• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দিন যায় তবু


শামীম আজাদ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩, ০৪:২৯ পিএম
দিন যায় তবু

মানুষ চলে গেলে তার পালক রেখে যায়
জ্ঞাতি চিহ্ন দেখে দেখে পরশ বুলায়।

এ আমারই একটি চূর্ণকবিতা। আর এর সর্বোচ্চ উপলব্ধি হয় আমার এই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র তারকা শিক্ষক শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ রাশিদুল হাসান, শহীদ আনোয়ার পাশা ও শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। ভাবা যায়! এক নয়, দুই নয়, চার চারজন রত্নতুল্য মানুষকে আমি অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছি। তাঁদের বচন, চলন, দর্শন, আচরণ ও সংস্কৃতির পাঠ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি একেবারে পদতলে বসেই। ঠিক সন্তান যেমন তার পিতার পদতলে।

দিন যায় কথা থাকে। অর্ধশতাব্দী চলে গেল, তবু ১৪ ডিসেম্বর এলেই আমি অন্যরকম হয়ে যাই। এক অপ্রাপ্ত বয়সের মানুষ হয়ে যাই। ১৯৭১-এ মাসেই আমার পিতৃস্থানীয় যে শিক্ষকদের হারিয়েছি। আহ! তাদের কারও স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারেনি। তাদের হত্যা করা হয়েছে।  মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে তাঁদের বাংলাদেশের কপাল থেকে কেড়ে নিয়েছে কিছু কুলাঙ্গার। ডিসেম্বর এলেই তাই ক্ষুব্ধ, আহত ও ভারাক্রান্ত থাকি। সবকিছুতেই তাঁদের কথা মনে পড়ে। আমরাইতো তাদের জ্ঞাতি। তবে কি এ তাঁদের ফেলে যাওয়া পালকস্পর্শের কারণেই?

শয়তানরা কী মর্মান্তিকভাবে চাপাতির আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করেছে আমার পিতৃসম শিক্ষকদের। আমি ভুলিনি। আমি ভুলব না। এমনকি তাঁদের যাতে শনাক্ত না করা যায় তার জন্য নরাধমরা তাঁদের দেহকে করেছে খণ্ডিত। রাখেনি কোনো অবশেষ।

এখনো আমার কানে বাজে, রায়ের বাজার ঘুরে আসা অনুজপ্রতিম কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, আমার যুদ্ধের ভাই বুলবুলের চিৎকার। ‘আপা গো, তাঁরা নিখোঁজ না ... ওরা মাইর‍্যা ফেলছে আপনার স্যারদের।’ বুলবুলের সারা শরীর থর থর কাঁপছিল; আর কাঁপছিল তার হাতের এসএলআর। সোবহানবাগের ফ্ল্যাটের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে আমার ক্রন্দনে। আব্বা-আম্মা ছুটে এসেছেন।

স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই বুলবুলরা হঠাৎ করে একবস্ত্রে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে উধাও হওয়া স্যারদের সবগুলো বন্দীশালা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কোথায় আমাদের স্যাররা? মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশিদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, আর গিয়াসুদ্দিন স্যার? কিন্তু এখন কী বলছে সে? বিশ্বাস হচ্ছিল না। মৃতদেহগুলো শনাক্ত কিংবা আলাদা করা কঠিন। ছিন্নভিন্ন দেহ আর চেনা যায় না।

বুলবুলের সেই হাহাকার এত বছর পরেও সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দেয়। প্রয়াত সে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান বুলবুল এখনো আমার এই বিদেশের ঘরে এসে চৌচির করে। আমি সেই ভয়াবহ বধ্যভূমিতে জেগে উঠি। দেখি, সেই চাপাতি ও ছুরির কোপে চোখ তোলা, আঙুল কাটা, পেছনে হাতবাঁধা আমার স্যারদের মৃতদেহ।

সাধারণ বাঙালি বাবার মতোই ঘরে তাঁরাও গেঞ্জি পরতেন, লুঙ্গি পরতেন। তাঁদের সেই সব ঘরে পরার জামা বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় ফাড়া। চূড়ান্ত অবহেলায় পড়ে আছেন ভেজা মাটিতে। জল চুইয়ে যাচ্ছে ইট মাটি কুটো আর পরিত্যক্ত দেহ ঘিরে। বাংলার সোনার সন্তানগণ মাটিতে পড়ে আছেন। এ দৃশ্য মনে করলে আমি এখনো মরে যাই।  

যারা তাঁদের এত কষ্ট দিয়ে, ঘা দিয়ে হত্যা করেছে তারাও তো ছিল স্যারদের সরাসরি ছাত্র! তবে কি করে তারা তা পারল? তারাও তো স্যারদের মতো সাধারণ এক বাবার সন্তান ছিল! স্যারদের গায়ে অস্ত্র ব্যবহারের আগে কি একবার ও সেই শয়তানদের চোখে নিজের বাবার মুখ ভেসে আসেনি? আসেনি কোনো একজনও বয়সী নির্লোভ, নরম মানুষের অবয়ব?

আমার বিদ্যাদেবগণ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ। ঘাতকদের ঘাতক ভাবেননি। স্যার বলে সম্বোধন করায় ছাত্র মনে করে পরম বিশ্বাসে হাত ধরে উঠে গেছেন মরণ শকটে। কেবল ছাত্র বলেই পিতা যেমন সন্তানের ওপর নির্ভর করেন, বিশ্বাস করেন তেমনি তাঁরা মঈনউদ্দিন গংয়ের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, হাত ধরে ছিলেন ও নির্ভর করেছিলেন।

স্পষ্ট মনে আছে  রাশিদুল হাসান স্যারের কথাগুলো। যেদিন বাবলী আর আমি গোপনে মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের সতর্কবাণী পৌঁছে দিতে দেখা করেছিলাম তাঁর সঙ্গে। ‘স্যার এখন আর আপনাদের নিজের বাসায় থাকবেন না’। স্যার হেসে বলেছিলেন, ‘কী বল! ওরা আমাদের ছাত্র না। আর আমাকে একবার ধরে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে না?’

হায়রে সন্তের মতো শিক্ষক আমাদের। তোমরা সন্তানতুল্য ছাত্রদের সেদিন কেন করোনি অবিশ্বাস? এখন মনে হয় তারাই যেন আজকের বাংলাদেশের এই দলিত লাঞ্ছিত, দেশদেহ। আর আমরা মগজবিহীন বলেই সেই পরাজিতদের শক্তিরই আমরা করছি শুশ্রূষা। 

লেখক : কবি, শিক্ষাবিদ

Link copied!