তোমার আগমনের অপেক্ষায় একটি অবহেলিত জাতি প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিল দীর্ঘকাল। অতঃপর তুমি এলে গ্রাম কাঁপিয়ে, রাজপথ দাপিয়ে, রেসকোর্সে ঝড় তুলে। তোমার আগমনে স্বাধীনতা এলো, লাল-সবুজের পতাকা এলো, এলো নতুন স্বপ্ন—নতুন দেশ, আমার সোনার বাংলাদেশ।
যাঁর জন্ম না হলে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হতো না। যাঁর জন্ম না হলে একটি অবহেলিত জাতি মুক্তির দিশা খুঁজে পেত না। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়া থেকে সমগ্র বিশ্বে যিনি কম্পন তুলেছিলেন বজ্রকণ্ঠে। যাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার মুক্তিকামী জনতা।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির বীজ বপন হয়েছিল যাঁর হৃদয়ে। অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সব সময়। জেল-জুলুমকে তোয়াক্কা না করে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন মানুষের কল্যাণে। প্রতিবাদে-চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছেন সর্বস্তরের মানুষকে। যাঁর সংগ্রামী জীবন তরুণ প্রজন্মকে আলোর পথ দেখায়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।
সেই মহামানবের আজ জন্মদিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়।
শৈশবেই রাজনীতির বীজমন্ত্র উপ্ত হয়েছিল তাঁর হৃদয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তখন মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কলকাতায় ফরিদপুরবাসীদের একটি সংস্থা ‘ফরিদপুরস্থ ডিসট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশন’র সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে কলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরোধ তৎপরতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ জানান। খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
এভাবেই ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে জায়গা করে নেন শেখ মুজিব। তবে শুধু নেতা হওয়াই তাঁর লক্ষ্য ছিল না। তিনি মানুষের কথা শুনতেন। বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। উদারতার পরিচয় দিতেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে মানুষের কল্যাণ কামনা করতেন। তারই ফলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অশেষ অবদান রাখতে পেরেছিলেন। ইতিহাসের মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন শাসক হিসেবেও কম সময়ে যে সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন, তা বিশ্বের জন্য ঈর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বলী হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার শহীদ হতে হয় তাঁকে। আমাদের যাবতীয় অর্জন সেদিন ম্লান হয়ে যায়। অকৃতজ্ঞ জাতিতে রূপান্তিত হই আমরা।
তারপরও চক্রান্ত থেমে থাকেনি। ক্ষমতার পালাবদলে বঙ্গবন্ধুর সফলতার ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। অনেক নাটক, গালগল্প সাজিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু হিমালয়সম মহান ব্যক্তিত্বকে কোনো চক্রান্তই নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বিশ্বে তিনি অপ্রতিরোধ্য নেতা হিসেবে নিজের স্থান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সারা বিশ্ব তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডে ধিক্কার জানিয়েছে। অবহেলিত মানুষ বুকফাটা চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
জীবনের বেশির ভাগ সময় জেলে কাটানো এই মহান পুরুষের ইতিহাস আজও জ্বলজ্বল করছে। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করেছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদ্যাপন করেছে। দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব এখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হারিয়ে যাননি। মুছে যায়নি তাঁর সৎকর্ম। পথভ্রষ্ট সেনাদের ঔদ্ধত্য সেদিন আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি রক্তাক্ত হয়েছে। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বাংলাদেশের হৃদয়। তারপরও বাংলাদেশ উঠে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ সময় পর আবারও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের হাল ধরেছে।
গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যতগুলো বই রচনা করা হয়েছে, এত বই বিশ্বের অন্য কোনো নেতার জন্য রচিত হয়নি। আমার মনে হয়, সরকারি উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহ করে যদি গিনেস রেকর্ডের জন্য আবেদন করা হয়, তাহলে তা বিশ্বরেকর্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
তবু একটি ক্ষত আমাদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আজ তাঁর জন্মদিনে আনন্দের পাশাপাশি সেই দিনের সেই ক্ষত যন্ত্রণা দেয়। আশা করি, তরুণ প্রজন্ম সেই ক্ষতকে নিশ্চিহ্ন করবে, এ আমার বিশ্বাস। দেশদ্রোহী ও স্বার্থবাদী রাজনীতিকে তারা ধিক্কার জানাতে শুরু করেছে। আজকের শিশুরাও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাবে। তাঁকে ভালোবাসবে। কেননা, জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুও শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।
বঙ্গবন্ধুর আগমন দিবসে আজ এই প্রার্থনাই করি, স্বাধীন বাংলাদেশ সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক। আর কোনো অপশক্তি যেন সেই সুনাম নষ্ট করতে না পারে। জ্বলজ্বলে ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকুক বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম। কেননা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন সমগ্র বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে।
শুভ জন্মদিন মহান নেতা শেখ মুজিব। আপনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। কামনা করছি, আপনার হাতে গড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জনগণের সমৃদ্ধি অর্জিত হোক। জয় বাংলা। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।