• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
গল্প

রাজনীতি অথবা সময়ের দাগ


মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৩, ১১:৪৭ এএম
রাজনীতি অথবা সময়ের দাগ

আকাশ থমথমে—প্রবল দুঃখে হৃদয়ভাঙা তরুণীর মতো। যেন সামান্য কথার আঘাতেই কেঁদে দেবে। সেই কান্নার স্রোতে তরুণীর যেমন বুক ভেসে যাবে, তেমনি পৃথিবীতেও নেমে আসবে নূহের প্লাবন। প্রমাদ গোনে শ্যামলেন্দু সরকার—যে দলে একদা সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল তার, আজ কেন একজন কর্মীও গুরুত্ব দেয় না! সুবিমল মিত্র ছিলেন নামে মাত্র প্রেসিডেন্ট। অলংকার বৈ তো কিছু নয়। সেক্রেটারি শ্যামলের ইচ্ছাই শেষ কথা ছিল। অথচ আজ দাবার চাল উল্টে গেল! কপাল চাপড়ায় শ্যামল।

মনে পড়ে—পার্টি তখন বিরোধী দলে। সরকারবিরোধী স্লোগান-বক্তৃতায় মঞ্চ কাঁপানোই ছিল শ্যামলের দলের নেতাকর্মীদের নিত্যদিনের কাজ। ‘জন দরদি পার্টি’র সেক্রেটারি হিসেবে তার দাপট ছিল বেশুমার। জনশ্রুতি আছে—যখন সে গর্জন করে উঠতো, সেই বজ্রকণ্ঠের ডাকে মানুষ তো মানুষ, আশপাশের বিল্ডিংগুলোও নাকি থরথর করে কেঁপে উঠত। অবশ্যই এসব কথা শ্যামল নিজে কখনো বলে না। তবে অনুচর-অনুসারীরা যখন তাকে শোনায়, তখন সে খুব পুলকিত হয়। নিজেকে তার ‘হিরকরাজ’ ‘হিরকরাজ’ মনে হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে মহাভারতের শকুনিও মনে হয় তার। মনে হয়—রাজনীতির মাঠে যে যেমন খেলুক, ভাইয়ে ভাইয়ের রণক্লান্ত হোক, ফসল কিন্তু শ্যামলের ঘরেই উঠবে। সে জানে—ক্ষমতার একটা পাগলা ঘোড়া স্বভাব আছে। শক্ত হাতে তার লাগাম ধরতে না পারলে চিতপটাংয়ের আশঙ্কা থাকেই। শ্যামল সেই শঙ্কা সম্পর্কে সচেতন ছিল। তাই দলের ভেতর দ্বিতীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠতে দেয়নি কখনো।

বেশ কিছু জনস্বার্থশ্লিষ্ট বিষয়ে রাজপথে আন্দোলনের ডাক দেওয়ায় এক বছরে ‘জন দরদি পার্টি’র জনসমর্থন অনেক বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে কর্মীর সংখ্যা—পাল্লা দিয়ে নেতাও।

দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। তাই সেক্রেটারি হিসেবে একহাতে সব সামলানো বেশ কঠিন হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে সরকারপ্রধানের সঙ্গে দুই দফা সংলাপে বসেছে তার দল। বৈঠকগুলোয় দলীয় প্রধানের চেয়ে তার গলা ছিল বেশ চড়া। দলের ভেতরে-বাইরে বেশ বাহবা জুটেছে তার। যেন মৌচাকে মৌমাছির জমানোর মধুর সঙ্গে আনাড়ি চাষিও চিনির রস মিশিয়ে দিচ্ছে। সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। এই সুনাম তাকে দুই দিক থেকে লাভবান করেছে। প্রথমত, দলের ভেতর তার প্রভাব বেড়েছে দ্বিগুণ। দ্বিতীয়ত, সুন্দরী নেত্রীরা কথায় কথায় তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিন ব্যথা করে তার। কিন্তু কী সেই ব্যথা, তা সে বুঝতে পারে না। বিশেষত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নাসরিনকে দেখলে বুকের ভেতর কেমন যেন কাঁপুনি ধরে। কিন্তু নাসরিনকে সে ঠিক বুঝতে পারে না। শ্যামল ভাবে, গ্রাম্য একটা স্বভাব নাসরিনের ভেতর রয়ে গেছে। সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হয়েও যদি মফস্বলীয় স্বভাব পাল্টাতে না পারে, তার সঙ্গে আসলে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। কিন্তু মেয়েটা খুবই পরিশ্রমী। দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। মিছিল বলো, মিটিং বলো, স্লোগান বলো, বক্তৃতা বলো—সর্বত্রই তার সদর্প উপস্থিতি। আরেক সদস্য রেবতী—বেশ স্মার্ট। কথা বলে গুছিয়ে। কোনো তদবির থাকলে তো আর কথাই নেই—একদম শ্যামলের পিঠের সঙ্গে ঝুঁকে কথা বলে। শ্যামল তখন টের পায়—বুকের দুটি পিনদ্ধ বলের কোমল পরশ তার পিঠকে ছুঁয়ে যায়। তাতে তার মেরুদণ্ড বেয়ে বিদ্যুৎ চমকে চমকে নিচের দিকে নেমে যায়। তাকে অশান্ত করে তোলে। সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মোমের মতো গলতে থাকে। সে চায় রেবতীকেও আগুনে পোড়াতে। একসময় তার মনে হয়, আগুন নিয়ে খেলার প্রতিযোগিতায় এক ধাপ এগিয়ে রেবতী। শ্যামল ভাবে—রেবতীকে পটাবে, রেবতী ভাবে তাকে নাচাবে। আর আড়ালে দলের জুনিয়ার নেতা রাজীব ভাবে—কে কার ধান্দায়, কাকে যে নাচায়, কেবল অন্তর্যামীই জানে।

সেদিন তুমুল বৃষ্টি শেষে হিমেল হাওয়া বইছে। পার্টি অফিসে জানালার পাশে বসে আছে শ্যামল। ভাবছে দল দিন দিন বড় হচ্ছে। বাড়ছে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও। একহাতে সব সামলানো কঠিন। দলে একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি দরকার। কাকে এই পদে আনা যায়? নাসরিন খুবই দায়িত্বশীল। কিন্তু শুধু দায়িত্বশীল হলে তো চলে না, শ্যামলের ইচ্ছা-অনিচ্ছাও তো বুঝতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দলের প্রেসিডেন্টের কাছে শ্যামলের প্রশংসা করতে হবে। সে যে দলের গুরুত্বপূর্ণ আর অনিবার্য মাথা, এটা সবাইকে বিশ্বাস করাতে হবে। শ্যামল জানে—এই কাজ তো নাসরিনকে দিয়ে সম্ভব নয়। রেবতী হলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। প্রথমত, শ্যামলের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সাড়া দেওয়া। দ্বিতীয়ত, তাকে দিয়ে দলীয় প্রধানের কাছ থেকে সুবিধা আদায়। শ্যামল-রেবতীতে চমৎকার রাজনৈতিক অধ্যায় রচিত হতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে বহুদিন ভেবেছে শ্যামল। তাতে কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। বরং অস্থিরতা বেড়েছে। স্বাভাবিক কাজকর্মে তার মন নেই। যে কাজ আগে করার কথা, সেটি পড়ে থাকছে। যেটি করারই কথা নয়, তা করার জন্যই মন আকুলি-বিকুলি করছে। নাসরিন-রেবতী দুজনকেই শ্যামল বাজিয়ে দেখতে চায়। তাই একদিন নাসরিনকে ডাকে। বলে, শুনেছেন তো, লিডার চেয়েছেন একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচন করতে।

—হ্যাঁ লিডার। শুনেছি।
—কাকে আপনার যোগ্য মনে হয়।
—আপনি কী ভাবছেন? 
—রেবতী আর আপনার মধ্যে একজনকে নির্বাচনের পক্ষে আমি।
—ভালো তো। আপনি তো আমার ডেডিকেশন জানেন। আমাকে নির্বাচন করলে দল ঠকবে না। নিশ্চয়তা দিতে পারি।

—আপনি যে ডেডিকেশনের কথা বলছেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। আরও কিছু চাই ...
—আরও কিছু মানে?
—এই ধরুন, বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করা। বিদেশি কূটনীতিকদের মাধ্যমে বর্হিবিশ্বের কাছে আমাদের দলের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরা। আর আমার সঙ্গে ট্যুরে যাওয়া। তা-ও দলীয় কাজে। বোঝেনই তো, বলতে বলতে ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে তোলে শ্যামল।

—সরি। আমি বুঝলাম না। ট্যুরে যাওয়ার সঙ্গে দলীয় কর্মসূচির সম্পর্ক কী?
—না বুঝতে চাইলে বোঝানো কঠিন।
—আচ্ছা। মনে মনে বলে, শ্যামলবাবু, আপনাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। এমন লোলুপ লিডার দলে আর একটাও নাই।

নাসরিনের সঙ্গে বোঝাপড়া হলো না দেখে শ্যামল বরং খুশিই। ঠিক তখনই দেয়ালে একটি টিকটিকি টিকটিক করে উঠল। সেই ডাকে মৃদু হাসির ঢেউ খেলে গেল শ্যামলের চোখেমুখে। হয়তো মনেও। এবার রেবতীর ডাক পড়ে।

—দলে একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচন করা হবে। জানেন তো?
—হুম। শুনেছি। আপনার কাকে পছন্দ।
—দলের নেতাই চান নাসরিনকে। জানেন তো, তার ডেডিকেশন কেমন।
—জানি। কিন্তু আপনি কাকে চান? আসলে কে কী, সেটা তো বড় কথা নয়। বড় কথা হলো আপনি কী চান।
—তাহলে আপনি বুঝতেই পারছেন, সবকিছুই আমার হাতে। তাই সোজাসুজি একটা কথা বলি। শুধু দলের প্রতি ডেডিকেশনেই সব হয় না। সেক্রেটারির সঙ্গেও মনের মিল-অমিল বলে একটা কথা আছে।
—তা তো অবশ্যই। আমাকে যদি জয়েন্ট সেক্রেটারি করেন, তার জন্য কী করতে হবে?
—তেমন কিছু না—বলেই ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখে শ্যামল।
—বুঝেছি।
—তাহলে আর কী, ওই কথাই রইল। মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকুন।

রেবতীর সাড়া পেয়ে শ্যামলের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। চিত্তের এই চাঞ্চল্য ধরা পড়ে স্থায়ী কমিটির কনিষ্ঠ সদস্য রাজীবের চোখে। তার মনে হয়, লিডার ভুল পথে এগোচ্ছেন। বিপদ ডেকে আনছেন। ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য রাজীবের বেশ দুর্নাম আছে। সে অবশ্যই দুর্নামের ধার ধারে না। তাই একদিন মুখোমুখি হয় শ্যামলের—লিডার, আপনি কিন্তু দিন দিন ভুল পথে যাচ্ছেন। আপনার মতিগতি ভালো ঠেকছে না। শুনে ক্ষেপে ওঠে শ্যামল। রাজীবকে শাসায়, কী বলতে চাও তুমি? আমি ভুল করছি? এতকাল আমি ভুল করে করে পার্টিকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছি? কী ভুল করেছি? মুখ সামলে কথা বলো।

শ্যামল রেগে গেলে রাজীবও অভিমান করে। বলে, আপনি লিডার, আপনি যা করেন, তার সবই যদি মনে করেন ঠিক আছে, তবে ঠিক আছে। আমার আর কিছু বলার নেই। কিন্তু কী কী ভুল করছেন, আপনিই ভালো জানেন। শুধু এটুকু বলব, একজনকে কিছু দেওয়ার জন্য বিনিময় আশা করেছেন। বিনিময় পাননি। তাই অন্য কাউকে দিলেন। এতে বঞ্চিত লোক ঠিকই ধরে নেবে, আপনি যাকে দিলেন, তার কাছ থেকে বিনিময় কী দিয়েছেন। আপনি পাপ করে চলেছেন। পাপের ঘড়া পূর্ণ হলে আপনার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। একজন জুনিয়ার নেতার মুখে এমন নীতিকথা শোনার জন্য শ্যামল প্রস্তুত ছিল না। তাই সে ক্ষেপে ওঠে, বের হও বেয়াদব। শ্যামল আর কথা বাড়ায় না। নিঃশব্দে বিড়াল-পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে আসে।

পরদিন জয়েন্ট সেক্রেটারির নাম ঘোষণার আয়োজন চলে। দলের মধ্যম সারির নেতাদের প্রত্যাশা—নাসরিনই পাবে এই পদ। অধিকাংশই পার্টি অফিসে ক্ষণে-ক্ষণে নাসরিনের নামে স্লোগান দিতে থাকে। স্লোগানের ভেতরই মেঞ্চে  হাজির সুবিমল মিত্র ও শ্যামলেন্দু সরকার। ছোট্ট একটা ভূমিকার পরই শ্যামল দলের জয়েন্ট সেক্রেটারির নাম ঘোষণা করে। জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে রেবতীর নাম শুনে হাতেগোনা কয়েকজনকে হাততালি দিতে দেখা গেল। বাকিরা নীরব। যেন হঠাৎই ফসলের মাঠে বজ্রঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেল কৃষকের দল। তারা দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আছে, কিন্তু মুখে কোনো রা নেই। হাত-পা নাড়াচাড়া নেই। একেবারে পাথরের মূর্তির মতো স্থবির।

এমন পরিস্থিতি হবে, আভাস পেলেও তাকে হতাশ হতে হবে—এতটা ভাবেনি শ্যামল। সে এবার প্রমাদ গোনে। ভাবে—তার সিদ্ধান্তের প্রতি এটা নেতাদের অবজ্ঞা নয়তো! নেতাদের এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। গলা পরিষ্কার করে। বলে, দেখুন। দল চালানোর জন্য সঠিক লোকের হাতে সঠিক দায়িত্ব দেওয়া উচিত। দলের হাইকমান্ড যাকে এই পদে যোগ্য মনে করেছেন, তাকেই নির্বাচন করেছেন। সবার উচিত, হাইকমান্ডের নির্দেশ মেনে চলা। শ্যামলের ঘোষণা শুনে দুই-চারজন উচ্ছ্বসিত। বাকিরা পূর্ববৎ স্থাণু-স্থবির। কেবল একজনকে দেখা গেল দর্শক-শ্রোতার সারি থেকে মাথা নিচু করে দরজা গলিয়ে বের হয়ে গেল। নাসরিনকে বেরিয়ে যেতে দেখে মৃদু হেসে মাথা নাড়ে রেবতী। রেবতীর ওই মুহূর্তের উচ্ছ্বাস দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয় রাজীব।

নতুন জয়েন্ট সেক্রেটারি রেবতী সম্পাদক শ্যামলের সঙ্গে বেশ কিছুদিন সদ্ভাব বজায় রাখে। হঠাৎ একদিন শ্যামল আবিষ্কার করে—রেবতী আর আগের মতো তার কথা শুনছে না। তাকে এড়িয়ে চলছে। একাই দলীয় প্রধানের সঙ্গে মিটিং করছে। বিভিন্ন কর্মসূচি-সভা-মিছিল-জনসভার প্রেস রিলিজ দিচ্ছে রেবতী। তাতে প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে রেবতীরই স্বাক্ষর থাকছে। এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোনো পরামর্শ করছে না শ্যামলের সঙ্গে সুবিমল বা রেবতী—কেউই। রেবতী আজকাল শ্যামলের ফোনও রিসিভ করছে না। আধো আমের সঙ্গে যেভাবে সিঁদুর রং লেগে থাকে, রেবতীর মুখেও তেমন একটা বিরক্তি ও ব্যস্ততার ভাব লেপ্টেই থাকে। সেই প্রলেপ সরিয়ে তার মন-মর্জির আসল ঠিকানার সন্ধান পাওয়া আর সম্ভব হয় না শ্যামলের।

দুই.

সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। পার্টির নেতারা চান—সরকার পতনের এক দফা দাবি। কেন্দ্রীয় নেতাদের চিন্তা ভিন্ন। বিশেষ করে দলের সেক্রেটারি শ্যামলসহ মধ্যম সারির নেতাদের ইচ্ছা হোক। সুবিমল মিত্র-রেবতীসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের পরিকল্পনা—দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলা। ফলে সরকারবিরোধী কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুরো দল দুই ভাগে বিভক্ত। দেখতে দেখতে দল পড়ে শোচনীয় অবস্থায়। মওকা বুঝে গণমাধ্যমগুলোও সংবাদের শিরোনাম দিচ্ছে ‘জন দরদি পার্টিতে ভাঙনের সুর বাজে।’ প্রথম সারির প্রায় সব দৈনিক ও অনলাইন নিউজপোর্টালের শিরোনাম একই ধরনের। গণমাধ্যমগুলো সুযোগ বুঝে দুই শিবিরের শীর্ষ নেতাদের বুদ্ধির গোড়ায় জল ঢালছে। সেই জল পেয়ে নেতাদের বুদ্ধির চারা ধীরে ধীরে বৃক্ষে পরিণত হচ্ছে। কেউ বলছেন, দলে বিভাজন তৈরি হচ্ছে সরকারের ইন্ধনে। কেউ বলছে, দলে সরকারবিরোধিতার নামে কোনো কোনো নেতার ভূমিকা প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এসব কথা শুরুতে কয়েক দিন অফ দ্য রেকর্ড হিসেবে সাংবাদিকদের কাছে নেতারা বললেও এখন রাজপথেই বলছেন। তাই দলীয় কোন্দলের খবর টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। এতে সুবিমল ও শ্যামলের মধ্যে দিনে-দিনে দূরত্ব বাড়ছেই। সুবিমল জরুরি মিটিং ডাকেন। মিটিংয়ে রেবতীসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা থাকলেও শ্যামলকে ডাকেন না।

সভাপতির স্বাগত বক্তব্যের পর উঠে দাঁড়ান মধ্যম সারির এক নেতা। তার মুখ দেখতে পান না সুবিমল-রেবতীরা। ওই নেতা বলেন, দলে যে আজ ভাঙনের সুর বাজছে, তার দায় একা শ্যামল বাবুর। আমরা তার বহিষ্কার চাই। দ্বিতীয় নেতা খানিকটা কেশে নিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেন, আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে? এবার প্রথম বক্তা খেকিয়ে ওঠেন—আপনার দরদ দেখছি উথলে উঠছে। শ্যামলবাবুর কারণেই তো নাসরিনের মতো ত্যাগী নেত্রীরা এখন অবহেলিত। আপনারা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন, শ্যামলবাবু নিজের স্বার্থে রেবতীকে দলের জয়েন্ট সেক্রেটারি করেননি?
এবার রেবতী ক্ষেপে ওঠে—কী যা তা বলছেন? কথা হচ্ছে দলের শৃঙ্খলা নিয়ে। সেখানে আমাকে টানছেন কেন? শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে শনাক্ত করুন। দলের প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থা নেবেন।
এবার রাজীব নড়েচড়ে বসে। সুবিমল মিত্রের উদ্দেশে বলে, লিডার যদি অনুমতি দেন, দুটি কথা বলি।
—বলুন রাজীব। কিন্তু ...

সুবিমল মিত্রের কথা শেষ করতে দেন না উপস্থিত নেতারা। তারা একযোগে প্রতিবাদ জানান, না কোনো কিন্তু নেই। রাজীবকে বলতে দিন।
—ঠিক আছে, রাজীব বলুন।
—যদি কথা বলতেই হয়, তাহলে পেছনে ফিরে যেতে হয়। দলের এই দুর্দিনের জন্য প্রধানত দায়ী শ্যামলবাবু। কিছুটা রেবতী ম্যাডামও। যোগ্য লোককে টেক্কা দিয়ে অযোগ্য কেউ পদে বসলে ভাঙন ধরবেই।

বিষয়টি ভালো লাগে না নাসরিনের। বলে, রাজীব, আপনি কী শুরু করেছেন? সেক্রেটারির দোষের ভার রেবতীকে কেন দিচ্ছেন?

—দিচ্ছি। কারণ, জয়েন্ট সেক্রেটারি হওয়ার পর থেকে রেবতীই সেক্রেটারির কানে নিত্য বিষ ঢেলে গেছেন। সেক্রেটারিকে ভুল পথে নিয়ে গেছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সুখ-দুঃখ, দাবি-দাওয়ার কথা সেক্রেটারিকে শুনতে দেননি। আমরা বহুবার সেক্রেটারিকে সতর্ক করতে চেয়েছি। কিন্তু রেবতী আমাদের ঘেঁষতেই দেননি। এখন যেমন লিডারের কাছে সেক্রেটারিকে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না।

রাজীবের কথাগুলো মনে মনে নাসরিন সত্য বলেই মেনে নেয়। কিন্তু প্রকাশ্যে বলে, আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? অহেতুক অভিযোগ করছেন।

এতক্ষণ রাজীবের বাক্যবাণে জর্জরিত হচ্ছিল রেবতী। রাজীবের অভিযোগ তবু তার সহ্য হয়। কিন্তু নাসরিনের ভালো কথাও সহ্য হয় না। যেন গরম তেল এসে ত্বকে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। মনে হয়—নাসরিন সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিচ্ছে। তাই রাজীবকে ছেড়ে নাসরিনের ওপর ক্ষেপে ওঠে রেবতী—হয়েছে, হয়েছে। আপনাকে আর সাফাই গাইতে হবে না। আপনাকেও চেনা হয়ে গেছে। আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি হওয়ার পর থেকে দলের কোন কাজটায় আপনি ছিলেন? জয়েন্ট সেক্রেটারি হতে পারেননি। যোগ্যতা ছিল না তাই। তার জন্য জনে জনে ধরে ধরে আমার দুর্নাম করেছেন। আমার বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীদের ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। আপনি ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করে বেড়াবেন, আর ভাববেন, কেউ কিছু বুঝবে না। তাই না? সব বুঝি।

রাজীব এবার গর্জে ওঠে, থামেন রেবতী। আপনার মুখে এসব কথা মানায় না। আপনার আর শ্যামলবাবুর ষড়যন্ত্রের কথা দল কেন, পুরো দেশবাসীও জানে। শ্যামলবাবুর চরিত্র যে কেমন ...
রাজীবের কথা শেষ হয় না। হল রুমে ঢুকে পড়ে শ্যামল। রেবতী ও তাকে জড়িয়ে রাজীব কথা বলছে। নিশ্চয় ভালো কিছু নয়। শ্যামল ভাবে, রাজীব কোনকালে আমার ভালো সহ্য করেছে। সব সময় তো বিরুদ্ধেই ছিল। আজ সবাই মিটিং করছে। অথচ আমাকেই ডাকল না! ক্ষোভে দুঃখে কাঁপতে থাকে। হাতের কাছে হাতল ভাঙা চেয়ার। একটানে তোলে ধরে মাথার ওপর। চোখের পলকেই সেই চেয়ার এসে পড়ে রাজীবের নাক-মুখের ওপর। দেখতে না দেখতে রক্তে ভেসে যায় মেঝে। শুরু হয় ছোটাছুটি।
সুবিমল ভাবে, রক্তারক্তি রাজনীতিরই অংশ। আজকের রক্তারক্তির ঘটনা দলের জন্য শাপে বর হয়ে এলো। মনের কথা জানাতেই রেবতীও উচ্ছ্বসিত—ইউ আর গ্রেট লিডার। এজন্যই আপনাকে এত পছন্দ করি। লিডার, আমরা এই ঘটনা থেকে দুটি সুফল পাবো।
—কীভাবে?
—প্রথমত, এই ঘটনাকে সরকারি দলের ষড়যন্ত্র বলে প্রচারের সুযোগ নিতে পারব।
—হুম।
—দ্বিতীয়ত, দলের শৃঙ্খলাভঙ্গে দায়ে শ্যামলবাবুর বিরুদ্ধে দলীয় অ্যাকশন নেওয়াটা সহজ হয়ে গেল।
—গুড। কিন্তু ...
—কোনো কিন্তু নেই লিডার। মনে মনে বলে, শ্যামলবাবু যে কী, কেউ না জানুক আমি তো জানি।
—বলছিলাম, কী অ্যাকশন নেওয়া যায়?
—সরাসরি বহিষ্কার। এতে আপনি দুটি সুবিধা পাবেন। এরপর সুবিধাগুলোর বর্ণনা দেয় রেবতী—নাম্বার ওয়ান, দলের শৃঙ্খলারক্ষায় আপনার সিদ্ধান্তকে লৌহমানবের সিদ্ধান্ত মনে করবেন নেতাকর্মীরা। নাম্বার টু, ভবিষ্যতে কেউ দলের ভেতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সাহস পাবে না।

রেবতীর যুক্তি সুবিমলের মনে ধরে। কিন্তু মুখে উচ্চারণ করে না। বলে, দেখি কী করা যায়। উৎকণ্ঠায় কাটে রেবতীর কয়েক মুহূর্ত।
নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। একজন দাঁড়িয়ে বলে, আমরা এই হঠকারিতার বিচার চাই। আরেকজন খেকিয়ে ওঠে, কে করেছে হঠকারিতা? রাজীব, না শ্যামলবাবু?

দলের প্রেসিডেন্ট মাইক্রোফোন হাতে তোলে নেন। মধ্যমার ওপর বৃদ্ধা আঙুল চেপে ধরে আলতো করে ছুড়ে দেন মাইক্রোফোনের ওপর। তাতে ঠক ঠক শব্দ ওঠে। এরপর গলা পরিষ্কার করে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন, সভা আজকের মতো মুলতবি। কাল সিদ্ধান্ত। সুবিমল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। সঙ্গে রেবতীও। দুজনই পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান। চড়ে বসেন গাড়িতে। রেবতী ঘাড় উল্টে পেছনে তাকায়। দেখে নেতাকর্মীরা তাদের দেখছে অবাক বিস্ময়ে। সে এবার সুবিমলের হাঁটুতে টোকা দেয়, লিডার।
—হু।
—দেখেছেন, নেতাকর্মীরা পেছনে কী করছে?
—হু।
—কী হু-হু করছেন? কোনো সিদ্ধান্ত তো জানালেন না। কী করবেন?
—কাল সব জানবে। শুধু নীতিনির্ধারকদের ডাকো।
—আচ্ছা। একটা কথা ছিল।
—আবার কী কথা?
—সেক্রেটারি কাকে বানাবেন?
—এখনো তো শ্যামল আছে। তাকে বহিষ্কার করলেও কাউন্সিল ছাড়া তো সেক্রেটারি বানানো যাবে না।
—তাহলে?
—ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালাতে হবে।
—কাকে দেবেন সেই দায়িত্ব?
—ভাবছি। মনে মনে বলেন, যাকেই বানানা, তোমাকে কোনোভাবেই নয়। তোমাকে চেনা হয়ে গেছে। খাল কেটে কুমির আনতে চাই না। মুখে বলেন, এত তাড়াহুড়োর কী আছে? কাল দেখা যাবে।
—আচ্ছা।

তিন.

দলের নীতিনির্ধারকদের জরুরি সভা। শ্যামলের মাথা নিচু। দর-দর করে সে ঘামছে। রেবতীর চোখের দিকে তাকাতেই চোখে জ্বালা ধরে যায়। এই নারীর এত কূটবুদ্ধি! আমাকে বাঁদর নাচন নাচাল! এর চেয়ে তো নাসরিন ভালো ছিল। তার একটাই দোষ। বড় বেশি সীতা সীতা ভাব। রেবতী, একদম মনের মতো। কিন্তু সেই রেবতী এটা কী করলো? আমারই বিরুদ্ধে চলে গেল। এই জন্য থার্ড ক্লাস মাইন্ডের নেতাকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দিতে নেই। এরা যে থালে খায়, সে থালই ফুটো করে দেয়। এজন্য এদের শুধু প্রলোভন দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহার শেষে আখের ছোবড়ার মতো ছুড়ে ফেলতে হয়। রেবতীকেও তো সেভাবেই ছুড়ে ফেলার পরিকল্পনা ছিল। শ্যামল নিজেকে ধিক্কা দেয়—কী থেকে কী হয়ে গেল। রেবতীকে নিয়ে খেলতে গিয়ে তুই নিজেই তার দাবার গুটি হয়ে গেলি!

আজ জরুরি সভা। দলীয় প্রধান সিদ্ধান্ত জানাবেন। গতকালের ঘটনার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবে নাকি শ্যামল। নাহ। দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার হলে সরকারি দলে যোগ দেবে। সমস্যা কী? না হয়, তাকে যারা পছন্দ করে, তাদের নিয়ে আলাদা দল করবে। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে। টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে ঘোষণা আসে। ঘোষণা শুনে মাথায় বজ্রপাত পড়ে। শ্যামল ভাবে, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে পারত। তাকে কেন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিল না? একজন নেতাও সেই বিষয়টি তুললো না। নিজেকে শোনায়, কী তাজ্জব! এত দিন কাকে নিয়ে রাজনীতি করলি? তার মানে দলে কেউ অনিবার্য নয়?

মনকে শক্ত করে শ্যামল। একবার হলরুমের চারদিকে তাকায়। দেখে সবার চোখ দলের সুবিমল আর রেবতীর দিকে। তার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে বের হতে থাকে। দরজায় দাঁড়িয়ে বের হওয়ার আগে আরেকার হলরুমের দিকে তাকায়। এবার চোখ পড়ে নাসরিনের দিকে। সে দেখে সেই চোখ স্থির। শান্ত। কোনো ক্রোধ নেই। নেই কোনো করুণার আলোড়নও। ঠা-ঠা দুপুরকেও মনে হয় মেঘাচ্ছন্ন। যেমন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে অফিসের নিচে। শেষ সিঁড়িতে নামতেই চোখে পড়ে, একঝাঁক পিঁপড়ার পিঠে একটি মৃত টিকটিকি।  শ্যামলের বুক থেকে একটি গভীরতর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।  তাকে দেখে ড্রাইভার এগিয়ে আসে, গাড়ি বের করবো স্যার? ম্লান হাসে শ্যামল। বলে, নাহ। দরকার নেই। নেমে আসে রাস্তায়। দেখে সারি সারি প্রাইভেট কার। আছে দুএকটা রিকশাও। সেদিকে এগোয় শ্যামল। ডাকে—ওই খালি যাবি?

Link copied!