প্রেমের পাঠশালার শিক্ষক হওয়া দূরে থাকুক, শিক্ষার্থী হওয়াও যে কঠিন, মর্মে মর্মে তা উপলব্ধি করছে নন-ম্যাট্রিক সাজ্জাদ হোসেন। মন যাদের থইথই করে প্রেমে-আনন্দে, পড়াশোনা মাথায় স্থান পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। অথচ একটা পাস দেওয়ার কত চেষ্টাই না করেছে সে। একদিকে পাসে অকৃতকার্যতা, অন্যদিকে প্রেমেও সীমাহীন অবহেলা। পাত্তা দেয়নি কেউই, তেত্রিশ বছর আসার আর কি খুব বেশি বছর বাকি! মেয়েরা কেন এত নিষ্ঠুর হয়? নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুরা নাকি নিষ্ঠুরাবতী—ব্যাকরণটা ভালো পড়া না থাকায় ‘শনাক্তকরণে’ এসে বরাবরই হোঁচট খায় সাজ্জাদ। প্রাক্তন সহপাঠী, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষকদের খোঁচা মারা কথা ও চোখ রাঙানির মধ্যেই অতিবাহিত হচ্ছে গ্লানিকর দিন-রাত্রিগুলো। শুরুর দিকে স্কুলের বেতন ও ‘নতুন ক্লাসে’ ভর্তি দিতে বাবা আসতেন। বছরের পর বছর আসতে-যেতে যখন দেখলেন সাজ্জাদ স্থায়ী খুঁটি গেড়ে সাবালক হয়ে গেছে, তিনি আসা বন্ধ করলেন। টাকা দিয়ে দেন, সাজ্জাদ নিজেই নিজের ফি জমা দেয়। এই কাজেই তাকে আসতে হলো আজ। সাজ্জাদকে দেখে কেরানি ভদ্রলোক বরাবরই সম্বোধন করেন, ‘কী রে আদুভাই, এসেছিস?’
আজ কপাল ভালো, কেরানি ভদ্রলোক অতিশয় ব্যস্ত। তাই বকা ঝাড়ার সুযোগ পাননি এখনো। ছোট আদুভাই সাজ্জাদ ইতোমধ্যে জেনেছে আদুভাই একটি গল্পের চরিত্র। লেখকের নাম আবুল মনসুর আহমদ। কিন্তু কেন যেন বারবার সাজ্জাদের মনে হয়, নামটা হবে মনসুর আলী। ওর মনে হওয়া নামটা কয়েক জায়গায় বলে হাসি-তামাশার শিকারও হয়েছে। অন্যরা বুদ্ধি দিয়েছে, স্মরণশক্তি বাড়ানোর ওষুধ খাওয়ার জন্য। আহা, যদি তেমন ওষুধই থাকত, সাজ্জাদকে একই ক্লাসে এতগুলো বছর পড়ে থেকে বয়স বাড়াতে হতো না, বাড়াতে হতো না শরীরের উচ্চতা ও বুকের দীর্ঘশ্বাস।
অফিসে জটলার মধ্যেই সাজ্জাদের নজর গেল সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকে। একে আর কখনো স্কুলে দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। মনে চিন্তার রাশি নিয়ে, কপালে ভাঁজ ফেলে ফের তাকাল মেয়েটির চওড়া কপালে। কপাল পেরিয়ে আরও ওপরে উঠলে কী সুন্দর চুলগুচ্ছ দেখা গেল। ফ্যানের হালকা বাতাসে কয়েকটা চুল ইতিউতি স্থানচ্যুত হচ্ছে। নির্লজ্জের মতো তন্ময় হয়ে যে তাকিয়ে থাকবে, সে উপায় নেই। পলকহীন চোখ বেশিক্ষণ ধরেও রাখা যাচ্ছে না। চারপাশেই মানুষ গিজগিজ করছে। নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হচ্ছে অনেকেই। কিচিরমিচির আওয়াজ চারদিকে। এর মধ্যেই সাজ্জাদকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঝাপটে ধরেছে চক্ষুলজ্জা। কিছুক্ষণ পরপর সেদিকে তাকাচ্ছে সাজ্জাদ। চোখাচোখিও হয়েছে তিন-চারবার। হরিণী চোখের সে কী ধার, কী ছায়া ছায়া মায়া! দ্বিমুখী ধার সইতে না পেরে পলকেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে সে। কিন্তু বেয়াড়া মন কি সহজে পোষ মানে! মনকে চাবুক মারলেও কথা শোনে না। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে!
সাজ্জাদ এসেছে নিজের ভর্তি নবায়ন করতে। অফিসকক্ষে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল মেয়েটি সমস্ত দিক আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে চারদিক। ভর্তি-ইচ্ছুক এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে ও তাদের অভিভাবক মিলে কক্ষ টইটম্বুর। সবচেয়ে বেশি মানুষ বাইরে—অপেক্ষমাণ। ওই অনামিকাও বোধ হয় এইট-নাইনের ছাত্রী হবে। ভর্তি ফি দিতে, ভর্তি হতে কিংবা অন্য কোনো কাজে এসে এই জটে পড়েছে। সাজ্জাদ নিজে বেকায়দায় পড়ুক, তাই বলে এই অনামিকাও বাজে পরিণতি ভোগ করবে, মানতে পারল না সে।
কেরানি বেচারা হিমশিম খাচ্ছেন এতগুলো মানুষকে সামাল দিতে। ঘেমে-নেয়ে একাকার। উর্বশীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে সাজ্জাদ। কীভাবে তার কাছাকাছি হওয়া যায়। অল্প সময়ে বিস্তর ভাবনা শেষে বুদ্ধি এসে ধরা দিল। স্কুলের পুরোনো বাসিন্দা হিসেবেও ওর একধরনের অধিকারবোধ তো আছেই। ধীর পায়ে এগিয়ে সামনে দাঁড়াল। ললনাও বোধ হয় এতক্ষণ ধরে ওর হাবভাবে কিছু আঁচ করে থাকবে। সামনে দাঁড়াতে দেখেই সে সকৌতুকে মুখ তুলে তাকাল। সাজ্জাদ এই প্রথম তাকে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পেল। গোলাপি রঙা সালোয়ার-কামিজ পরনে। চুমকির কাজ করা শুভ্র-সফেদ ওড়না। পায়ে চটি জুতা। কৃষ্ণকালো চুলরাশিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে রাবার ব্যান্ড। প্রসাধনহীন মুখ, কপালে শুধু ছোট্ট একটা টিপ। এই এক টিপই সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। সব মিলিয়ে মুখাবয়ব স্থির শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব আছে।
প্রিয়দর্শিনী কোন ক্লাসে পড়ে অথবা সে কোন ক্লাসে ভর্তি হতে এসেছে, সরাসরি জিজ্ঞেস করতেও বাধছে। যদি কিছু মনে-টনে করে বসে, ‘মাইন্ড’ খায়! কিছুক্ষণ পর কায়দা করে বলল সাজ্জাদ, ‘কোন ক্লাসের ফি দিচ্ছেন?’
‘নাইনের।’ স্মিত হেসে বলল।
‘কোন বিভাগে?’ অভিভাবকসুলভ আচরণ ফোটাতে চেষ্টা করে সাজ্জাদ।
‘আর্টসে।’
‘বলেন কী!’
‘কী বলতে হবে?’
‘ইয়ে...আর্টস না, আপনি কমার্স নিন। এখন কমার্সের যুগ। কমার্স ছাড়া গতি নেই। কমার্স পড়লে ই-কমার্স বিষয়টা সহজে বুঝতে পারবেন। আগে ছিল ঘরে ঘরে কুটিরশিল্প, এখন এসেছে ঘরে ঘরে ই-কমার্স! উদ্যোক্তা হওয়ার সুবর্ণ যুগ।’
কমার্সে পড়ার সুবিধা কী, চারপাশের হট্টগোলের মধ্যে ধৈর্য নিয়ে বয়ান দিল। সাজ্জাদ নিজেও কমার্সের ছাত্র। ক্লাসের প্রথম দিন স্যার যে মহামূল্যবান কথাটি বলেছেন তা-ও মুক্তা ইয়াসমিনকে জানাতে ভুলল না। কথার ফাঁকে জেনে নিয়েছে নাম। স্যারের কথাগুলোই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ডেলিভারি দিল। স্যার বলেছিলেন ‘তোমরা যারা বিষয় হিসেবে আর্টস না নিয়ে কমার্স নিয়েছ, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছ। বোকাগুলোই আর্টস নিয়েছে। ইতিহাসের একটা গল্প বলি তোমাদের। প্রাচীন বাংলায় নদিয়ার রাজা লক্ষ্মণ সেনকে সতেরোজন অশ্বারোহী নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি আক্রমণ করার জন্য যাচ্ছিলেন। এ খবর যায় লক্ষ্মণ সেনের কানে। তিনি খাচ্ছিলেন। শত্রু এগিয়ে আসছে শুনে লক্ষ্মণ সেন খাওয়া রেখে তড়িঘড়ি করে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন! তোমরা এখান থেকে, মরা মানুষের প্যাঁচালি থেকে কিছু নাম আর সন-তারিখ মুখস্থ করা ছাড়া আর কী শিখবে? শিক্ষণীয় কিছু আছে নাকি!’
স্যারের সরস মন্তব্যে পুরো ক্লাসে হাসির হুল্লোড় পড়ে গিয়েছিল। সাজ্জাদ নিজেও হুজুগে হেসেছে। মানবিকের শিক্ষার্থীদের করুণা করে ‘নির্বোধ’ ভেবেছে। সায়েন্স বানান যেহেতু কঠিন, ওদিকে মনোযোগ দেয়নি তেমন কেউই। কিন্তু তারপর যখন ক্লাস পুরোদমে শুরু হলো, ডেবিট-ক্রেডিট ফিট হলো না, জাবেদা-রেওয়ামিলকে কেবলই গোঁজামিল মনে হলো। বুঝল অন্য কেউ নয়, নির্বোধ সে নিজেই! স্যারের কথা শুনে আর্টসের নামে নাক সিঁটকেছে। আর্টসই পরে আমার পরম আরাধ্য হয়ে উঠল! চেষ্টা করল গ্রুপ পাল্টে আর্টসে যেতে। তদ্দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সহপাঠীরা অবলীলায় লক্ষ কোটি টাকার হিসাব বের করে ফেলে। সেখানে সাজ্জাদ সাড়ে তিন টাকার হিসাব মেলাতে ভিমরি খায়! দশমিকের হিসাব সবচেয়ে প্যাঁচানো। পাঁচ-দশ পয়সা ছেড়ে দিয়ে হিসাব করলে ক্ষতিটা কী, বুঝতে পারে না। হিসাববিজ্ঞানীরা এত ছোটলোক কেন! স্যারদের নিজের অক্ষমতার কথা জানালে বলেন, মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি কম। বানর গলায় মুক্তার মালা পরেছে। আরও কত অপমানজনক উক্তি সহ্য করেছে সাজ্জাদ! তবু কী এক দুর্বোধ্য কারণে কমার্স পছন্দ করে! নিজে না পারলেও অন্যকে উপযাচক হয়ে কমার্স পড়ার পরামর্শ দেয়! এটা কি স্যারের কাছ থেকে শোনা লক্ষ্মণ সেনের মজাদার গল্পের কারণে!
জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা ঝাড়ার পর অবশেষে থামল সাজ্জাদ। থামতে বাধ্য হলো। কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না বলার মতো। ওকে থামতে দেখে প্রিয়ংবদা (!) মুখ খুলল এবার। অসম্ভব রকমের শীতল গলা তার, ‘আপনার বলা শেষ, নাকি আরও বাকি আছে?’
‘আপাতত শেষ।’ আত্মপ্রসাদের হাসি ঠোঁটে। হাবভাব কলেজে নতুন নিয়োগ পাওয়া লেকচারারের মতো!
‘তাহলে শুনুন, আমি বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। নিজে পড়াইও। এখানে এসেছি ফুফাতো ভাইকে ভর্তি করাতে। ভর্তি হতে নয়!’
শুনে মুখ চুন হয়ে যায় সাজ্জাদের। এত্ত বড় ভুল কীভাবে হলো? এ মেয়েকে দেখতে তো স্কুলপড়ুয়া বলেই মনে হয়। মেয়েদের বয়স অনুমান করা আসলেই কঠিন। এই বর্ণচোরা (!) মেয়ে কী ভাবছে মনে মনে…। ধরণী দ্বিধা হও! লজ্জার হাত থেকে বাঁচাও। কাজ অসমাপ্ত রেখে নীরবে প্রস্থান করল সাজ্জাদ। শুধু বিদায়ের আগে ভিতু কাপুরুষের মতো মুক্তার দিকে একপলক তাকাল; যার অর্থ—আসি তাহলে!
তারপর আরেক দিন মুক্তার সঙ্গে দেখা হলো। সেদিন বিকালবেলায় উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিল সাজ্জাদ। দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে মনে মনে কী সব প্যাঁচ কষছিল। আচমকা পাশ থেকে সুরেলা আওয়াজ, ‘এক্সকিউজ মি...।’
পেত্নি দেখার মতো চমকে উঠল সাজ্জাদ। মানুষ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। কিন্তু ভূত শব্দটা পুরুষ লিঙ্গ। সুতরাং মুক্তাকে দেখে ‘ভূত দেখা’র মতো চমকে ওঠা যায় না, পেত্নি দেখার মতোই চমকাতে হবে! বিপদের সময়ও আজ ব্যাকরণ সঠিক নিয়মে কাজ করল! কিন্তু ও এখানে কেন? কিংবা সাজ্জাদইবা ওর সামনে কেন! দস্যুরাণীর দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে কাঁপা কাঁপাভাবে বলল, ‘আরে, আপনি! কেমন আছেন?’
‘চিনতে পেরেছেন তো? নাকি ভদ্রতা করে চেনার ভান করছেন?’
‘কী যে বলেন! আপনাকে চিনব না? আপনি হচ্ছেন মুক্তা ইয়াসমিন বিএসসি।’
‘তবু ভালো বিসিএস বলেননি!’
‘এই দুইয়ের পার্থক্য আমি বুঝতে শিখেছি। আগেকার দিনের মানুষরা নামের পাশে বিএসসি, বিএ, এমএ...এসব লিখতেন।’
‘তাহলে আমি পাস করার আগেই নামের পাশে বিএসসি লেখা শুরু করব?’
নিজের রসিকতায় কিংবা সাজ্জাদের নির্বুদ্ধিতায় মুক্তা হাসে। সাজ্জাদও অনুকরণের চেষ্টা করে। তবে ওর হাসি সলজ্জ, ত্যানামার্কা মিনমিনে টাইপের। হঠাৎ মুক্তা বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, আপনাদের এলাকায় নাকি কে একজন বাতের ওষুধ বিক্রি করে। তাকে দরকার। চেনেন নাকি?’
এই মেয়ে ফাজলামি করছে না তো! নাকি নতুন কোনো চাল!
আবার ভেজাল হাসি ঝোলায় ঠোঁটে, ‘না তো, এ ধরনের কাউকে জানি না।’
মুক্তা ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে দেয়, ‘যদি সন্ধান পান, কাইন্ডলি আমাকে একটু জানাবেন।’
ভিজিটিং কার্ডও ব্যবহার করে! কী লেখা এখানে? হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নেয়। বিদায় নিয়ে যেই না চোখের আড়াল হয় মুক্তা, অমনি কুচি কুচি করে কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে।
দেখতে দেখতে এগিয়ে আসে পরীক্ষায় সময়। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পরীক্ষা এগিয়ে এলে বাঘের তাড়া। ফাইনাল পরীক্ষা, ভাবতেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে। শুনতে পাচ্ছে, এবার নাকি নকলেরও সুযোগ নেই। শিক্ষামন্ত্রী আগ থেকেই হুঁশিয়ারি সংকেত দিচ্ছেন! নকল ছাড়া কি আর পরীক্ষায় পাস করা যায়? বিশেষ করে সাজ্জাদের মতো বীরপুঙ্গবদের দ্বারা তা কি কখনো হওয়ার! অথচ বিষয়টা কলেজশিক্ষক, শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তা, সরকার, কেউই বুঝতে চায় না!
সময় কীভাবে চলে যায়! সহপাঠিনীদের মন কবজা করতে যত রকম কসরত করতে হয়, তার সবই তো একে একে অনুসরণ করে গেছে। এই বাইরেও আছে গার্লস স্কুল, অন্য কলেজের মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সেখানে গিয়ে গেটের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা...সাজ্জাদের আরও কত শত কাজ! রাত জেগে মনের ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে কাব্য বের করে প্রেমপত্র লেখাও কি কম ঝামেলার ব্যাপার! কাব্যরসও কি বের হয় সহজে! এত সব উটকো ঝামেলায় যেতে হয় কেন। বাজারের পুরোনো বইয়ের দোকানে প্রেমপ্রত্র লিখনপদ্ধতি শিখনকৌশল, সচিত্র প্রেমপত্র এ রকম অনেক গাইড বই পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলোর সাহায্যও নিতে পারছে না। গত বছর ধরা খেয়েছিল। সহপাঠিনী ইরিনাকে সচিত্র প্রেমপত্র গাইড দেখে চিঠি লিখেছিল। পরদিন প্রেম না এসে অভিযোগ এলো—‘দেখে দেখেই তো লিখেছিস, তা-ও বানান ভুল হয় কেন? নকল গাইড কিনেছিস বোধ হয়। আমি তোর জন্য আসল গাইডটাই নিয়ে এসেছি।’ ইরিনা যে গাইডটি উপহার (!) দিল সেটা দেখে দেখে সাজ্জাদ ঠিকই চিঠি লিখেছিল। লিখে অন্য মেয়েদের চিঠি দিয়েছে। ইরিনাকে বিশ্বাস করা যায় না। নইলে ওর কাছে এই গাইড থাকবে কেন। নিশ্চয়ই ও নিজেই এমন ধরনের লেখাপড়ার চর্চায় মশগুল।
সাজ্জাদের পরীক্ষা-চিন্তার কাঁপাকাঁপি দেখে উপযাচক হয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী বশীর উদদৌলা পরামর্শ দিলেন, ‘দূরের মহল্লায় একজন ইংরেজির ম্যাডাম আছেন; খুব ভালো পড়ান। ইচ্ছা করলে পড়তে পারো। এবারও পাস করতে না পারলে সমস্যা হয়ে যাবে। তোমার বাবা নিশ্চয়ই এবার একা পেটাবেন না। লাঠিয়াল বাহিনীও নিয়োগ দেবেন।’
উত্তম পরামর্শ। পরীক্ষা নামক পুলসিরাতে সবচেয়ে বড় বাধা ইংরেজি। দু-চারটা রোমান্টিক সংলাপ, কবিতার লাইন ছাড়া ইংরেজি জানে না বললেই চলে। দুই মাসেই ইংরেজির জাহাজ হয়ে যেতে হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন নিয়ে ইংরেজিতে অনার্স করা যাবে! সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে একদিন সাজ্জাদ হাজির হলো ম্যাডামের বাসায়।
গিয়ে তো চক্ষু গাছে চড়ার জোগাড়। এ যে মুক্তা ইয়াসমিন! তিনিই এখানকার ম্যাডাম! তখন একটা ব্যাচ পড়ছিল। অনেক ছেলেমেয়ের সামনেই সাজ্জাদকে সম্ভাষণ করল, ‘আসুন। কী সৌভাগ্য, আপনার দেখা পেলাম!’
সাজ্জাদের ভেতরে-বাইরে খবর হয়ে গেছে। এখানে, মুক্তার কাছে পড়বে, মাথা খারাপ! কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে সটকে পড়তে হবে। বুদ্ধি চলেও এলো মাথায়। কুবুদ্ধি নাকি শয়তানের আগে আগে দৌড়ায়! গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না কেন! মনে হচ্ছে, কে যেন জিহ্বাটা সুপার গ্লু দিয়ে ভেতর থেকে আটকে দিয়েছে। কোনোরকমে বলতে পারল, ‘বাতের ওষুধ দেয় এমন কাউকে খুঁজে পাইনি। যদিও অনেক দিন ধরে খুঁজেছি। তাকে যে পাইনি খবরটা আপনাকে জানাতে এলাম!’
‘কার বাত হয়েছে?’
‘আপনারই তো বাত। আমাদের এলাকায় গিয়ে ডাক্তারের সন্ধান জানতে চেয়েছিলেন...।’
‘আপনার বাতচিত সুবিধার ঠেকছে না। আমার বাত হবে কেন! ডাক্তার দিয়েইবা কী করব!’
‘তাহলে বোধ হয় আমারই হয়েছে রোগটা! রসবাত গেঁটেবাত আমবাত জামবাত...সবই!’
মুক্তার সঙ্গে কথা আর এগোয়নি। নীরবে কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে সাজ্জাদ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকচিরে—সময়মতো পড়াশোনা শেষ করতে পারলে মুক্তার মতো ওর একজন প্রেমিকা থাকতে পারত। তখন মুক্তার এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথার বদলে শোনা যেত অন্য ধরনের আলাপ, হ্যাঁগো, ওগো, শুনছ গো...!
নকলমুক্ত পরিবেশ বহাল থাকায় যথারীতি এবারও পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলো সাজ্জাদ। বাবা বললেন, ‘চ্যালা কাঠ দিয়ে তোকে পিটিয়ে লাকড়ির অপমান করব না। আগেও অনেক অপচয় করেছি। স্কুল-কলেজের বারান্দায় অনেক টাকা খরচ করেছি। চাইলে এই টাকায় গরু-ছাগল কিনে পুষতে পারতাম। সেটাই হতো লাভজনক বিনিয়োগ। এবার তুই কোনো একটা স্কুল-কলেজের দারোয়ানের চাকরি জোটাতে পারিস কি না দেখ। সারা দিন শিক্ষিত ছেলেমেয়ের আনাগোনা দেখবি। এটাও কম সাফল্য হবে না!’
সাজ্জাদ বলল, ‘বুদ্ধিটা খারাপ দাওনি বাবা। কিন্তু কথা হচ্ছে, সেই স্কুল বা কলেজে যদি মুক্তা শিক্ষক হয়ে আসে! মানে ওর যদি চাকরি হয়ে যায়?’
‘চাকরি হওয়া তো ভালো। কোন মুক্তার কথা বলছিস?’
সলজ্জ হেসে সাজ্জাদ বলল, ‘মুক্তা ইয়াসমিন তোমাদের ভবিষ্যৎ পুত্রবধূ। ফিফটি ফিফটি সম্ভাবনা। মানে আমি রাজি, ও সম্মতি দিলেই...।’
কখন যেন মা এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। টিপ্পনি কেটে বললেন, ‘ঠিক কথাই বলেছিস। আমাদের রাজি-অরাজির তোয়াক্কা তুই করবি কেন!’
বাবা আচরণগত ত্রুটি খুঁজলেন না। বললেন, ‘মেয়েটা নিশ্চয়ই তোর মতো এমন বদখত নয়! একদিন চায়ের দাওয়াত দিয়ে বাসায় নিয়ে আসিস।’
আর্তনাদ করে উঠল সাজ্জাদ, ‘না, বাবা। ভুলেও এমন কাজ করতে বোলো না। দাওয়াত দিতে গেলে মুক্তা আমাকে ওর কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেবে! তখন চাকরি যাবে, পড়াশোনাও যাবে; মান-ইজ্জত যাবে সবার আগে!’
‘মান-ইজ্জত যাবে! তার মানে সেটা এখনো তুই ধরে রেখেছিস?’
রাগ করে ঘরের বাইরে বেরোতে যাবে সাজ্জাদ, হঠাৎ স্ট্যাচুর মতো থমকে গেল। কোথায় যাবে সে, সামনেই যখন দাঁড়িয়ে জলজ্যান্ত হেড মিস্ট্রেস মুক্তা ইয়াসমিন! মুক্তা বাবা-মাকে সালাম দিয়ে ফিরল সাজ্জাদের দিকে। হেসে বলল, ‘কেমন আছেন, সাজ্জাদ সাহেব?’
কে যেন ওকে দিয়ে বলিয়ে নিল, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?’
‘আমিও ভালো। চা খেতে এলাম। আরও একটা খবর জানানোর ছিল।’
‘কী খবর? তুমি নতুন কোনো পাস দাওনি তো! মানে উচ্চতর কোনো ডিগ্রি অর্জন...!’
‘না। তবে কোনোটাই ঠেকে থাকবে না নিশ্চয়ই। আমাদের কোচিং সেন্টারে একজন দপ্তরি কাম প্রহরী নিয়োগ হবে। আপনি নাকি চাকরি খুঁজছেন। এই চাকরি করবেন কি না, প্রস্তাব দিতে এসেছি।’
‘আমি সব করতে রাজি, মুক্তা। তার আগে কথা দাও, তুমি আমাকে বিয়ে করবে!’
বাবা-মা কখন বেরিয়ে গেছেন দুজনের একজনও খেয়াল করেনি। মুক্তা হাসল; তারপর কান পেতে শুনল চিনি চামচের টুংটাং আওয়াজ। নিশ্চয়ই মা চা বানাচ্ছেন!
কিছুক্ষণের মধ্যে চা এসেও গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে মুক্তা বলল, ‘তুমি ইদানীং বাংলা সিনেমা বেশি দেখছ নাকি আগে থেকেই দেখতে!’
‘আমি সারা জীবন একটা সিনেমাই দেখেছি, এ জীবন তোমার আমার। আমি রিয়াজ হলে তুমি পূর্ণিমা হতে পারবে না?’
‘তার আগে বল, আমি শিক্ষক হলে তোমার ছাত্র হতে আপত্তি কেন!’
‘এখন মনে হচ্ছে, তুমি নিজেই তামিল চলচ্চিত্রের পাঁড় ভক্ত!’
কোত্থেকে যেন ফিরে এসেছেন বাবা। উপস্থিতি জানান দিলেন কথায়, ‘তা আমাদের পারিবারিক সিনেমাটার মহরত হচ্ছে কবে?’
