• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মুহররম ১৪৪৫

শুধু মেট্রোরেল নয়, চাই সমন্বিত পরিকল্পনা


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২১, ০৩:৪০ পিএম
শুধু মেট্রোরেল নয়, চাই সমন্বিত পরিকল্পনা

বাংলাদেশ এখন এক নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে। মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হতে আগামী বছরের ডিসেম্বর লেগে যাবে। কিন্তু পরীক্ষামূলক হলেও মেট্রোরেলে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচলে মানুষের মধ্যে বিপুল উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। সবাই ভাবছেন, মেট্রোরেল চালু হলেই আর যানজট থাকবে না। অবশ্যই মেট্রোরেল স্থবির ঢাকাকে কিছুটা সচল করবে। কিন্তু মেট্রোরেলই যানজটের নিদান, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। অতীতেও আমরা দেখেছি, একেকটি ফ্লাইওভারের জন্য আমাদের অধীর অপেক্ষা। ভেবেছি, এই ফ্লাইওভারটি হলেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু একের পর এক ফ্লাইওভার চালু হলেও যানজট পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। তাহলে কি ফ্লাইওভারে কোনো লাভ হয়নি? এই ধারণা কিন্তু ঠিক নয়। ফ্লাইওভারগুলো না হলে ঢাকা পুরোপুরি অচল শহরে পরিণত হতো।

আসলে পরিস্থিতি হলো, ঢাকায় প্রতিনিয়ত লোকসংখ্যা বাড়ছে, যানবাহন বাড়ছে। প্রতিদিন রাস্তায় নতুন গাড়ি নামছে এবং সব গাড়ি রাস্তাতেই থাকছে। বাংলাদেশে দুর্ঘটনায় ভেঙেচুরে না গেলে কোনো গাড়ি পরিত্যক্ত হয় না। তাই প্রতিদিনই যানজট পরিস্থিতির অবনতি হয়। ফ্লাইওভার বা নতুন কোনো ব্যবস্থা হলে সেই বাড়তি চাপটা তাতে বিলীন হয়ে যায়। আমাদের কোনো পরিকল্পনাই যানজটের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। তাই যতই ফ্লাইওভার হোক, যানজট পরিস্থিতি খুব একটা বদলায় না। যারা ভাবছেন, মেট্রোরেল চালু হলেই যানজট দূর হয়ে যাবে; তাদের সঙ্গে তাই আমি একমত হতে পারি না। নিশ্চয়ই মেট্রোরেলে যানজটে কিছুটা স্বস্তি আনবে। কিন্তু মেট্রোরেল চালু হতে হতে মানে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে যানজট যতটা বাড়ার কথা, তার অনেকটাই সমন্বয় হয়ে যাবে মেট্রোরেলের সঙ্গে। এ কারণে যানজটে মেট্রোরেলের অবদানটা হয়তো অতটা চোখে পড়বে না।

এখন যে মেট্রো লাইনটির কাজ হচ্ছে, সেটি এমআরটি-৬। এটি ২০.১০ কিলোমিটার, স্টেশন ১৬টি। এমন আরও ৫টি লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে সরকারের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩৫ সাল নাগাদ সব কটি এমআরটি লাইন চালু হলে ১২৯ কিলোমিটার হবে, স্টেশন হবে ১০৪টি। কিন্তু সব কটি চালু হওয়ার পরও ঢাকার যাত্রীর মাত্র ১৭ ভাগ বহন করবে মেট্রোরেল। মেট্রো আরামদায়ক, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব। কিন্তু ঢাকাকে স্মার্ট এবং সচল রাখতে হলে শুধু মেট্রোতে হবে না, একটি সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।

এই সমন্বিত পরিকল্পনারই বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থা তিনটি ‘আর’-এর সমন্বয়—রোড, রেল ও রিভার। সমন্বিত পরিকল্পনায় যাত্রীর চাপ যদি ভাগ করে দেওয়া যায়, তাহলেই কেবল যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সবগুলো মেট্রো লাইন চালু হওয়ার পরও মোট যাত্রীর মাত্র ১৭ ভাগ তা ব্যবহার করতে পারবে। তার মানে বাকি ৮৩ ভাগের চাপ সড়ক ও নৌপথের ওপর। সমস্যা হলো আমাদের যোগাযোগ ভাবনা সড়ককেন্দ্রিক। নৌপথ আমাদের ভাবনায় না থাকায় সড়কের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের রাস্তায় বসে কাটাতে হয়। আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সড়ককেন্দ্রিক হয়েছি বটে, কিন্তু যোগাযোগের আদি ধারণা কিন্তু নৌপথনির্ভর। নদীর পাশে গড়ে উঠেছে নগর, সভ্যতা, বাণিজ্য। এই যেমন ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থতি। কিন্তু শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, ঢাকার চারপাশে রয়েছে চারটি নদী। একসময় ঢাকার বুকেও জালের মতো ছড়িয়ে ছিল খাল। এসব খালে একসময় নৌকা চলত। সভ্য হতে হতে আমরা সব খাল গিলে খেয়েছি। দখলে-দূষণে নদীগুলোও বিপর্যস্ত প্রায়। অথচ ভাবুন সবগুলো খাল আর নদীগুলো সচল থাকলে ঢাকা হতে পারত ভেনিসের চেয়েও সুন্দর।

সৃষ্টিকর্তা আমাদের উদার হাতে বিলিয়েছেন আর আমরা সব উদরে চালান করেছি। আমরা খাল দখল করে ভবন তৈরি এবং খালের ওপর রাস্তা বানানোতেই লাভ দেখি। কিন্তু বুঝি না, এই এককালীন লাভ করতে গিয়ে ঢাকার চিরকালীন ক্ষতি করে ফেলেছি। সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে কেটে খাওয়ার মতো লোভী ও বোকা আমরা। খাল তো আর ফিরে পাব না জানি, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে যদি আমরা যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পারি, গণপরিবহনের চাপ অনেকটাই নৌপথ নিতে পারবে। মেট্রোরেলের মতো নৌপথও সাশ্রয়ী, আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব।

পরিবহনের সবচেয়ে খারাপ, ব্যয়বহুল, সময়ক্ষেপণকারী, পরিবেশ দূষণকারী হলো রাস্তা। আর আমাদের সব চাপ এই রাস্তার ওপরই। সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করে বাস। কিন্তু বছরের পর বছর কথা হলেও ঢাকায় একটি আধুনিক বাস পরিবহন ব্যবস্থা করা যায়নি। ঢাকার বাস অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ, ব্যয়বহুল ও সময়ক্ষেপণকারী। ঢাকার বাসব্যবস্থাকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে এনে আধুনিক করার জন্য খুব বেশি বাজেট লাগবে না। খালি লাগবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং কঠোর হাতে তা বাস্তবায়ন। সেটা করতে আন্তরিকতাই যথেষ্ট। ইদানীং উবার-পাঠাও এসে মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু একসময় ঢাকার ট্যাক্সি এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা ছিল রাস্তার রাজা। কোনো নিয়মকানুন, ভাড়া তারা মানত না। ঢাকার যানজটের আরেকটা বড় কারণ উচ্চবিত্তের মানুষ। তাদের গ্যারেজে গাড়ির সারি। এক গাড়িতে বাচ্চা স্কুলে যায়, আরেক গাড়িতে সাহেব অফিসে যায়, আরেক গাড়িতে ম্যাডাম শপিংয়ে যান। একটি গাড়িতে একজন যাত্রী। কিন্তু রাস্তা দখল করে পাঁচজনের। আর ঢাকায় রাস্তা আছে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। তাই চাহিদা আর সরবরাহে ফারাক থেকেই যায়। তাই যানজটও কমে না।

ওপরে আধুনিক মেট্রোরেল চলবে আর নিচে লক্কড়ঝক্কড় বাস, এটা কোনো স্বাস্থ্যকর শহর হতে পারে না। একটি আধুনিক, স্মার্ট আর সচল ঢাকা গড়তে হলে চাই সমন্বিত পরিকল্পনা।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!