• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

পাহাড়ি ক্যাম্পে দিনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, রাতে জিহাদি বয়ান


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২২, ০৯:১৪ পিএম
পাহাড়ি ক্যাম্পে দিনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, রাতে জিহাদি বয়ান

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ওই সদস্য জানিয়েছেন পাহাড়ি ক্যাম্পে দিনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলত আর রাতে জিহাদি বয়ান করা হতো।

বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।

গ্রেপ্তাররা হলেন সাইফুল ইসলাম তুহিন (২১) ও নাঈম হোসেন।

এর আগে, বুধবার (২১ ডিসেম্বর) সিলেট থেকে তুহিন ও ঢাকা থেকে নাঈম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ বিষয়ে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড়ে অভিযান শুরু করলে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নতুন জঙ্গি সংগঠনের দুই সদস্য। পরে প্রায় এক মাস হেঁটে পাহাড় থেকে সমতলে আসেন তারা। এই দুইজন প্রায় এক বছর নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। সমতলে আসার পর গোয়েন্দা নজরদারিতে সিটিটিসি তাদের গ্রেপ্তার করে।”

সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, “বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিনের সাহায্যে নতুন জঙ্গি সংগঠন পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায়। অভিযানে নতুন জঙ্গি সংগঠনের অনেক সদস্য গ্রেপ্তার হয়। অনেকে আবার গ্রুপে গ্রুপে পাহাড়ে অবস্থান নেয়। তবে কেউ কেউ সমতল ভূমিতে ফিরে আসার চেষ্টা করে এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।”

জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আসাদুজ্জামান বলেন, “নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অনেকেই স্বেচ্ছায় গেলেও মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ক্যাম্পে গিয়ে অনেকেই ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারেননি।”

তিনি বলেন, “সাইফুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট থেকে কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। সাইফুল ইসলাম একটি কওমি মাদরাসায় পড়তেন। সেখানে এক ইমামের মাধ্যমে তিনি উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। কথিত হিজরতে গিয়ে কী করতে হবে সেটিও জানতেন না সাইফুল।”

সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, “১৫ নভেম্বর সিলেট থেকে একটি মাইক্রোবাসে সাইফুলসহ তিনজন প্রথমে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাদের সঙ্গে আরও চার ‘হিজরতকারীর’ দেখা হয়। পরে সেখান থেকে তারা বাসে করে বান্দরবানের দিকে রওনা হন। রাস্তায় তাদের ফোন ও বাসা থেকে নিয়ে আসা টাকা নিয়ে নেয় সংগঠনটির এজেন্ট। পথিমধ্যে তাদের চুল ও দাড়ি কেটে ফেলা হয়। বান্দরবান থেকে তারা থানচি যান। সেখান থেকে এক রাতে ১২ ঘণ্টা হেঁটে প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছান।”

ডিএমপির এই কর্মকর্তা আরও জানান, নাঈম হোসেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি ইনস্টিটিউশনের চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। করোনার সময় ইনস্টিটিউশন বন্ধ থাকায় তিনি বাড়িতে যান। গ্রামের এক হুজুরের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন নাঈম। পরে তিনি ঢাকায় হলে চলে আসেন। হল থেকে কাউকে কিছু না বলে ২ অক্টোবর কুমিল্লায় সেফ হাউজে চলে যান। সেখান থেকে নাঈম একইভাবে আরও আট থেকে ১০ জনের সঙ্গে থানচি হয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছান।

গ্রেপ্তার সাইফুল ও নাঈম জানান, ক্যাম্পের যেই কক্ষে শামীন মাহফুজ থাকতেন সেখানে সশস্ত্র পাহারায় থাকতেন জঙ্গি সদস্যরা। কুকি-চিনের প্রধান নাথান বম মাঝে মধ্যে ক্যাম্পে এলে শুধু শামীন মাহফুজের কক্ষে আলোচনা করতেন। প্রথম ক্যাম্পটিতে সাত-আট দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শামীন সিদ্ধান্ত নেন, তারা মিজোরাম সীমান্ত লাগোয়া কোনো পাহাড়ে অথবা মিজোরামের ভেতরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করবেন। কিন্তু সেখানে যেতে না পেরে তারা ফিরে আসেন। পরে তাদের ক্যাম্পে একবার হামলাও হয়। পার্বত্য এলাকার চরমপন্থি গ্রুপ জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) এই ক্যাম্পকে কুকি-চিনের ক্যাম্প ভেবে হামলাও করে। পরে শামীন মাহফুজ সেখান থেকে আরেকটি পাহাড়ে গিয়ে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করেন।

আসাদুজ্জামান জানান, এরই মধ্যে সাইফুল ইসলাম তুহিনসহ সিলেট থেকে আসা তিনজন এই প্রশিক্ষণের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিদ্রোহ করেছিলেন। তারা সেখান থেকে ফেরত আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বিদ্রোহের বিষয়টি টের পেয়ে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় সংগঠনটির কমান্ডার। তাদের সারা দিন গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হতো, দোররা মারা হতো। একপর্যায়ে তারা নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আবার সংগঠনের কার্যক্রমে ফেরত আসেন। তাদের দিয়ে ক্যাম্পের সব কাজ করানো হতো।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অক্টোবর মাসে যখন পাহাড়ে অভিযান চালায় তখন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তখনই গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাইফুল ও নাঈম হাঁটতে হাঁটতে একটি মার্মা গ্রামে গিয়ে ওঠেন। পরে ওই গ্রামের লোকজন তাদের কুকি-চিনের কাছে দিয়ে দেয়। কুকি-চিন তাদের পরিচয় জানতে পেরে এক মাস নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। শেষে তারা সূর্যের অবস্থান ও বাড়িঘর দেখে এক মাস হেঁটে বান্দরবান শহরে এসে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। নভেম্বরের ২৫ তারিখে তারা বান্দরবানে আসেন।

তাদের আদালতে রিমান্ড আবেদন করে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে এসব বিষয়ে আরও তথ্য জানা যাবে বলে জানান সিটিটিসির এই কর্মকর্তা।

Link copied!