কোথায় যেন পড়েছিলাম; ‘ইতিহাস তুমি সসম্মানে চলো আঁস্তাকুড়ে/ তোমার গর্দান নিলাম আমরা আঁস্তাকুড়ে।’ ইতিহাস মানে তার নিজস্ব কিছু গোলকধাঁধা থাকবে। থাকবে কিছু বিভ্রম। বুধবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের যে স্কোয়াড ঘোষণা করেছে, সেখানে আধুনিক সময় আর ইতিহাস এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে!
আধুনিক সময়ের কথা বলে অনাগত ভবিষ্যৎকে স্বাগত জানাতে গিয়ে ইতিহাসকে ছুড়ে ফেলা হলো! আর আধুনিক সময় আর ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হলো গণবিভ্রান্তি! একটু সোজাসাপ্টা বলা বোধ হয় ভালো। পনেরো সদস্যের বাংলাদেশ দলে জায়গা পাননি মাহমুদউল্লাহ। কারও ক্রিকেটীয় অহংকে আঘাত করার জন্য নয়, সাম্প্রতিক অতীতে মাহমুদউল্লাহর পারফরম্যান্স দেখে লিখেছিলাম; তার ক্যারিয়ার ’অস্তাচলে’। সেটা লেখা তার ভাগ্যাকাশে অস্তরাগের আভাস দেখে। হঠাৎ করে যে ভদ্রলোক টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিতে পারেন, তিনি কেন ঝুলিয়ে রেখেছিলেন তার টি-টোয়েন্টি ভবিষ্যৎ অন্যের হাতে? দুবাইয়ে বসেই বলে দিতে পারতেন, ’আমি আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলব না দেশের হয়ে।’ বললে কী ক্ষতি হতো! বরং তিনিই আধুনিক সময়ে ফিরিয়ে আনত পারতেন অতীতকে। কি বিষয়ে, কি রেকর্ডে, কি স্মৃতিতে, কি চরিত্রে! কিন্তু পারলেন না!
মাহমুদউল্লাহ আপনি নিজের অহংয়ের উইকেটটা অক্ষত রাখতে পারলেন না। অথচ এই আপনি বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিয়েছেন। অনেকবার খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তুলেছেন। কিন্তু আপনাকে ধরে রাখার জন্য কেউ কি হাত বাড়ালেন? প্রধান নির্বাচক বলেছেন, ’সবাই একমত হয়েই আপনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে!’ এই সবাই কারা? সিদ্ধান্ত তো নেওয়ার কথা তিন নির্বাচকের। ২০১৪ সালে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলেছিলেন আপনি বাংলাদেশকে। সেই ইতিহাস কেউ মনে রাখতে চাইলেন না। সেই সময় আপনি বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটের জন্য আমি গত কয়েক মাস মিষ্টি মুখে তুলিনি। অথচ মিষ্টি আমার খুব প্রিয়!’ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ক্রিকেটের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা চলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটই আপনাকে ত্যাগ করল। সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে ক্রিকেটই কি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়? নাকি নির্বাচকরা ক্রিকেটের প্রতি আপনার আনুগত্যকে মূল্যহীন করে প্রতিদান দিল দল থেকে বাদ দিয়ে?
আপনার বিষণ্নতায় ভরা মনকে আরও বিষণ্ন করে তোলার কোনো মানে হয় না। তবু লিখতে হচ্ছে, ওই অস্তে চলে গেল বয়স! কিন্তু সময়কে থামিয়ে তাকে ফেরানো যাবে না। জানি না, নির্বাচকরা মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়ার কথা আপনাকে বলেছিলেন কি না। আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার সুযোগ কি পেয়েছেন খেলোয়াড়রা? অবসর, বিদায় নিয়ে ক্রিকেটাররাও খুব দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। এ দেশের বড় বড় তারকারাও এই দ্বিধা কাটিয়ে বলতে পারেননি, ‘বিদায়! অনেক হয়েছে।’ আপনিও পারলেন না।
নির্বাচকরা আপনাকে বিদায় বলার সুযোগ দিলেন না। অথবা আপনি সুযোগটা নিলেন না। কিন্তু এ দেশের ক্রিকেটানুরাগীরা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছেন দলে নাজমুল হোসেন শান্তর নামটা দেখে! অনেকে বলছেন; বাস্তববোধের অভাবে আজ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াড নিয়ে শিরোনামে— ‘মাহমুদউল্লাহ বাদ!’ এটাকে আপনি ক্রিকেটীয় পরিহাস বলে মেনে নিতে পারেন। কিন্তু তার চেয়েও বাস্তববোধ বর্জিত সিদ্ধান্ত নিলেন যে নির্বাচকরা। নাজমুল হোসেন শান্তকে দলে রেখে!
স্যার নেভিল কার্ডাস পরিসংখ্যানকে গাধা বলে গিয়েছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান গাধাও নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করবে আপনার আর শান্তর পরিসংখ্যান পাশাপাশি রেখে নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত দেখে। ১২১টা টি-টোয়েন্টি খেলেছেন আপনি দেশের হয়ে। ২৩ দশমকি ৬ গড়ে রান করেছেন ২ হাজার ১২২। আর স্ট্রাইকরেট আধুনিক টি-টোয়েন্টিতে খুব ভদ্রগোছের না হলেও ১১৭ দশমিক ৫। এই সব সংখ্যার বিপরীত নাজমুল শান্ত ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে ৯টা টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। রান ১৪৮। গড় ১৮ দশমিক ৫। আর স্ট্রাইকরেট ১০৪ দশমিক ২! এই গড় আর এই স্ট্রাইকরেট নিয়ে টি-টোয়েন্টি দলে যিনি সুযোগ পান, তার ভাগ্য তাহলে ক্রিকেট দেবতা নিজে লিখেছেন না অন্য কেউ?
এটা তো পরিসংখ্যানগত পার্থক্য। আর অভিজ্ঞতাজাত পার্থক্য? সেখানে প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে পদ্মা! নির্বাচকদের যুক্তি হতে পারে, সিনিয়র চাই না। তারুণ্য চাই। এনার্জি চাই। ভালো কথা। কিন্তু কোন তারুণ্য? চার বছরে যিনি টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারলেন না! করপোরেট জগৎ তারুণ্যের পেছনে বিনিয়োগ করে। সেখান থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে। বেশি দিন ধরে রিটার্ন আসবে, সেই আশায়। কিন্তু বিসিবির এই তারুণ্যে বিনিয়োগটা দেখে মনে হচ্ছে; এটা আগামীর কথা বলে দলে একটা লাগেজ টেনে বেড়ানো হচ্ছে!
মাহমুদউল্লাহ আপনি এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ইতিহাসের পাতায় চলে যাওয়া পথিক। বাংলাদেশ টিম হয়তো ইতিহাসের আর কোনো মালপত্র ক্যারি করবে না। তারা আগামীর কথা ভাবছে। কিন্তু ব্যর্থ অতীতের লাগেজ ঠিকই টানছে!
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।