শ্রীলঙ্কা খুব সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়, যখন জানা যায় শ্রীলঙ্কান সরকার চীনা সিনোফার্মের প্রতিটি কোভিড-১৯ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন ডোজ ১৫ ডলার করে কিনেছে, যেখানে বাংলাদেশ তা ১০ ডলারে পেয়েছে। বিশ্লেষকরা তখন বলাবলি করেছেন যে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর এতটা নির্ভরশীল যে চীনের পক্ষে শ্রীলঙ্কাকে যেকোনো শর্তে রাজি করানো সম্ভব। প্রশ্ন হলো, কী এত নির্ভরতা যে কোনো একটা পণ্যের দরদাম করারও উপায় থাকে না!
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের এখন অগাধ ক্ষমতা। তিনি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। সংবিধান তাঁকে বিস্তর ক্ষমতা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীদের তিনি নিয়োগ দেন। ফলে তাঁরা সবাই তাঁরই আজ্ঞাবহ থাকেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকশে ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে পাঁচ বছরের জন্য শাসনভার হাতে নিয়েছেন। তাঁর বড় ভাই মহিন্দ্রা রাজাপাকশে, যিনি আগে একসময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও এক ভাই, বাসিল রাজাপাকশে পেয়েছেন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। অন্যান্য আত্মীয়স্বজনও পিছিয়ে নেই। যে যেখানে পেয়েছেন জায়গা দখল করেছেন। তাঁদের ভাতিজি, নিরুপমা রাজাপাকশে ক্ষমতাধর বংশ হিসেবে বরং তাঁদের সম্মান বাড়িয়েছেন যখন সম্প্রতি প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপারে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ অর্জনের তালিকায় নিজের নাম উঠিয়েছেন। শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট অবশ্য এই গোমর প্রকাশের পরপরই দুর্নীতি দমন সংস্থাকে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু রাজাপাকশে পরিবার নয়, তাঁর নিকটজনরাও এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই। মুদ্রা অর্থনীতির বিপর্যয়ের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এক মাস আগে সরে গেছেন। নতুন গভর্নর হিসেবে এসেছেন সাবেক গভর্নর এবং বর্তমান সাংসদ অজিত নাইভ্রাদ কাব্রাল। ২০০৬ থেকে ২০১৫ কাব্রাল আগে যখন গভর্নর ছিলেন, তখন তা ছিল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। সুতরাং সেই নিয়োগে পেনশনের কোনো বিধান থাকার কথা না। কিন্তু এবারে নতুন করে গভর্নর হয়ে মুদ্রা অর্থনীতির হাল ধরার আগে তিনি তাঁর আগের মেয়াদের নিয়োগের বিপরীতে গভর্নর হিসেবে নিজেই নিজের পেনশন মঞ্জুর করেছেন। বিরোধী ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেতা আরিয়াবান্সা দেশনায়েকে কাব্রালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করে দিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় বরাবরই বেশি। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক একসময় শ্রীলঙ্কাকে উচ্চতর উন্নয়ন সূচকে উন্নীত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গোতাবায়ার অভিষেকের পর থেকেই উন্নয়ন সূচক নামতে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকে। বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও সরকারি কোষাগার এখন প্রায় খালি। এই বছর জুলাই মাসে এক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে দুই মাসের আমদানি মূল্য পরিশোধ করার অবস্থা নেই।
গোতাবায়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। ভোগ্যপণ্যের দাম ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করেছেন। সরকার আমদানির ওপর বহু রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অন্যদিকে মহামারির কারণে বহু রকম কর ও খাজনা মওকুফ করেছে বা কমিয়ে দিয়েছে। সে জন্য রাজস্ব আয় কমেছে। আবার ২০১৯ সালের বোমাবাজিতে ২৬৭ জন পর্যটক হত্যা ও পরবর্তীকালে মহামারির কারণে পর্যটন আয় কমেছে। পর্যটন খাত স্বাভাবিক হতে কম করে হলেও দু-তিন বছর লাগবে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা কৃষি খাতে একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কৃষি উৎপাদনকে পুরোপুরি জৈবিক করার মানসে রাসায়নিক সার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। উদ্যোগটি সফল হলে শ্রীলঙ্কা ভূয়সী প্রশংসা পেত। কিন্তু হঠাৎ করে এই নীতি প্রয়োগ করায় কৃষি উৎপাদন কমে গেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আমদানি পণ্য চা রয়েছে। চায়ের উৎপাদন কমে গেলে রপ্তানি আয় কমে যাবে। খাদ্য উৎপাদন কমে গেলে আমদানি করতে হবে। তখন আবার উল্টো বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে। সুতরাং রাসায়নিক সার আমদানি না করে যে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাঁচবে, খাদ্য আমদানি করে বা চা রপ্তানি কমিয়ে তার চেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে।
হিসাব খুব জটিল। সামনের বছরগুলোতেও বড় অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে হবে। যখন এভাবে সব উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছেই তখন বিকল্প কী! পুনরায় চীনের দ্বারস্থ হওয়া? হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর এরই মধ্যে চীনের কাছে বন্ধক হয়ে গেছে। এ রকম হুমকি হয়তো বাড়তেই থাকবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো দ্রুত উন্নয়নের সিঁড়ি ধরার জন্য শ্রীলঙ্কার মতো বড় আকারের ব্যয় করে যাচ্ছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম না। আমাদের এখনো মোটা মজুত আছে। বৈদেশিক মুদ্রার বড় দুই জোগানদার– রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে আশু হুমকি নেই। প্যান্ডোরা পেপারেও বাংলাদেশের নাম নেই। রাজাপাকশেরা বংশানুক্রমে দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার শাসন বলয়ে আছেন। অবকাঠামো উন্নয়ন উন্নয়নশীল দেশের জন্য অবশ্যই জরুরি। তবে তা বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের সঙ্গে আনুপাতিক গতিতে এগুলে সংকটের ভয় থাকে না।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত
                
              
																                  
                                                        
                                                        
                                                        
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































