• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

হুমায়ুন আজাদ : জোনাক জ্বলা এক স্ফুলিঙ্গ


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৩, ১১:৪৮ এএম
হুমায়ুন আজাদ : জোনাক জ্বলা এক স্ফুলিঙ্গ

লোকটার স্বভাবে ছিল ঠোঁটকাটা, যেটা ন্যায্য ও সঠিক মনে করেছেন, সেটা বলতে কোনো দ্বিধা ছিলো না তার। এতে কে কী বলল, তাতে কিছু ভাবতেন না। কোনো রক্তচক্ষুকে তিনি পরোয়া করতেন না। লক্ষ্য ও সংকল্পে অটল থাকা তার চরিত্রের বড় গুণ। আজীবন গতানুগতিক চিন্তাধারাকে পরিহার করছেন তিনি, প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আঘাত করেছেন অভ্যস্ত ভাবনার ছকে। আস্থা রেখেছিলেন পুরোনো বিশ্বাসে নয়, বাঙালির সংস্কৃতির শাশ্বত শক্তি আর অগ্রগমনে। কিন্তু তার নামটি আজ অনেকের কাছে বিস্মরণ, যার কথা বলছি—হুমায়ুন আজাদ তিনি; আজও তিনি প্রাসঙ্গিক। তার মতো কজন জোরালো ভঙ্গিমায় কথা বলেন? তার সৃষ্টিকমে ভাষা, চিন্তা, বিজ্ঞান, সমসাময়িক থেকে রাজনৈতিক, সাহিত্য, মুক্তবুদ্ধিচর্চা, ধর্মান্ধতা, প্রতিষ্ঠান, সংস্কারবিরোধিতা, নারীবাদ সব বিষয়ই এসেছিল। ধর্মান্ধতা, উগ্রতা, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে আজীবন সোচ্চার ছিলেন। ফলে তার ওপর হামলা হয়েছে। 

প্রচলিত সমাজের কাঠামোয় আঘাত করেছেন তিনি। কুসংস্কার ও ধর্মীয় বাড়বাড়ন্তে নিশঙ্কে কলম ধরে ছিলেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যে পুরোনো প্রথা ভেঙে নতুনভাবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে কবিতায় বা প্রবন্ধে শাণিত করেছেন। মাথা নত করেননি তিনি। তার বিবেচনায় যা ভালো, সেটাই গ্রহণ বা মেনে নিয়েছেন। অন্য ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছেন কিংবা বাতিল করেছেন। এখানেই হুমায়ুন আজাদ ‘অনন্য’।

সেই উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় ফেরার পথে দুবৃর্ত্তরা তার ওপর হামলা করে। সেই বছরই ১১ আগস্ট রাতে একটি অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে হঠাৎই শরীর খারাপ হয়ে গেল তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। এই মানুষটা ৮০ বছর আয়ু চেয়েছিলেন, ৫৭ বছরেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। 

কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কবি, ভাষাবিজ্ঞানী, বহুমাত্রিক হিসেবে হুমায়ুন আজাদের তুলনা নেই। ক্ষণজন্মা এ মহান মানুষটি বাংলা সাহিত্যকে অনেক দিয়েছেন। এ জগতে তিনি নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ করেছেন। তার প্রয়াণে হয়তো তিনি শারীরিকভাবে বিলীন হয়েছেন, কিন্তু তার আদর্শ—তার সৃষ্টিকম চিরকাল থাকবে। বাক্স্বাধীনতা ও অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি আমাদের প্রেরণা। উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন দীপ্তিমান আলোকশিখা হয়ে। 

হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষায় বিরলপ্রজ প্রতিভা। প্রবন্ধ ও গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে যা দিয়েছেন, তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি অনেকে। শুদ্ধ ভাষার দখল ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখানোর মতো লোক ছিলেন তিনি। তার মতো ক্ষণজন্মা ভাষাবিজ্ঞানী বাংলা ভাষা কবে পাবে কিংবা আদৌ পাবে কি না, সন্দেহ আছে!

কোথা থেকে বাংলা ভাষা এলো, তা জানাতে লিখলেন, ‘কত নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’। বই হাতে নিয়ে বইটির নাম পড়লেই বোঝা যায় নদীবিধৌত এই পলিদ্বীপের ভাষা কত না চড়াই-উতরাই পার করে আজকের এই রূপ লাভ করেছে। শুধু কি তাই, আপন মর্যাদা লাভ করতেও কি এ ভাষাকে বুকের রক্ত ঝরাতে হয়নি। এ ভাষায় মনিমাণিক্যের মতো যেসব সাহিত্য রচনা হয়েছে এই ভূখণ্ড জন্মগ্রহণ করার ফলে, এই ভাষায় কথা বলার ফলে নতুন প্রজন্ম যে সাহিত্য উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে, তা জানাতে লিখলেন—‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী। এমন এক-একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছেন আমাদের অস্তি-মাংসে-মজ্জায় তার বদৌলতেই তো আমরা নিজেদের বাঙালি বলে চিনতে পারি, গৌরববোধ করতে পারি। নব্বইয়ের দশকের শেষে দিকে বাংলা ভাষার ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি।

দুই। 

হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু লিখেছেন—বিস্তর লিখেছেন। এর মধ্যে কিশোর সাহিত্যের বই ৮টি। তার শিশুতোষ লেখাগুলো পড়লে মনে হয় একজন মানুষ কীভাবে লিখলেন এসব! লেখার মধ্যে তিনি যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, তা আলোচনার দাবি রাখে। শিশুদের জন্য তার লেখাগুলোয় আছে শৈশব, ভালোলাগা, ভালোবাসা, মায়াভরা গ্রাম। লেখাগুলো যেন এক একটি দীর্ঘ কবিতা। ঘোলা জলে ছিন্নভিন্ন কচুরিপানার দীর্ঘ বিষণ্ন কবিতা। বইয়ের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন হৃদয় নিংড়ানো। পড়ার সময় মনের পর্দায় জাদুবাস্তবতার ছায়া উঁকি দেয়। মনে হয় জাদুময়তা আর বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার মধ্যে ছিল অসম্ভব সুন্দর, সাজানো-গোছানো, স্বপ্নভুক একটি মন। যে মন শিশুর মতো সরল-সহজ, উদার এবং দাগহীন কাগজের মতো সাদা ধবধবে। তা না হলে তিনি কী করে লিখলেন—ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, আব্বুকে মনে পড়ে, আমাদের শহরে একদল দেবদূত, বুকপকেটে জোনাকিপোকার মতো অসম্ভব সুন্দর, মায়াময়, ছায়াময়, কাব্যময়, স্বপ্নময় লেখা! 

তিনি শিশু-কিশোরদের কেবল ভাবালুতায় আক্রান্ত করেন না, তাদের নিয়ে যান এমন একটি জগতে; যেখানে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার আশ্চর্য হদিস দিয়েছেন। বয়ান ও বিন্যাসের ভেতর দিয়ে যেখানে তিনি কিশোরদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলেন। হুমায়ুন আজাদ শিশু-কিশোরদের জন্য ইংরেজিতেও অল্পবিস্তর লিখেছেন। একটি বইয়ে তিনি রাজকীয় বাংলার বাঘ অর্থাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে লিখতে ছাড়েননি। হুমায়ুন আজাদ তার অনেক লেখায় বিভিন্ন প্রাণীর কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে ‘বন্য আগুনের মতো সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং জ্বলন্ত’ এমন উপমা ব্যবহার করেছেন তা শুধু শিশুমন কেন, বড়দেরও মুগ্ধতার সাগরে ভাসিয়ে দেয়।

তিন। 

বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল। তার জন্মনাম ছিল হুমায়ুন কবীর। তিনি মুন্সিগঞ্জের যে গ্রামে বাস করতেন, সেটি আগে থেকেই বিখ্যাত—এখানে জন্মেছিলেন বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। ওই গ্রামের নাম রাঢ়িখাল। তার জন্ম কামারগাঁও। কিন্তু রাঢ়িখালকে মনে করতেন তার জন্মগ্রাম। গ্রামটি পানির গ্রাম নামেও পরিচিত ছিল। কেননা, ওই গ্রামে ছিল অনেক পুকুর। বর্ষাকালে পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। তখন গ্রামটিকে পানির ওপর ভাসতে থাকা কচুরিপানার মতো মনে হতো। রাঢ়িখালের কাছেই পদ্মা নদী। রাতের বেলায় নদীতে স্টিমার চলত। তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন। তিনি লিখেছেন, স্টিমারের আওয়াজ আমার কাছে অলৌকিক মনে হতো। তাই আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম অলৌকিক স্টিমার। 

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার কবিতাচর্চা শুরু হয়। ইত্তেফাক পত্রিকার শিশুপাতা কচিকাঁচার আসরে তার প্রথম লেখা ‘ঘড়ি বলে টিক টিক’ প্রকাশিত হয়। 

ছোটবেলায় হুমায়ুন আজাদ যে ঘরে পড়তেন, তার সামনে ছিল বিরাট একটা কদম ফুল গাছ। প্রতি বর্ষায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত গাছটি। স্কুলে পড়ার সময় এই কদমগাছ নিয়েই তিনি একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেন। এ লেখায় কোনো কাহিনি ছিল না। চরিত্র ছিল না। শুধু ছিল রূপের বর্ণনা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। এ জন্য তার প্রতিটি লেখার মধ্যে প্রকৃতিপ্রেমের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। তিনি তার ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না বইয়ে লিখেছেন—‘আমি একসময় ছিলাম ছোট। ছিলাম গ্রামে, গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে। শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলদে ফুল। একটা খাল পুকুর থেকে বের হ’য়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চ’লে গেছে বিলের দিকে। তার ওপর একটা কাঠের সাঁকো, নড়োবড়ো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম।’

হুমায়ুন আজাদ প্রকৃতির স্বাদ উপভোগ করতে পারতেন। আর উপভোগের এ বিষয়টি উপস্থাপন করতেন তার লেখায়। আমাদের শহরে একদল দেবদূত বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন—‘আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই, মেঘের ডাক শুনতে পাই। উত্তরের আকাশকে অন্ধকার হয়ে যেতে দেখি। আমি দেখতে পাই রুপোর পাপড়ির মতো বৃষ্টি নামছে, টিনের চালে বেজে চলছে নূপুর, খেজুরগাছ নর্তকীর বাহুর মতো তার ডাল এদিক নাড়ছে ওদিক নাড়ছে। আমি দেখতে পাই সূর্য মোমবাতির মতো কোমল হয়ে গেছে, আকাশের এপার থেকে ওপার ভ’রে কালো কাঁথার মতো মেঘ বিছিয়ে আছে। এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে। আমার শরীর জুড়িয়ে আসে, মন জুড়িয়ে আসে।’ 

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন—‘শীতের শিশির, কুয়াশা, ঠান্ডা বাতাস, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ, বর্ষার প্লাবন, ঝড় মেঘ, শরতের সোনা আর কার্তিকের কুয়াশা, ফাল্গুনের সবুজ পাতা আমার ভিতরে ঢুকে গেছে। আমার যেমন ভালো লাগতো বোশেখের রোদ। তেমনি ভালো লাগত মাঘের ঠান্ডা।’ এ কথাগুলো যেন ফেলে আসা শৈশব। শৈশবের আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। লেখাগুলো পড়তে পড়তে গ্রামে ফিরে যাই। ঝাড়বাতির মতো পুকুরজুড়ে ফুটে থাকা কচুরিপানা ফুলের কাছে ফিরে যাই। শাপলা শালুক আর জোনাক জ্বলা সন্ধ্যার কাছে ফিরে যাই। টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির মাতাল নৃত্য দেখি। বর্ষাকালে পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে বৃষ্টির সুরেলা ছন্দ শুনি। কাদার মধ্যে হুটোপুটি, লুটোপুটি, খুনসুটি আর জাম্বুরা নিয়ে বল খেলার মাতাল সময়ে ফিরে যাই। আসলেই কি ফেরা হয়? তার বইগুলো পড়ার পর কখনও কখনও এমন হয়—বুক ভরে বইয়ের মিষ্টি ঘ্রাণে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় বুকপকেটে জোনাকিপোকা নিয়ে দেবদূত হয়ে ঘুরে বেড়াই খাল, বিল, মাঠ প্রান্তরে।

হুমায়ুন আজাদ শুধু গ্রাম নয়, শহর এবং শহুরে জীবন নিয়েও ভেবেছেন। শহরের কষ্ট, শহরের স্বপ্ন, শহরের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ভাব ভালোবাসা, প্রশ্ন, শঙ্কা প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে তার লেখায়। তিনি আমাদের শহরে একদল দেবদূত বইয়ে লিখেছেন—‘আমাদের শহরকে আমরা আর কেউ ভালোবাসি না। খুব কষ্ট পাচ্ছি কথাটি বলতে; এত নিষ্ঠুর কথা আমি কখনো বলিনি। আমি জানি আমাদের শহর আমার কথা শুনতে পেলে খুব কষ্ট পাবে। আমার মতোই আর ঘুমোতে পারবে না। মনে মনে কাঁদবে। সত্যিই আমরা কেউ আর আমাদের শহরকে ভালোবাসি না। ভালোবাসি না বলে আমরা কেউ আর ঘুমোতেও পারি না। আমাদের শহর কি ভালোবাসে আমাদের? মনে হয় ভালোবাসে না। আমি আমাদের শহরের চোখের নিচে চোখের কোণে খুব কালো কালি দেখতে পাই। মনে হয় আমাদের শহরও আমাদের মতোই ঘুমোত পারে না। ঘুমোতে পারলে কারও চোখে এত কালি জমে না। ভালোবাসলে কেউ এত ঘুমহীন থাকে না। অথচ আমাদের শহরকে ভালোবেসে বেসে আমরা বড়ো হয়েছি। ভালোবেসে বেসে কথা বলতে শিখেছি, গান গাইতে শিখেছি। ভালোবেসে ফুল চিনেছি, মাটি চিনেছি, ঘাস চিনেছি, মেঘ চিনেছি।’

হুমায়ুন আজাদ তার লেখক ভাবনার অনেকাংশে শিশুদের মনোজগৎ নিয়ে তিনি ভেবেছেন, লিখেছেন। তার কঠিন হৃদয়ের একপাশ রেখেছিলেন কোমলমতি শিশুদের জন্য। এ জন্য তিনি গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাসে শিশুদের মনের কথা, ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা খুব সহজ করে লিখেছেন। বুকপকেটে জোনাকিপোকা বইয়ে লিখেছেন—

আমার শৈশব বাজে বাঁশবনে, নদীর কিনারে,
ঢেউয়ের বেহালায়, কাশফুল, মেঘের মিনারে,
পুকুরের শাদা আয়নায়, দুধশাদা পদ্মের ডাঁটায়,
আকাশের নীর নদে তারাদের জোয়ারভাটায়,

হঠাৎ দেখি উড়ছে তারা রোদের মধ্যে ধুলোর মতো,
চাঁদের থেকে নামছে পরী নূপুর বাজে শতোশতো,
মেঘের মতো আসছে কাশের শাদা ফুলের মালা,
মাঝ নদীতে লাফিয়ে ওঠে একটি বিরাট রঙের থালা,
আকাশ ফুঁড়ে বাড়তে থাকে বলের মতো তালের মাথা,
জ্যোৎস্নাবুড়ি বিছিয়ে দিলো আকাশজুড়ে নকশী কাঁথা।

ছড়া নয়, ছড়ার বিষয়-আশয়, জাদু-মন্ত্র, তাল-লয় প্রভৃতি বিষয় নিয়েও শিশুদের জন্য লিখেছেন তিনি। লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ছড়া বড়ো মজার। সারাটা বাল্যকালই তো আমাদের কাটে ছড়ার যাদুমন্ত্র উচ্চারণ ক’রে ক’রে। কে এমন আছে যে বাল্যকালে মাথা দুলিয়ে ছড়া কাটেনি? ছড়ায় জাদু আছে। যেসব কথা থাকে ছড়ার মধ্যে তার অনেক সময় কোনো অর্থই হয় না, বা অর্থ খুঁজে পাই না; তার এক পঙ্ক্তির অর্থ বুঝি তো পরের পঙ্ক্তির মানে বুঝি না। ছড়া আসলে অর্থের জন্য নয়, তা ছন্দের জন্য, সুরের জন্য। অনেক আবোলতাবোল কথা থাকে তার মধ্যে, এ আবোলতাবোল কথাই মধুর হয়ে ওঠে ছন্দের নাচের জন্য। একটি ছড়া শোনা যাক—

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঝাঁঝর কাসর মৃদঙ্গ বাজে…

দুটি পঙ্ক্তি আমরা গুনগুন করলাম। এর অর্থ বোঝার কোনো দরকার নেই। তুমি কেবল এ ছন্দে মাতাল হও, এর ভেতর যেকোনো অর্থ থাকতে পারে তার কথা একেবারে ভুলে যাও, কেবল এর ছন্দের জাদুতে নাচো, নাচো।’

চার। 

হুমায়ুন আজাদ শিশুদের জন্য যে অতুল পৃথিবী গড়েছেন তা নিয়ে আলোচনা এত কম হয় যে হয় না বললে মিথ্যে বলা হবে না। আমাদের দেশটা রূপকথার কোনো দেশের থেকে কম নয় বরং কিছু বেশিই তা আমাদের চোখের সামনে ছবির মতো তুলে ধরেছেন তো হুমায়ুন আজাদ। পুকুরের কচুরিপানা, খেঁজুরডালের ফাঁক দিয়ে দেখা পূর্ণিমা চাঁদ যে এত মনোহর, গ্রামের সহজ মানুষের সরলতা এত এত আকর্ষণীয়, সবাই মাছ ধরার মতো সর্বজনীন উৎসব, টিনের চালের বৃষ্টির শব্দের মতো মধুর সংগীত, খেঁজুরগাছের ডালের তৈরি ঘোড়ার মতো মূল্যবান খেলনার কথা-সবই অজানাই রয়ে যেত আমাদের তিনি যদি না লিখতেন ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’নামের মায়াবি দুনিয়ার বইটি।
হুমায়ুন আজাদ শিশুদের জন্য যখন লিখেছেন তখন তিনি নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন কথকের ভূমিকা। সেই চিরচেনা গ্রামের গল্প কথকের চরিত্র। আর কথক হিসেবে নতুন প্রজন্মকে শুনিয়েছেন মাতৃভ‚মি, মাতৃভাষা, স্বাধীনতা, সংস্কৃতির ঐশ্বর্যের কথা। আর কি মিষ্টি তার বইয়ের নাম। 

‘আব্বুকে মনে পড়ে’ কিশোর উপন্যাসটি এমন একটি ছেলের এবং তার বাবার গল্প মুক্তিযুদ্ধ যাদের বিচ্ছিন্ন করেছে চিরতরে; কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার আগে শিশুটির প্রথম তিন বছরের কার্যকলাপ বাবা লিপিবদ্ধ করে রাখেন তার দিনলিপিতে। দিন যায় শিশুটির পিতা ফিরে আসে না। শিশুটি একদিন কিশোর হয়। সে দিনলিপিকে সঙ্গীকে অদেখা বাবাকে সর্বক্ষণ সঙ্গীকে চলতে থাকে পৃথিবীর পথ। তার আব্বুকে মনে পড়ে কারণ সে বাবার সঙ্গে তার কোনো স্মৃতির কথা তার মনে পড়ে না।

একজন মানুষের সবচেয়ে আস্থার স্মৃতি, নিরাপত্তা বোধ হলো তার প্রিয়জনের সান্নিধ্য। সেটি হারিয়ে দুর্বিষহ হয়ে পড়া জীবনকে কোন নান্দনিকতায় রাঙিয়ে নিল ছেলেটি, তারই এক অনন্য চিত্র ‘আব্বুকে মনে পড়ে’। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানোর অপূরণীয় ক্ষতিকে কেই-বা এমন স্বল্প আঁচড়ে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পারতেন। শুধু সোনালি অতীত আর গৌরবগাথা নয়, হুমায়ুন আজাদ তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন নিজেকে, সমসাময়িক সমবয়সী মানুষকে। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত এ বইটি ২০০৩ সালে জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। 

হুমায়ুন আজাদ তার লেখায় আশা করেছেন একদিন আমাদের শিশুরাই, দেবদূত রূপে আবির্ভূত হয়ে ঘুণে ধরা ব্যবস্থা ভেঙে তৈরি করবে নতুন দেশ, সমাজ, উড়বে নবকেতন, ধ্বনিত হবে নতুন জয়ধ্বনি। আর তার জন্য তিনি শিশুদের জন্য কিশোরের জন্য লিখে গেছেন স্বপ্নের কথা, দেশ-জাতি-মানুষের কথা, তাদের বুকপকেটে পুরে দেন সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আলোকোজ্জ্বল জোনাকিপোকা। একটি সুস্থ, কল্যাণে পরিপূর্ণ বাংলাদেশে চেয়েছিলেন। সেটা আজও অধরা।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!