আজ পরম প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের জন্মদিন। তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, চাঁদপুরে মামাবাড়িতে। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো নব্বই। কি অসম্ভব বিনয়ী মানুষ ছিলেন! এমন মানুষ আর কোথাও দেখি না।
শঙ্খ ঘোষের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি অনেক আগে। কিন্তু ব্যক্তি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দেরিতে। তাঁর একটি বই পড়েছিলাম ‘নিরহং শিল্পী’ শিরোনামে। ২০১৬ সালে বইটি প্রকাশ করেছে কলকাতার তালপাতা প্রকাশনী। শঙ্খ ঘোষ তাঁর জীবনে বরেণ্য মানুষদের যে বিনয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার অভিজ্ঞতাসমূহ নিয়ে গ্রন্থটি রচিত। বইটি সম্পূর্ণ পড়ে মনে হলো তিনি কত সৌভাগ্যবান। এমন মহান মানুষদের সঙ্গ পেয়েছেন। তারপরে মনে হলো নিরহং শিল্পীর পাঠপ্রতিক্রিয়া শঙ্খ ঘোষকে জানাই। কিন্তু ফোন নম্বর তো নেই। পরে তালাপাতা প্রকাশনীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা আমাকে কবির নম্বর ইমেইল করে। নম্বর পেয়েই তাঁকে কল করলাম। কবিই ধরলেন, আমি আমার মুগ্ধতার কথা জানাই। একই সঙ্গে বলি, আমি কিন্তু আপনার মামাবাড়ি চাঁদপুরের মানুষ। তিনি যেন হাসলেন। বললেন, কলকাতায় এলে অবশ্যই যেন তাঁর বাসায় আসি।
২০১৮ সালের শুরুতে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান শায়ক ‘জ্যোতির্ময় চাঁদপুর’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ লেখার অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধে কাজ শুরু করলাম। আমি জানতাম শঙ্খ ঘোষের জন্ম চাঁদপুরে, কিন্তু তাঁর জন্মস্থান নিয়ে তেমন তথ্য পাইনি। এজন্যে আবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁকে বললাম, স্যার আপনার মামাবাড়ি বিষয়ে আমি সামনা-সামনি বিস্তারিতভাবে কথা বলতে চাই। আপনি কি সময় দিবেন? তিনি সম্মতি জানালেন। আমিও তাঁর সঙ্গলাভের সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাইনি। জোড়াসাঁকো, শান্তিনিকেতন ও শঙ্খ ঘোষ—এ উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৯ সালের ৩ মে কলকাতায় গেলাম। সহযাত্রী গল্পকার কাদের পলাশ ও সাংবাদিক ওয়াদুদ রানা। নিউমার্কেট এলাকায় হোটেলে উঠে আবার স্যারের সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ। স্যার ঠিকানা বললেন, লিখে নিলাম। তিনি সাক্ষাতের সময় দিলেন ৪ মে সন্ধ্যা ৬টা। আমি ও কাদের পলাশ পরদিন ঠিক সময়েই বের হই। কিন্তু বিধি বাম। নিরহং শিল্পী বইটি অনেক খুঁজলাম। উদ্দেশ্য স্যারের অটোগ্রাফ নিবো। কিন্তু বইটি পেলাম না। অন্যদিকে গাড়ি পেতেও দেরি হয়ে গেল। ভেবেছি স্যারের বাসার কাছে পৌঁছে ফুল বা মিষ্টি যা পাই নিয়ে নিবো। কিন্তু আমরা যখন ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসে পৌঁছলাম, ততক্ষণে সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। আশেপাশে ওই রকম দোকানপাটও চোখে পড়লো না। কিছু না নিয়ে সসঙ্কোচে স্যারের বাসায় গেলাম। একজন মধ্যবয়সী নারী দরোজা খুলে আমাদের বসার রুমে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আপনারা বসুন, স্যার আসছেন। আমরা বসলাম। রুমের ভেতর বই আর বই। নানা ভাষার নানা রকম বই। কিছুক্ষণ পরেই কবি এলেন। ছবির শঙ্খ ঘোষকে সেই প্রথম ও শেষবার বাস্তবে দেখা। দেখলাম স্যার অসুস্থ, বার্ধক্যের কারণে তাঁর হাত কাঁপছে। প্রথম দু’মিনিট তাঁর কোনো কথাই বুঝলাম না। উচ্চারণ একদম অস্পষ্ট। তিনি হাতের ইশারায় আমাকে তাঁর কাছের চেয়ারটায় বসতে বললেন। এবার ধীরে ধীরে তাঁর কথা বুঝতে পারলাম। জানতে চাইলেন, চাঁদপুর থেকে কখন এসেছি, কোথায় উঠেছি। আমি জানালাম। একই সঙ্গে কাদের পলাশকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপরে স্যার বললেন, বলুন কী জানতে চান? আমি বললাম, জানতে চাই আপনার মামাবাড়ির স্মৃতি এবং আপনার মা, মামা ও মাতামহ সম্পর্কে। তিনি মৃদু হাসলেন। আমি মোবাইল বের করলাম, উদ্দেশ্য তাঁর কথাগুলো রেকর্ড করবো। তিনি বুঝতে পেরে বললেন, কথা রেকর্ড করা যাবে না। লিখে নিতে হবে। আমার কণ্ঠস্বর এখন ভালো না। আমি মোবাইলেই নোটবুক খুলে বসলাম। প্রশ্ন করছি, তিনি উত্তর দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আধা ঘণ্টার সাক্ষাৎকার। প্রশ্ন শেষ হলে আমি বললাম, স্যার বইটি প্রকাশের আগে এ লেখাটা আপনাকে দেখিয়ে নিবো। তিনি সম্মতি দিলেন। সেসময় তিনি জানালেন, সবশেষ তিনি চাঁদপুরে গিয়েছেন ১৯৯৭ সালে। তারও বহু আগে তাঁর মামারা মারা গেছেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল জন্মস্থানটি দেখবেন। কিন্তু দীর্ঘদিন না যাওয়াতে শহরের মধ্যে মামাবাড়িটি আর খুঁজে পাননি। স্যারকে কথা দিলাম, আমি তাঁর মামাবাড়িটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। একই সঙ্গে বললাম, স্যার ‘নিরহং শিল্পী’ বইটি এখানে খুঁজলাম, পাইনি। চাঁদপুর থেকে আনতে ভুলে গেছি। আপনার একটা অটোগ্রাফ নিতাম। স্যার বললেন, পাননি, ভালোই হয়েছে। আমি তো এখন আগের মতো লিখতে পারি না। লিখতে, কথা বলতে কষ্ট হয়।
আরও কিছুক্ষণ পর আমাদের আলাপ শেষ। এর মধ্যেই আটটা বেজে গেছে। আমরা উঠবো। আরও কয়েকজন এসেছেন স্যারের কাছে। আমরা ছবি তুললাম। তারপর স্যারকে বললাম, আমরা উঠি স্যার। তিনি বললেন, না, কিছু খেতে হবে যে। আমি তখন বিব্রত। কেননা, সময়ের অভাবে খালি হাতেই তাঁর বাসায় চলে এসেছি। বললাম, স্যার আমরা নাস্তা খেয়ে এসেছি। তিনি হেসে বললেন, চাঁদপুর থেকে খেয়ে এসেছেন? আমিও রসিকতায় হাসলাম। বললেন, মামাবাড়ি থেকে এসেছেন, কিছু খেয়ে যেতেই হবে। অতঃপর স্যারের নির্দেশে চা, সন্দেশ এলো। হঠাৎ দেখলাম স্যার আমার সামনে থাকা চায়ের কাপ হাতে নিচ্ছেন। আমি ভেবেছি, স্যার ভুলবশত তাঁর সামনের কাপ রেখে আমারটা নিচ্ছেন। কিন্তু অবাক করে দিয়ে তিনি চায়ের কাপ আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, নিন। আমি বিস্মিত। চায়ের কাপ নিতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপছে। তা-সত্ত্বেও তিনি এ সৌজন্যতা দেখালেন। আমি ও কাদের পলাশ রীতিমতো স্তব্ধ। আমরা হলে কি এমনটা করতাম?
যা-হোক, আরও বড় বিস্ময় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমরা স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠলাম। দেখি, স্যারও উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আমাদের দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা তাঁকে যতই না-না করি, আপনার কষ্ট হবে বলি, তিনি কথা শোনেননি। বললেন, মামাবাড়ির মানুষ যেকোনো সময় আসবেন। তিনি আমাদের একেবারের সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত লাঠি ভর করে এগিয়ে দিয়ে গেলেন। আমরা তাঁর বিনয়ে বিস্মিত হয়ে গেছি। তাঁর মতো একজন বরেণ্য মানুষ আমাদের মতো দুজন অখ্যাত তরুণকে শারীরিক কষ্ট অগ্রাহ্য করে এভাবে এগিয়ে দিলেন! ভাবতেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তাঁর পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা বিদায় নিই। সিঁড়ির এক ধাপ নেমে পেছনে ফিরে দেখি হাসিমুখে ৮৭ বছরের শঙ্খ ঘোষ দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা চোখের আড়াল হলে তিনি বাসার ভেতর যাবেন!
জ্যোতির্ময় চাঁদপুর-এর পাণ্ডুলিপি গোছাতে দেরি হয়ে গেল। কাজটি শেষ হয় ২০২০ সালের প্রথমার্ধে। পরে করোনা শুরু হয়ে যায়। তাই কলকাতায় গিয়ে স্যারকে লেখাটা দেখানো হয় না। এরমধ্যে প্রথমা থেকে শঙ্খ ঘোষের ‘সন্ধ্যা নদীর জলে : বাংলাদেশ’ বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে তাঁর চাঁদপুরকে নিয়ে লেখা ‘মেঘনা ৯৭’ শিরোনামে একটি লেখা রয়েছে। লেখাটি আমার ও কাদের পলাশের সম্পাদিত বিস্মৃতির চাঁদপুর গ্রন্থে প্রকাশের জন্যে চাইলে তিনি অনুমতি দেন। বইটি ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়েছে। আমার ইচ্ছে ছিল জ্যোতির্ময় চাঁদপুর ও বিস্মৃতির চাঁদপুর বই দুটি শঙ্খ ঘোষকে সরাসরি গিয়ে দিয়ে আসবো। সে ইচ্ছে আর পূরণ হলো না।
বছর দুয়েক আগে একটি কাজ শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। কদিন আগে পাণ্ডুলিপি গোছানোর কাজটি সম্পন্ন হয়। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নে প্রথমেই শঙ্খ ঘোষের কথা মনে পড়লো। স্যার যদি ভূমিকা লিখে দেন তাহলে তো বেশ হয়। কিন্তু করোনার মধ্যে কলকাতায় তাঁর কাছে কীভাবে পাণ্ডুলিপি পাঠাবো? কাজটি সহজ করে দেন চাঁদপুরের উদীয়মান শিল্পী স্বর্ণালি দাস। তিনি রবীন্দ্র-ভারতীতে পড়ছেন। তার কাছে পাণ্ডুলিপি মেইল করে অনুরোধ করি, শঙ্খ ঘোষকে যেন প্রিন্ট করে সেটি পৌঁছে দেন। সঙ্গে স্যারকে লেখা আমার একটি চিঠি। এসব গত বছরের ৩/৪ এপ্রিলের ঘটনা। পরে আমার মনে হলো, স্যারের মামাবাড়ি আরেকবার খুঁজে দেখি। এর আগেও বারকয়েক নতুনবাজার গিয়ে বাড়িটি বের করার চেষ্টা করেছি। স্যার বলেছিলেন, তাঁর মামাবাড়ি নতুনবাজার। তিনি পুরানবাজার ও নতুনবাজার—এই অর্থে যে বলেছেন, সেটা বুঝতে পারিনি। ৯ এপ্রিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনীর আহমেদের সহযোগিতা নিয়ে পালবাজারে স্যারের মামাবাড়িটি খুঁজে বের করি। একই তথ্য দিয়েছিলেন সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুরের মহাপরিচালক কাজী শাহাদাত। এ কাজে আরও সহযোগিতা করেন সমাজকর্মী এইচএম জাকির। পরে প্রায় শতবর্ষী বাড়িটির ছবি তুলে আবার স্বর্ণালি দাসকে পাঠাই। অনুরোধ করি, ছবিগুলো যেন স্যারকে দেখায়।
১০ এপ্রিল স্বর্ণালি দাস স্যারের বাসায় গিয়েছেন। দিয়েছেন আমার দেওয়া পাণ্ডুলিপি, চিঠি ও ছবিগুলো। তাঁর উপস্থিতিতেই স্যারকে পাণ্ডুলিপির কয়েক পৃষ্ঠা এবং চিঠিটি পড়ে শোনান তাঁর সহযোগী। স্যার ছবিগুলোও দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। স্যার জানালেন, আমার বইটির ভূমিকা তিনি লিখে দিবেন। বললেন, এক তো মামাবাড়ির মানুষ, তারসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ—আমি কি না করতে পারি? স্যারের সহযোগী ওই সময়ই মোবাইলফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বললেন, স্যার জানতে চেয়েছেন, কতদিনের মধ্যে আপনার ভূমিকাটা লাগবে? বললাম, আমি জানি স্যার অসুস্থ, তিনি সময় করে লিখে দিলেই হবে। আমি কৃতজ্ঞ থাকবো। সেই বৈঠকে শঙ্খ ঘোষ স্বর্ণালি দাসের মুখে গানও শুনেছিলেন। স্বর্ণালি স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে আমাকে কল দিয়ে বললেন, দাদা আপনি বিশ্বাস করবেন না, স্যার কত আন্তরিকভাবে আপনার পাণ্ডুলিপি, চিঠি ও ছবিগুলো গ্রহণ করেছেন। আর কত বিনয়ী মানুষ তিনি। আমাদেরকে এগিয়ে দিলেন!
এর তিন-চারদিন পরে স্যারের করোনা আক্রান্তের খবর শুনলাম। ভেবেছি, স্যার সুস্থ হয়ে যাবেন, আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। ২১ এপ্রিল দুপুরে সাহিত্যবিষয়ক একটি কাজ করছিলাম। হুট করেই বন্ধু আজহারের কল, একটামাত্রই বাক্য জানালো, ‘শঙ্খ ঘোষ নেই!’
কি দুঃসময় এলো ঈশ্বর! কান্না ব্যতীত এর ভিন্ন কোনো উত্তর নেই। কবির স্মৃতিগুলো আজও আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। শঙ্খ ঘোষের কারণেই কলকাতাকে খুব আপন বলে মনে হতো। কারণ তিনি যে আমাকে বলতেন ‘মামাবাড়ির লোক’।
জন্মদিনে কবির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।