• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
শিল্পের সিন্দুক : ১১

‘অপরাজেয় বাংলা’: একটি প্রতিবাদী ভাস্কর্যের কথা


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩, ০২:৪৯ পিএম
‘অপরাজেয় বাংলা’: একটি প্রতিবাদী ভাস্কর্যের কথা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত ‘অপরাজেয় বাংলা’

ক্ষুদে বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটির কথা শুনে থাকবে। আজ আমি তোমাদের সেই ঐতিহাসিক ভাস্কর্যটির গল্পই শোনাব। তবে তার আগে একটি বটগাছের কথা বলে নিতে চাই। ‘অপরাজেয় বাংলা’র অদূরেই ছিল একটি বিশাল বটগাছ, যার তলাতে তখন ছাত্রছাত্রীদের সব সভা, সমাবেশ, মিছিল অনুষ্ঠিত হত; যে কারণে এর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘বটতলা’। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই গাছতলাতেই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই বটগাছটির প্রতি তাই পাকিস্তানি শাসক ও সেনাদের প্রচণ্ড রাগ ছিল। তাই একাত্তরে আক্রমণের প্রথম সুযোগেই পাকিস্তানিরা এই গাছটিকে কেটে ফেলে। অবশ্য স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবল সমর্থক ও আমাদের এক পরম বন্ধু, আমেরিকান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে সেই একই জায়গায় আরেকটি বটগাছের চারা রোপণ করেছিলেন। সেটি এখন অনেক বড় হয়ে তার ঘন পত্রপল্লব ও ঝাঁকড়া ডালপালায় সেই ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণটিকে ছায়ায় আবৃত করে রাখে সবসময়; যার নিচে এখনও আগের মতোই  বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নানারকম অনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন করে থাকে।

তো, ১৯৭২ সালে এই গাছটির পাশেই কলাভবনের লাগোয়া একটি জায়গায় স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের গৌরবময় ভূমিকা, অপরিসীম আত্মত্যাগের স্মরণে ও সম্মানে শিল্পী আবদুল লতিফের নকশায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এর কদিন পরেই রাতের অন্ধকারে কারা যেন সেটিকে ভেঙে ফেলে। তখন তৎকালীন উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, ডাকসু তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমিতির সভাপতি, আজকের প্রখ্যাত প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান প্রমুখ নতুন নকশায় এবং আরও মজবুত করে একইস্থানে আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তখন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের প্রখ্যাত নাট্যজন, মুক্তিযোদ্ধা ম. হামিদ। তিনি তার পূর্বপরিচিত ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে এটির নকশা করার প্রস্তাব দেন। আবদুল্লাহ খালিদ মহা উৎসাহে মাটি দিয়ে এর একটি তিন ফুট উঁচু মডেল বানিয়ে দেন, যা দেখে সবারই পছন্দ হয় এবং তারা তাকে দিয়েই এটি নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এর নির্মাণ প্রকৌশলের কাজটি দেখভাল করেন বিখ্যাত পুরকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও তার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান শহীদুল্লাহ অ্যাসোসিয়েটস। তারা এটিকে চারগুণ বড় করে, খরচ কমানোর জন্য মার্বেল কিংবা গ্রানাইটের বদলে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে দেন, যার ভেতর থেকে ছেনি বাটালি দিয়ে খুদে খুদে ক্রমে তিন মুক্তিযোদ্ধার অনিন্দ্যসুন্দর অবয়বসমূহ ফুটিয়ে তোলেন পরিশ্রমী ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। উল্লেখ্য, ‘অপরাজেয় বাংলা’র নিচের চমৎকার ত্রিকোণাকৃতি বেদীটির নকশা করে দিয়েছিলেন আরেক মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি, প্রয়াত রবিউল হুসাইন।

১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু কাজ শুরু করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবদুল্লাহ খালিদকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে হয়। এতে কাজের কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও তড়িঘড়ি এর সমাধান করে দেন উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তার ছুটির ব্যবস্থা এবং তার জন্য মাসিক ৬০০ টাকা ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি এই সামান্য বেতনেই রাতদিন পরিশ্রম করেন; কখনো কখনো দিনে তেরো চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করতে থাকেন। তোমরা যারা এই ভাস্কর্যটি দেখেছো, তারা জানো যে এতে তিনজন পূর্ণদেহী মানব-মানবীর অবয়ব রয়েছে। এদের মধ্যে একজন নারী, যিনি সেবিকা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবা করেছেন, আর আছে দুজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা; একজন গ্রামের ও একজন শহরের। তোমরা জেনে অবাক হবে, ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদ এই তিনজনের চেহারা নির্মাণ করেছিলেন তিনজন সত্যিকার, বাস্তব মানুষের আদলে, যা সম্ভবত বাংলাদেশে প্রথম। এদের মধ্যে নারীটি ছিলেন আবদুল্লাহ খালিদের খালাতো বোন হাসিনা আহমেদ, মাঝখানের গ্রেনেড হাতে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাটির মডেল ছিলেন বদরুল আলম বেনু, যিনি ছিলেন চারুকলারই ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ খালিদের বন্ধু এবং দুহাতে রাইফেল ধরা শহুরে মুক্তিযোদ্ধার মডেল হয়েছিলেন খালিদেরই চাচাতো ভাই সৈয়দ হামিদ মকসুদ। ও হ্যাঁ, ভাস্কর্যটির নাম কিন্তু প্রথমে ছিল স্রেফ ‘স্বাধীনতার ভাস্কর্য’। পরে এর নির্মাণকাজ চলাকালে একে নিয়ে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামে একটি প্রতিবেদন লেখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। সেই প্রতিবেদন থেকেই এই ভাস্কর্যের নাম দাঁড়িয়ে যায় ‘অপরাজেয় বাংলা’।

সে যাক, আবদুল্লাহ খালিদ দিনরাত খাটছেন কাজটা দ্রুত শেষ করার জন্য। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল পঁচাত্তরের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড; জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ফলে ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায় আবার, এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য। কেননা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কিছুতেই এই ভাস্কর্যটিকে মেনে নিতে পারছিল না। তারা নানাভাবে এর বিরোধিতা, এর সমর্থকদের ওপর হামলা, এমনকি খোদ ভাস্কর্যটির ওপর আঘাত করতেও দ্বিধা করে না। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির প্রবল প্রতিরোধের কাছে তারা শেষ পর্যন্ত হার মানলে নতুন উপাচার্য ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী ১৯৭৮ সালে আবারও ম. হামিদকে দায়িত্ব দেন অবদুল্লাহ খালিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন করে কাজ শুরু করার জন্য। প্রস্তাব পাওয়া মাত্র ছুটি নিয়ে ঢাকায় এসে হাজির হন আবদুল্লাহ খালিদ। এবার তার মাসিক ভাতা নির্ধারিত হয় মাত্র দেড় হাজার টাকা। তাতেও খুশি তিনি। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে নব উদ্যমে কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু শুরুতেই বাঁধে আরেক বিপত্তি। দেখা গেল দীর্ঘদিনের অযত্ন কিংবা তার ওপর প্রতিপক্ষের আঘাত, যে কারণেই হোক নারীমূর্তিটি ভেঙে গেছে। ততদিনে হাসিনা আহমেদও সপরিবারে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। উপায়ান্তর না দেখে ম. হামিদের সহধর্মিনী অভিনয়শিল্পী ফাল্গুনী হামিদ নিজেই এগিয়ে আসেন এবং আবদুল্লাহ খালিদের কল্পনার সেই সেবিকার মডেল হিসেবে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এইসময় আরও একজন মানুষ এই প্রকল্পটির সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তিনি প্রয়াত আলোকচিত্রী ও সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীর। তিনিও ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে তার প্রথম ব্যক্তিগত ক্যামেরা দিয়ে হাত মকশো করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কর্মরত আবদুল্লাহ খালিদের এবং তার চোখের সামনে ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে ওঠা ভাস্কর্যটির অসংখ্য ছবি তুলে রাখেন দিনের বিভিন্ন সময়, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটে। পরবর্তীকালে সেই ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল হয়ে ওঠে এবং সেসব ব্যবহার করে কানাডাপ্রবাসী চলচ্চিত্রকার সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামেই একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও মূল্যবান প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যার মধ্য দিয়ে এই অনন্য শিল্পকর্মটির জন্ম ও নির্মাণের আদ্যোপান্ত ইতিহাসটুকু উঠে আসে শিল্পিত শৈলীতে।

অনেক বাধাবিপত্তি, ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হলে, ১৯৭৯ সালের বিজয় দিবসে কয়েকজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে এই অসাধারণ স্মৃতিস্তম্ভটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তোমরা জেনে অবাক হবে, ৬ ফুট উঁচু বেদীর ওপর স্থাপিত ১২ ফুট উচ্চতা, ৮ ফুট প্রস্থ ও ৬ ফুট ব্যাসবিশিষ্ট এই ভাস্কর্যটি নির্মাণের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা, যদিও নির্মাণ শেষে দেখা যায় খরচ হয়েছে মোট ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, যা এমন একটি বিরাট ও জটিল নকশার স্থাপনার বিবেচনায় অবিশ্বাস্যরকম কম। এটি সম্ভব হয়েছিল ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ থেকে শুরু করে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সততা, আন্তরিকতা ও আত্মত্যাগের কারণে, যা এ দেশের ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত বইকি। এই ভাস্কর্যকর্মে গ্রামের কৃষক, শহুরে যুবা ও সেবিকা নারীকে চিত্রায়িত করার প্রসঙ্গে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ জানান দেন যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কেবল কতিপয় সেনাসদস্যই শুধু অংশগ্রহণ করেননি, নারীপুরুষ, ধনীগরিব, শহরগ্রাম নির্বিশেষে ছাত্র, শ্রমিক, চাষা সবাই যার যার মতো করে যোগ দিয়েছিলেন। সেই গভীর সত্যটিই তিনি তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তার এই শিল্পকর্মের মাধ্যমে। ভাস্কর্যটির নির্মাণ শেষে তিনি আরও যা বলেছিলেন সেই কথাটি দিয়েই তারে এবং একাত্তরের সকল শহীদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই লেখার ইতি টানছি। তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরতে পারিনি। এই ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে দুই হাত রক্তাক্ত করে দেশের প্রতি আমার ঋণ শোধ করলাম।”

পুনশ্চ : বন্ধুরা, ‘অপরাজেয় বাংলা’কে নিয়ে ২০১১ সালে বানানো সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের অসম্ভব সুন্দর প্রামাণ্যচিত্রটি ইউটিউবে রয়েছে। তোমরা সবাই সময় করে সেটা দেখে নিতে ভুলবে না কিন্তু।

Link copied!