• ঢাকা
  • শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩০, ২১ রমজান ১৪৪৬
নোয়াখালী থেকে ফিরে

চৌমুহনীতে সাম্প্রদায়িক হামলা: কাটেনি উদ্বেগ-আতঙ্ক


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২১, ০২:২৮ পিএম
চৌমুহনীতে সাম্প্রদায়িক হামলা: কাটেনি উদ্বেগ-আতঙ্ক

কুমিল্লায় পূজা চলাকালে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগের জেরে গত শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। ভাঙচুরের পাশাপাশি করা হয় অগ্নিসংযোগ। বাদ যায়নি সনাতন ধর্মালম্বীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানেও অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় সেদিন প্রাণ হারান যতন সাহা (৪২) ও প্রান্ত চন্দ্র দাস (২৬) নামের দুজন। পুলিশসহ আহত হন অন্তত অর্ধশতাধিক।

সাম্প্রদায়িক সেই হামলার পর এক সপ্তাহ কেটে গেলেও দগদগে ক্ষতের মতো তাণ্ডবের চিহ্ন রয়ে গেছে চৌমুহনীর পথে পথে। মন্দির ও মণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে প্রশাসন। হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অনেককে গ্রেপ্তারও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও আতঙ্ক কাটেনি স্থানীয় সনাতন ধর্মালম্বীদের।

গত বুধবার (২০ অক্টোবর) চৌমুহনীর ক্ষতিগ্রস্ত পূজামণ্ডপ ও মন্দির ঘুরে দেখা যায়, দুর্বৃত্তদের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে প্রতিটি পূজামণ্ডপ ও মন্দির। বিগ্রহ, প্রণামির বাক্স, দেব-দেবতার ছবি, জানালার কাচ সবই ভাঙাচোরা ও টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে মন্দির প্রাঙ্গণে। বর্তমানে প্রতিটি মন্দির প্রাঙ্গণে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়রা। এতো সতর্কতা সত্ত্বেও সকলের চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ।

পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দুটি গাড়ি। ছবি: সুব্রত চন্দ

 

বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনীর ডিবি রোডের শেষ মাথায় অবস্থিত রামচন্দ্র দেবের সমাধিক্ষেত্র (আশ্রম)। শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) বিজয়া দশমীর দিন সকাল ১১টায় এই মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে খালি হয়ে যায় মন্দির প্রাঙ্গণ। ছিলেন শুধু মন্দিরের সেবক ও কর্মচারীরা। দুপুরে জুমার নামাজের পর চারদিকে শোরগোল শুরু হয়। আশপাশের বিভিন্ন মন্দিরে হামলার খবর আসতে থাকে কর্মচারীদের মুঠোফোনে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তড়িঘড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয় মন্দিরের প্রধান ফটক। এর কিছুক্ষণ পরই হামলাকারীরা হাজির হয় ওই মন্দিরে। মন্দিরের প্রধান ফটক ভাঙতে না পেরে জ্বালিয়ে দেয় পাশে থাকা একটি পূজার সরঞ্জামের দোকান। এরপর কয়েকজন মই নিয়ে এসে ফটক ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেঙে ফেলা হয় ফটকের তালা। তারপর প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে তাণ্ডব।

ওই দিনের স্মৃতিচারণা করে আশ্রম কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য রঞ্জিত সাহা বলেন, “প্রায় কয়েক হাজার হামলাকারী আশ্রমের ভেতর অফিস কক্ষ, অতিথিশালা ও রামচন্দ্র দেবের সমাধিক্ষেত্রে ভাঙচুর চালায়। লুটপাট করা হয় ঠাকুরের ছবিতে থাকা স্বর্ণালংকার, প্রণামির বাক্স ও অফিসের নগদ অর্থসহ কয়েক লাখ টাকা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মন্দিরের সামনে থাকা একটি দোকান ও ভেতরে থাকা একটি ঘর। মন্দির প্রাঙ্গণের ভেতরে থাকা দুটি প্রাইভেট কারও পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হামলাকারীদের মারধরে আহত হন কর্মচারীরা।”

রঞ্জিত সাহা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, “আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান মিলে এই দেশটা স্বাধীন করলাম। যাতে সবাই শান্তিতে বসবাস করতে পারে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এখানে হামলা হয়নি। অথচ গত শুক্রবার এখানে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়। সম্প্রীতির দেশে এমন ঘটনায় সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মানে দাগ কেটেছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রত্যেকের মনে। এমনকি ওই দিনের ঘটনার পর থেকে আমরা সনাতন ধর্মালম্বীরা এখনো খুবই আতঙ্কিত।”

রামচন্দ্র দেবের সমাধিক্ষেত্রের (আশ্রম) কিছু দূরেই অবস্থিত রাধামাধব জিউর মন্দির। সেখানেও সরকারি নির্দেশনার পর শুক্রবার ১২টা মধ্যে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। দুপুরের দিকে বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার কথা জানতে পারার পর সেখানেও প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয় হয়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা সেই ফটকও ভেঙে মন্দিরে প্রবেশ করে। ভাঙচুর করে অফিস কক্ষ, কালীমন্দির ও রাধা-মাধবের মন্দির। লুট করে নিয়ে যায় বিগ্রহের শরীরে থাকা স্বর্ণালংকার ও প্রণামির বাক্সের টাকা।

এই মন্দিরের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) অনন্ত কুমার ভৌমিক বলেন, “এবার চিরাচরিত নিয়মের বাইরে গিয়ে দুর্গা প্রতিমা দুপুরের আগে বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপরও হামলার হাত থেকে বাঁচা গেল না। দুপুর আড়াইটার দিকে শত শত মানুষ এসে এখানে ভাঙচুর করে। আনুমানিক কয়েক কোটি টাকার স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। রাত ১২টার দিকে পুলিশ আসে। তখন সব শেষ।”

সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায় এখন আতঙ্কে রয়েছে জানিয়ে অনন্ত কুমার ভৌমিক আরও বলেন, “দুর্গাপূজার পর আমাদের অনেকগুলো পূজা ছিল। কিন্তু হামলার ভয়ে নেই কোনো আমেজ, ভোগবিলাস। আমরা দেশের নাগরিক হয়েও আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। পুলিশ মন্দিরগুলোতে পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু বাইরে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। দেশের অনেক জায়গায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগের কথা শুনছি। কখন আমাদের বাড়িঘরে হামলা হয়, সেই আতঙ্কে আছি।”পুলিশ কয়দিন মন্দিরে পাহারা দেবে? যখন চলে যাবে তখন কী হবে? প্রশ্ন করেন তিনি।

বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে অনন্ত কুমার ভৌমিক বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা চাই, সাংবিধানিক অধিকার চাই। আমরা এই দেশে ছেড়ে যেতে চাই না। আমাদের মন্দিরের ক্ষতিপূরণ সরকারকে দিতে হবে। কীভাবে আবার মন্দির পুনর্গঠন হবে সেটা সরকারকে দেখতে হবে।”

চৌমুহনীর কলেজ রোডের খোদবাড়িতে অবস্থিত শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবা সংঘের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাপ্পা রায় চৌধুরী বলেন, “দুর্গাপূজার নবমীর রাত থেকেই আমাদের ধারণা করছিলাম, দশমীর দিন জুমার নামাজের পর ঝামেলা হতে পারে। সেই ধারণা আর সরকারি নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আমারা প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে দিই। প্রতিমা বিসর্জনের পর যখন ভক্তরা মন্দিরে খাবার খাচ্ছে, তখন কয়েক শ দুর্বৃত্ত আমাদের মন্দিরে হামলা করে দুই দফায়। মন্দিরের সব কাচ ভেঙে ফেলে, বিগ্রহ ভাঙচুর করে, টাকাপয়সা লুট করে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে মন্দির প্রাঙ্গণে থাকা একটি প্রাইভেট কারে আগুন দেয়। তারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নির্ভয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক এই ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এতে আমাদের মন্দিরের সাত-আটজন আহত হয়েছে।”

বাপ্পা রায় চৌধুরী আরও বলেন, “হামলার সময় আমরা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফোন করেছি, কিন্তু কোনো সাহায্য পাইনি। ৯৯৯-এ ফোন করেছি, সেখান থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর প্রায় দুই ঘণ্টা পর পুলিশ এসেছে। তখন আর কিছুই আস্ত নেই। এই হামলায় আমাদের মন্দিরের প্রায় ‘১ কোটি ২৬ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।”

বাপ্পা রায় চৌধুরী আরও বলেন, “শুক্রবারের ঘটনার পর থেকে মন্দিরে পুলিশ আছে, প্রশাসনের লোকজন আসছে। কিন্তু আমাদের ভীতি এখনো কাটেনি। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে সেদিনের বিভীষিকা ভেসে ওঠে। আমাদের মন্দিরে পূজা হয় না এখন। আমারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। আমাদের এই ভয়, আতঙ্ক কাটতে আরও সময় লাগবে।”

চৌমুহনীর কলেজ রোডের শেষ মাথায় পাশাপাশি অবস্থিত বিজয়া পূজামণ্ডপ ও ইসকন মন্দির। এই মন্দিরেই দুর্বৃত্তদের হামলায় মারা যান যতন সাহা ও প্রান্ত চন্দ্র দাস। যতন সাহা পূজা উপলক্ষে এখানে ভগ্নিপতির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। আর প্রান্ত ছিলেন একজন ইসকন ভক্ত। প্রান্তের মরদেহ হামলার পরদিন ভোরে মন্দিরের পাশের পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

শুধু মূর্তি নয়, মানুষের মনও ভেঙেছে এই হামলায়। ছবি: সুব্রত চন্দ

সেদিনের হামলার কথা জানতে চাইলে ইসকন মন্দিরের উন্নয়ন কমিটির সদস্য পরম সাধক দাস বলেন, “ওই দিন দুই দফা আমাদের মন্দিরে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা আমাদের ইসকনের সদস্যদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করে। মোটরসাইকেল, রথ ও বিগ্রহ পুড়িয়ে দেয়। অফিস কক্ষসহ বিভিন্ন স্টলে ভাঙচুর করে। রাতে আমাদের একজন ইসকন ভক্তকে পুকুরপাড়ে মারধর করার কথা জানতে পারি। পরে আমরা রাত ২টা পর্যন্ত পুকুরসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করি। পরদিন সকালে পুকুরে তার মরদেহ ভেসে ওঠে।”

পরম সাধক দাস আরও বলেন, “ওই দিন দুর্বৃত্তদের হামলায় ভক্তরা এতটাই আতঙ্কিত হয়েছে যে, এখন রাতে প্রাকৃতিক কাজ সারতেও বাইরে বের হতে ভয় পায়। সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কারণ, পুলিশ তো সারা জীবন থাকবে না। যত দিন পর্যন্ত এই হামলার সঙ্গে জড়িত দুষ্কৃতকারীদের যথাযথ শাস্তি না হবে, তত দিন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় এমন হামলা হতেই থাকবে।”

ওই দিন স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে এমন হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেন এই ইসকন ভক্ত। তিনি বলেন, “ওই দিনের হামলা দিনের বেলায় হয়েছে। বাজারসহ বিভিন্ন মণ্ডপে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেগুলোর ফুটেজ রয়েছে। প্রশাসন ইচ্ছা করলেই প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে পারে। সরকারের কাছেও আমরা এটাই চাই।”

১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন সকালে কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘির পাড় এলাকার হনুমান মূর্তির কোলে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগ ওঠে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কিছুক্ষণ পরেই ওই অস্থায়ী মণ্ডপে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার জেরে নবমী পর্যন্ত চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর হাতিয়া, বান্দরবান, কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলা ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন জুমার নামাজের পর নোয়াখালীর চৌমুহনীর ১১টি পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা চালায় দুষ্কৃতকারীরা। এতে দুইজন মারা যান। বেগমগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। চৌমুহনীর এ ঘটনার প্রেক্ষিতে চারটি মামলা করা হয়। বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) সেসব মামলায় ১০৮ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।

এদিকে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা প্রধান অভিযুক্ত, ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে ইকবালকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের সূত্রে জানা যায়, ইকবাল কুমিল্লা নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর নুর আহম্মদ আলমের ছেলে।

‘সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে রাজধানীতে নাগরিক সমাবেশ ও মশাল মিছিলের ভিডিও

 

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!