• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

সুনীলবাবু, আসলেই কেউ কথা রাখে না


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২৩, ১১:২১ এএম
সুনীলবাবু, আসলেই কেউ কথা রাখে না
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার উদয়ের আগে রবীন্দ্রকাব্যের আওতা থেকে বেরিয়ে পড়ার দু-একটা প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। জীবনানন্দ দাশ তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে এসেছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। তিনি হয়ে উঠলেন জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। ২০১২ সালে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষার জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বাংলা ভাষায় তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন।

সুনীল যত বড় কবি; তত বড় কথাসাহিত্যিকও। উপমহাদেশের ইতিহাসকে উপজীব্য করে তাঁর উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেই সময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ বাংলাদেশ এবং কলকাতার পাঠকমহলে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু কাহিনি চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তার মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উল্লেখযোগ্য। ঔপন্যাসিক হিসেবে তার তুমুল খ্যাতি হলেও শুরুটা হয়েছিল কবিতা দিয়েই। আর তার কবিতা লেখার সূচনাও হয়েছিল মজার ছলেই। ডানপিটে সুনীলকে বশে রাখতে তার শিক্ষক বাবাকে খুব বেগ পেতে হতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর অফুরন্ত সময়। এ সময়টাতে দুরন্ত সুনীলকে আটকে রাখতে তার বাবা এক ফন্দি আঁটলেন।

সুনীলের বাবা ছিলেন শিক্ষক। ছেলের হাতে তিনি তুলে দিলেন টেনিসনের কবিতার বই। তার কড়া আদেশ, প্রতিদিন একটা করে কবিতা অনুবাদ করে খাতা দেখাতে হবে। কয়েক দিন অনুবাদ করে দেখানোর পর সুনীল খেয়াল করলেন, তার বাবা ভালো করে না পড়েই সই বা টিক চিহ্ন দিয়ে দেন। এতে তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। এবার ইংরেজি কবিতার লাইনের হিসেবের সঙ্গে মিল রেখে নিজেই কবিতা লিখতে শুরু করলেন। ওদিকে বাবাও আগের মতো ভালোভাবে না দেখেই স্বাক্ষর দিয়ে যেতে লাগলেন ছেলের খাতায়।

সুনীল কবি হয়ে উঠলেন। একসময় বিখ্যাতও হয়ে গেলেন। এ খবর যখন বাংলাদেশে পৌঁছাল, তখন তার নাড়ি-নক্ষত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছিল। যার ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে তার জন্মভিটায় পা রেখেছিলেন। কবিকে দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে কবি-কবিভক্তরা ছুটে এসেছিলেন। সেই যাত্রায় কিছু স্মৃতি রেখে গেলেন। রেখে গেলেন গল্প আর আড্ডা।

তাঁর বয়স যখন তেত্রিশ পেরিয়ে গেছে, তখন এমন অনুভূতি তাকে তাড়িত করেছে। তাই তিনি লিখলেন ‘কেউ কথা রাখেনি’। কবিতার কিছু অংশে কল্পনার সংমিশ্রণ থাকলেও পুরো কবিতাটিই বাস্তবতার আলোকে লেখা। কবিতায় বোষ্টমীর প্রসঙ্গ কাল্পনিক হলেও অবাস্তব নয়। কবি ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের মামাবাড়িতে। তখন পৈতৃক নিবাস কালকিনির মাইজপাড়ায়। সম্ভবত ১০-১১ বছর বয়সে অর্থাৎ দেশভাগের আগেই পরিবারের সঙ্গে চলে যান কলকাতা। তবু তিনি ভুলতে পারেননি শৈশবের স্মৃতি।

কবি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ‘পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায়’ থেকেছেন। সে সময় মনে হয়েছে তার মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী তাকে বলেছিল, ‘বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি/তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব’। তিন প্রহরের বিলে সাপ আর ভ্রমরের প্রসঙ্গ এলে কবি মুচকি হেসে বললেন, তখন আমি ছোট ছিলাম। মামারা যখন নৌকা নিয়ে বিলে যেত তখন আমিও বায়না ধরতাম। কিন্তু মামারা নিতেন না। ছোট্ট সুনীলকে ভয় দেখানোর জন্য বলতেন, সে বিলে যেতে-আসতে তিন প্রহর লেগে যায়। আর সেখানে ভয়ঙ্কর সাপ রয়েছে। সেই বোধ থেকেই বিলের নাম দেন তিন প্রহরের বিল। এবং সাপ আর ভ্রমরের খেলাটা বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা। কবির কবিতায় মুসলমানের একটিমাত্র চরিত্র, তা-ও আবার মাঝি। এ প্রসঙ্গে কবি বললেন, তখন মুসলমানরা এখনকার মতো এত সচেতন ছিল না। আমি তাদের ছোট করিনি বরং তাদের পশ্চাৎপদতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তখনো মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। মামাবাড়ির আশপাশের মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের বাড়ির কামলা খাটত বা নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করত।

কবিরা আর্থিকভাবে অতটা সচ্ছল ছিলেন না। মার্বেল খেলার জন্য একটা রয়্যাল গুলিও তিনি কিনতে পারেননি। তখন মাইজপাড়ার লস্কররা খুবই বিত্তবান ছিল। লস্করবাড়ির ছেলেদের লাঠিলজেন্স খেতে দেখে কবি বাবার কাছে বায়না ধরতেন। বাবা বলতেন, পরে কিনে দেব। কবি অপেক্ষায় থেকেছেন। বাবা স্কুলমাস্টার। বেতন কম। তাই তার মা কবিকে বলতেন, জীবনে অন্য কিছু করবে তবু মাস্টারি করবে না। তাই কবি কখনো মাস্টারি করতে যাননি।

রাস উৎসব প্রসঙ্গে কবি বলেন, তিনি ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। তাদের গাঙ্গুলিবাড়িতে যখন রাস উৎসব হতো তখন ভেতর বাড়িতে মহিলারা নাচ-গান করত। কবি তার ব্যাঘাত ঘটাবেন বলে তাকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হতো না। নিজেকে অসহায় কল্পনা করে কবি এমন অভিব্যক্তি করেছেন। কবি তখন ভাবতেন, একদিন আমিও সব পাব। রয়্যাল গুলি, লাঠিলজেন্স আর রাস উৎসব সবই তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তার বাবা এসব কিছুই দেখে যেতে পারেননি। আজ সুনীলের সব আছে কিন্তু তার স্কুলমাস্টার বাবা নেই। এই শূন্যতা তাকে বার বার গ্রাস করেছে।

কবিকে যখন বরুণা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলো, কবি তখন মুচকি হেসে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। তখন কবির সঙ্গে তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। কবি শুধু এটুকু বললেন, এটা কল্পনা। বরুণা বলে কেউ ছিল না। তবে পরে আমরা জেনেছি, কবির এক বন্ধুর বোনের প্রতি কবির দুর্বলতা বা ভালোবাসা জন্মেছিল। কবি তার কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সে সময়ে একমাত্র বন্ধুর সুবাদে কেবল বন্ধুর বোনের সঙ্গেই কথা বলার বা ভাববিনিময়ের সুযোগ ছিল। হয়তো বরুণা তার কল্পনার নারী।

৭৫তম জন্মদিন উদযাপন করতে কবি এসেছিলেন তাঁর জন্মভিটায়। এটা কবির জন্য যতটা আনন্দের; মাদারীপুরবাসীর জন্য ততটা গর্বের ছিল। তিন দিন অবস্থান করে কবি আবার চলে গেলেন তাঁর গড়িহাটির পারিজাতে। রেখে গেলেন স্মৃতি। অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দেশভাগের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে সৌহার্দ্যের মিলনরেখা। কিন্তু সব ছেড়েই তাকে চলে যেতে হলো ২৩ অক্টোবর। পড়ে রইল পারিজাত। পড়ে রইল জন্মভিটার সুনীল আকাশ।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশে, বিখ্যাত হয়েছেন কলকাতায়। তবুও কবি দুই বাংলাকেই এক করে দেখেছেন- এক বাংলা হিসেবে কামনাও করেছেন আমৃত্যু। সুনীলকে নিয়ে কলকাতার যতটা গর্ব, আমাদেরও তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমরাও দাবি নিয়ে বলতে পারি, সুনীল আমাদের। আমরা তাকে ভালোবেসেছি, তিনি আমাদেরও মনের মানুষ। দেশান্তরী হওয়ার অনেক বছর পর প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০০৩ সালে। যখন সুনীলের সুখ্যাতি দিকে দিকে। মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক ডা. এমএ বারী নিজ উদ্যোগে খুঁজে বের করেন তার জন্মস্থান। সুনীলের পৈতৃক ভিটাও তখন মানুষের দখলে। ডা. বারীর চেষ্টা আর প্রবাসী লেখক আ. রাজ্জাক হাওলাদারের সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় কবির জন্মভিটা। তারা উদ্যোগ নেন তাকে জন্মভিটায় নিয়ে আসতে। কলকাতায় যোগাযোগের পর তিনি নিজের জন্মস্থানে আসতে সম্মতি দেন। তার পদধূলিতে ধন্য হয় মাদারীপুরের মাটি।

এখন কথা হচ্ছে- তাঁর জন্মভিটার স্মৃতি সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে? যতটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার জীবদ্দশায়, তারও কি বাস্তবায়ন হয়েছে? এখনো তার স্মৃতির উদ্দেশে দাবিকৃত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বালিগ্রাম ইউনিয়নের পাথুরিয়া পাড় থেকে মাইজপাড়া পর্যন্ত সড়কটি ‘সুনীল সড়ক’ নামে নামকরণ করা হয়নি! তার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠিত সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সংস্কার করা হয়নি! সুনীল মেলা যাতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অনেকেই। স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা তার স্মরণসভায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।

মাদারীপুরে প্রবর্তিত একমাত্র সুনীল সাহিত্য পুরস্কারও গত কয়েক বছর ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক শাজাহান খান একা হাতে আগলে রাখতে পারেননি। পৃষ্ঠপোষক হেমায়েত হোসেন হাওলাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই। সবশেষ ২০১১ সালে পুরস্কার বিতরণ করে সুনীল সাহিত্য ট্রাস্ট। তারপর লেখকদের কাছ থেকে লেখাও জমা নিয়েছে। কিন্তু আজও আলোর মুখ দেখেনি ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার-২০১২’ ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা। এমনকি গত কয়েক বছরে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষেও কোন আয়োজন লক্ষ্য করা যায়নি।

সুনীল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তদের আশীর্বাদ বাক্যে কবি লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রই, চিরদিন, চিরকাল।’ তিনি তো আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। অথচ আমরা ভুলে যাচ্ছি তাঁকে। হয়তো কবি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে। কবি বেঁচে থাকবেন আমাদের মর্মে। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, আমাদের উপলব্ধিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন চিরকাল।

সূত্র: 
কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী অর্ধেক জীবন ও আনন্দবাজার পত্রিকা
কেউ কথা রাখেনি: সুনীলের একান্ত আলাপ, চিন্তাসূত্র
সুনীলের জন্মভিটায় এ কোন আলো, জাগো নিউজ
যেভাবে কবি হয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম আলো

Link copied!