম্যাচ খেলেছেন। ৫২ ইনিংসে রান করেছেন ৭৯৩। গড় ১৯.৮২। স্ট্রাইক রেট ১২৪. ৪৯। বল হাতে ৭০ ইনিংসে নিয়েছেন ৬৩ উইকেট। গড় ২৯ ,১৯। মানছি পত্রিকায় তার পারফরম্যান্স নিয়ে লিখে ফেলা যত সহজ, বাইশ গজে তার কাজটা অনেক কঠিন। শারীরিক-মানসিক দক্ষতার তুঙ্গে থাকা একজন ক্রিকেটারকে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এমনিতেই রগড়ে নেয়, তার ওপর এপ্রিলে আইপিএল! ফিটনেসের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়! তা ছাড়া বয়সও এখন আর সাকিবের পক্ষে নেই। ৩৪ বছর ৩২৭ দিন বয়সী সাকিবকে নিয়ে বাজি ধরার আগে এখন দুবার ভাববেন মালিকরা। এবং তারা ভেবেছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে এর মধ্যে আবার ক্রিকেটীয় ষড়যন্ত্র না খোঁজাই ভালো।
সাকিব আনসোল্ড। কিন্তু বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমানকে ঠিকই দিল্লি ক্যাপিটালস নিয়েছে। তারও ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা আছে। এমনিতে আইপিএলে বাঁহাতি পেসারের সংখ্যা খুব বেশি নেই। আর মোস্তাফিজ দুদিকেই বল কাট করাতে পারেন। চার ওভার ভালোভাবেই করে দিতে পারবেন। বয়সও ২৬ বছর। এ পর্যন্ত আইপিএলে ৩৮ ম্যাচে ৩৮ উইকেট নিয়েছেন এই বাঁহাতি। তাকে কেনার আগে তাই খুব বেশি ভাবতে হয়নি দিল্লির কর্তাদের।
সাকিব আনসোল্ড আর ফিজ সোল্ড কেন, এগুলো একেবারেই প্রাথমিক বিশ্লেষণ। তবে আইপিএলের গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে সাকিব আল হাসানের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাইলে তা ভুল প্রমাণের ট্যালেন্ট-টেকনিক-অভিজ্ঞতা তাঁর আছে।
আর আইপিএলে না খেললে যে সাকিব আল হাসানের ব্যাংক ব্যালান্সে খুব বেশি টান পড়বে, তা-ও না। দেশের বিপণন বাজারে এখনো 4তিনি নাম্বার ওয়ান ব্র্যান্ড। এখনো পণ্য বিপণনের জন্য দামি মডেল তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে আলোচিত-সমালোচিত এক বড় তারকার নামও সাকিব আল হাসান। সচেতন বা অচেতনভাবে তাকে অনুসরণ করা লোকের সংখ্যা গোটা বাঙালি সমাজে অনেক।
টেকনিক্যালি সমস্যাকীর্ণ হয়ে পড়া ক্রিকেটার সাকিব নন। ফর্মহীনও নন। তবে ধীরে ধীরে ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চলে আসছে। বয়স সেই ঘণ্টাই বাজাচ্ছে। ক্রিকেটীয় স্কিল দিয়ে আরও কয়েক বছর হয়তো অনায়াসে পার করতে পারবেন তিনি। কিন্তু একটা সময়ে ওই স্কিল দিয়ে বয়সকে বাউন্ডারি লাইনের ওপারে ফেলা যাবে না।
আইপিএলে সাকিব আল হাসানকে না নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক কিছু লেখা হচ্ছে। তাতে নিশ্চিত, সাউন্ড বাইটনির্ভর টিভি সাংবাদিকরা বুম হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে। প্রিন্ট মিডিয়ার লোকজন তার সামনে টেপ রেকর্ডার অন করবেন। সাকিব আপনি কী উত্তর দেবেন জানি না। তবে ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি, আইপিএল তো আপনার জন্য চুক্তিভিত্তিক একটা চাকরিই ছিল। যে চুক্তি নবায়ন করার আগে করপোরেট জগৎনির্ভর ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকরা দেখেছেন আপনার বয়স, মোট রান, গড়, স্ট্রাইক রেট ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত করপোরেট নিয়ম মেনে নতুনদের পেছনে বিনিয়োগ করা ভালো, সে পথেই হাঁটলেন তারা। আর আপনার চুক্তিকে নবায়নযোগ্য মনে করলেন না। তবে ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতা বিক্রির জন্য আপনার সামনে কিন্তু পড়ে থাকল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বহু ভেন্যু। আর সেখানে আপনার স্টেটমেন্টের হেডলাইন হতে পারে পারফরম্যান্স।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক