• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

বাজেট বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ


নূর মামুন
প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২২, ০৮:৪৯ পিএম
বাজেট বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ

‘ঘূর্ণায়মান চক্র’ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় উৎস। যে দেশের চাকা যত বেশি ঘোরে, সে দেশের অর্থনীতি ততই মজবুত হয়। বৈশ্বিক মহামারি করোনার নির্দয় কশাঘাতে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত। অনেক দেশেই থেমে গেছে ঘূর্ণাবর্ত। বাংলাদেশেও হয়েছে তাই। মানুষের পায়ের পরিধি লকডাউনে দীর্ঘদিন আটকে ছিল। বন্ধ ছিল যানবাহন, জলযান। বিমানও ঠিকমতো ওড়েনি। কলকারখানায় ছিল তালা।

এত প্রতিকূলতা শেষে মানুষের জীবন ও জীবিকার সব রাস্তা আবার চালু হয়। কিন্তু নতুন করে সারা বিশ্বে আরেক দৃশ্যমান মহাসংকট দেখা দেয়, তা হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

এ যুদ্ধের ফলে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তেল-গ্যাসসহ দাম বেড়েছে প্রায় প্রতিটি পণ্যের। অনেক দেশে কমেছে মুদ্রার দাম। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। সব মিলিয়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার মান কমেছে প্রায় ৭ টাকা ২০ পয়সা। রপ্তানিতে বেড়েছে খরচ। চাপ পড়েছে রিজার্ভের ওপর। সব মিলিয়ে প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যে।

বাজারে নেই টাকার স্বাভাবিক প্রবাহ। ফলে থেমে গেছে টাকা ও সম্পদের হাতবদল। মানুষের রুটি-রুজির পথ কায়িক শ্রমে এসে ঠেকেছে। কায়িক শ্রমে আর যা-ই হোক না কেন, সমৃদ্ধি আনতে পারে না। সমৃদ্ধি না এলে পিছিয়ে পড়ে অর্থনীতি।

এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে ৫১তম জাতীয় বাজেট। এই বাজেট কোনো স্বাভাবিক সময়ের নয়। এটা একটি চরম দুঃসময়ের কঠিনতম বাজেট।

এবারের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা হতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। যেখানে বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।

সেই হিসেবে এটা ঘাটতি বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকবে। স্বাভাবিক সীমার ঘাটতি বাজেট ক্ষতির চেয়ে সুবিধাই বেশি দেয়। এই আলোকে বর্তমান বাজেটের ঘাটতি দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়’ কবিতাটি পড়িয়ে ছেড়েছে। কারণ, রাষ্ট্রের ব্যয়ের খাত অনেক হলেও আয়ের খাত একেবারেই সীমিত। আয়ের খাত মাত্র কয়েকটি। যেমন প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর, করবহির্ভূত আয়। দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ প্রকৃত ব্যয়ের খাত হলেও এই খাত থেকে আসা টাকা প্রকৃত কোনো আয় নয়।

আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হলো প্রত্যক্ষ কর। এই উৎসের মধ্যে আছে ব্যক্তির আয়কর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর কর (করপোরেট কর), দান কর, উত্তরাধিকার কর, যানবাহন কর, মাদক শুল্ক, ভূমি রাজস্ব ইত্যাদি। করোনা মহামারির কারণে প্রত্যক্ষ করে চাপ দেওয়ার সুযোগ নেই। এসব উৎস থেকে আয় বাড়াতে গেলেই অসন্তোষ বাড়বে।

এরপরের খাত হলো পরোক্ষ কর। এই খাতে আছে আমদানি কর, আবগারি শুল্ক, ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদি। এসব খাতও সীমিত হয়ে গেছে। অপর খাত হলো করবহির্ভূত আয়। এই খাতে আছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভ, সুদ, সাধারণ প্রশাসন থেকে আয়, ডাক-তার-টেলিফোন থেকে আয়, পরিবহন আয়, জরিমানা ও দণ্ড থেকে আয়, ভাড়া, ইজারা, টোল ও লেভি ইত্যাদি। এসব খাতের সীমিত উৎস খোলা থাকলেও সিংহভাগই প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ।

এ অবস্থায় স্বল্প ঘাটতির এই বাজেট সরকারের দক্ষতার পরিচয় তুলে ধরেছে। এই ঘাটতি বাজেটেও দেশের ধনী-গরিব, দুস্থসহ সব শ্রেণির মানুষের জন্য বড় সুবিধা দিতে না পারলেও কাউকে বঞ্চিত করেনি।
একটি জাতীয় বাজেটের প্রথম গুরুত্ব থাকে কর্মসংস্থান। এই বাজেটে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাত সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্ধারিত শহরগুলোতে হাসপাতাল স্থাপন করলে কর অবকাশের সুযোগ দেওয়া হবে। শিক্ষা খাত ও কৃষি গুরুত্ব পেয়েছে। অবহেলিত সমাজের দিকেও লক্ষ রাখা হয়েছে।

মহাসংকটের মধ্যেও এই ধরনের বাজেট প্রশংসার দাবি রাখে বৈকি। সব মিলিয়ে বলা যায়, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে এবারের বাজেট।

বাজেট যত ভালোই হোক না কেন, বাজেট নিয়ে বিরোধীদের হইচই করার রেওয়াজ সব সময়ই ছিল। এবারও তাই হবে, হোক। কিন্তু বাজেটের সাফল্য নির্ভর করে বাস্তবায়নের ওপর। প্রস্তাবিত বাজেট কতটা দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমরা আশা করব দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে কার্যকর করা হবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট।
 

লেখক : সাংবাদিক

Link copied!