দেশজুড়ে যেন আনন্দের মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে। পবিত্র ঈদুল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এক মাসের সংযম শেষে ঈদ আসে বাঁধভাঙা আনন্দ নিয়ে। তবে করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর ঈদের আনন্দটা কিছুটা ম্লান ছিল। করোনার নানা বিধিনিষেধ, সামাজিক দূরত্বের কড়াকড়ি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব মিলিয়ে গত দুই বছর মানুষ মন খুলে আনন্দ করতে পারেনি। এবার যেন মানুষ সেই অপ্রাপ্তি সুদে-আসলে পুষিয়ে নিল। এবারের ঈদ-আনন্দ হয়েছে সুদে-আসলে ডাবল; বিস্ফোরণ নয়, সত্যি আনন্দের মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে।
ঈদ যে আনন্দের এমন সুনামি নিয়ে আসছে, সেটা টের পেয়েছি শপিং মলের অবস্থা দেখেই। এমনিতে শপিং আমার পছন্দ নয়, তবু স্ত্রী মুক্তির ড্রাইভার বা ব্যাগ বহনকারী হিসেবে দু-এক দিন বসুন্ধরা সিটিতে যেতে হয়েছিল। মানুষে মানুষে বসুন্ধরা সিটিকে কারওয়ান বাজার বানিয়ে ফেলা দেখেই বুঝেছি এবার কী হতে যাচ্ছে। ফুটপাত, গরিবের শপিং মল, মধ্যবিত্তের শপিং মল, বড়লোকের দোকান—সবখানেই উপচে পড়া ভিড়।
অনেক দোকানে পোশাকের স্টক ফুরিয়ে গিয়েছিল। ব্যবসায়ীরা যতটা ধারণা করে পণ্য তুলেছিলেন, বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। করোনার কারণে গত দুই বছর ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা করার সুযোগ পাননি। এবার তাই পুষিয়ে নেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল তাদের মধ্যেও। তবে ব্যবসায় লাভ করা আর ডাকাতি এক জিনিস নয়। রাজধানীর পলওয়েল সুপার মার্কেটে একটি টি-শার্টের দাম হাঁকিয়েছে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে শার্টের গায়ে ১৯ হাজার ৫০০ টাকার প্রাইস ট্যাগ লাগানো দোকানদারকে জরিমানাও করা হয়েছে। তারা কেউই এত উচ্চ মূল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি, কেনার রসিদ দেখাতে পারেননি। শুনেছি গুলশানের কিছু দোকানে নাকি লাখ টাকার নিচে কোনো শাড়ি বিক্রি হয় না। তবে মানুষ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী মন খুলে কেনাকাটা করেছে।
কেনাকাটা শেষে ঢল নামে বাড়ি ফেরার পথে। দুই বছরে বাড়ি যেতে না পারা মানুষ যে এবার বাড়ি ফিরবেই, সেটা অনুমিতই ছিল। আমার আশঙ্কা ছিল, বাড়ি ফিরতে বরাবরের মতো এবারও দুর্ভোগে পড়বে মানুষ। তবে সে আশঙ্কা পুরোপুরি সত্যি হয়নি। ট্রেনের টিকিট আর ফেরিঘাটে কিছুটা ভিড় হলেও অন্য বছরের তুলনায় এবার বাড়ি ফেরাটা স্বস্তিদায়কই ছিল। এবার বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে নতুন প্রবণতা মোটরসাইকেল; ফেরিঘাটে আর বিভিন্ন টোল প্লাজায় হাজার হাজার মোটরসাইকেলের সারি বাড়ি ফেরায় নতুন মাত্রা এবং নতুন ঝুঁকি যুক্ত করেছে।
এবারের ঈদের এই বাঁধভাঙা আনন্দেও বেদনার ঢেউ এনেছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার। তবে অন্য বছরের তুলনায় এবার সড়কে মৃত্যুর মিছিলটা একটু কমই ছিল। তবে ঈদের সময় ঢাকার ফাঁকা রাস্তা এবং মহাসড়কগুলোতে ঝুঁকি আরও বাড়ে। ঈদের ছুটিতে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে শৌখিন চালকরাও বেপরোয়া গতির প্র্যাকটিস করতে নেমে যায়। আর মহাসড়কে চালকরা যেন ‘যত দ্রুত, তত টাকা’ নীতিতে চলে। তাই ঝুঁকিও বেশি। আপনি ভালো এবং সাবধানী চালক হলেই হবে না, আপনার সামনের এবং পেছনের গাড়ির চালককেও ভালো হতে হবে।
ঈদের আনন্দকে পূর্ণতা দিতে এবার ছুটি হয়েছে লম্বা। যারা বৃহস্পতিবার দিনটি ম্যানেজ করতে পেরেছেন, তাদের ছুটি ৯ দিন। আমার ধারণা, ছুটি লম্বা হওয়াতেই এবার বাড়ি ফেরার ভোগান্তি কম হয়েছে। তাই কোটি মানুষের বাড়ি ফেরাটাও ঠিক গায়ে লাগেনি।
ঈদের আগে যেমন শপিং মল, ঈদের আগে আগে সড়কপথে আর ঈদের পর বিনোদন কেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড়। কোথাও ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই দশা। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেট, কুয়াকাটা—সব পর্যটন এলাকাতেই ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ। ঢাকা এবং আশপাশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও তিলধারণের ঠাঁই নেই। চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ গেছে এবার ঈদের পরদিন। পূর্বাচল তো অনেক আগেই, এবার মাওয়া ঘাটও ভ্রমণপিয়াসী মানুষের নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে। একটু আগে এক বন্ধু ফোন করে জানাল, সে অনেক চেষ্টা করেও রেন্ট-এ-কারে কোনো গাড়ি পায়নি। সবকিছুই এখন বুকড।
প্রচলিত অর্থে বিনোদন কেন্দ্র না হলেও ঢাকার যেকোনো খোলা জায়গাও ছিল মুখর। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, চন্দ্রিমা উদ্যান সড়কে এখন কৃষ্ণচূড়ায় আগুন লেগেছে যেন। সঙ্গে আছে রাধাচূড়া, রাণীচুড়া আর সোনালুর রঙের ছোঁয়া। ঈদের আনন্দের পূর্ণতা দিতেই যেন প্রকৃতিও সেজেছে অপরূপ সাজে। গত সপ্তাহে ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কের মাঝ বরাবর গিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই হলো। রাস্তার পাশেই একটা বিশাল কামিনী ফুলগাছ, ফুলের কারণে যার পাতা দেখা যাচ্ছিল না। গাড়ি থেকে নামতেই সৌরভের একটা ধাক্কা লাগলো যেন। গাছটির নিচে যেতেই ঘটল সবচেয়ে মজার ঘটনা, বৃষ্টির মতো কামিনীর পাপড়ি স্বাগত জানাল আমাদের। এই অনির্বচনীয় আনন্দ পেতে পারেন আপনারা যে কেউ।
ঈদের দিন বিকেলে আমরা ঢাকা থেকে কুমিল্লা গিয়েছি। চমৎকার এবং ফাঁকা রাস্তা। কুমিল্লা যেতে লেগেছে দেড় ঘণ্টা। দাউদকান্দি পেরোতেই দুই পাশে জলাধার, প্লাবনভূমিতে মৎস্য চাষ প্রকল্পও যেন সৌন্দর্যের চারণভূমি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সড়কদ্বীপে ফুলের অসাধারণ বর্ণাঢ্য বিস্তার। কোথাও সোনালু, কোথাও জারুল, কোথাও জাকারান্ডার সারি। রাস্তা তো নয়, যেন রঙের বিজ্ঞাপন—দেখো দেখো দেখোরে রঙেরই বাহার।
ঘরে বাইরে, পথে ঘাটে মানুষের আনন্দ দেখতেও ভালো লাগে। জানি, আমাদের উন্নতি যেমন হয়েছে, বৈষম্যও বেড়েছে। সবাই হয়তো সমান আনন্দ করতে পারেননি। তবে সবার মুখেই ছিল আনন্দের আভা।
ঈদুল ফিতর মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও আনন্দের ঢেউ ছড়িয়েছে সবার ঘরে ঘরে। অনেক হিন্দু পরিবারকে দেখেছি প্রতিযোগিতা করে পোশাক কিনেছে। ঈদের আগে পার্লারে গেছে, বেড়াতে গেছে। নতুন পোশাক পরে ঈদের দিন মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’, এটাই যেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মূল থিম।
তবে এত আনন্দের মাঝেও একটা মন খারাপের খবর ছিল, সেটা এসেছে ৩ মে, ঈদের দিনেই। ৩ মার্চ ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস৷ এ উপলক্ষে ২০২২ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ ১৮০টি দেশের তালিকায় এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম৷
২০২১ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২৷ সে হিসাবে এবার এক বছরেই ১০ ধাপ পেছাল বাংলাদেশ৷ এটা অবশ্য নতুন মন খারাপ নয়। প্রতিবছরই মুক্ত গণমাধ্যম সূচক আমাদের লজ্জা দেয়। গত এক যুগ মানে বর্তমান সরকারের সময়টি গণমাধ্যমের জন্য ভালো যায়নি। নানাভাবে, কালাকানুনে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। মানুষ মন খুলে বলতে পারে না। যত উন্নয়নই হোক, পদ্মা সেতু-মেট্রোরেলে মানুষের মন ভরবে না। এক বেলা খেয়েও মানুষ প্রাণখুলে বলতে চায়, আমি মানি না বা আমি মানি। পছন্দ-অপছন্দ মন খুলে বলতে পারার অধিকার চায় মানুষ, চায় অবাধ ও মুক্ত গণমাধ্যম।
লেখক: সাংবাদিক