• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৭ জ্বিলকদ ১৪৪৫
শেখ আবুল ফজল আল্লামি

বাঙালি সংস্কৃতি ও দুনিয়াবি ভাবনা


সাদাত উল্লাহ খান
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৩, ০৭:২৩ পিএম
বাঙালি সংস্কৃতি ও দুনিয়াবি ভাবনা

‘যদি আকবর ও আবুল ফজলের পতাকা সম্মুখে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর দুই প্রজন্ম পাওয়া যেত, তাহলে ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা থাকত না, পাকিস্তানও তৈরি হতো না।’

–রাহুল সাংকৃত্যায়ন

 

শেখ আবুল ফজল আল্লামির (১৫৫১-১৬০২) চিন্তাধারার আলোচনা নতুন করে দেখার নানাবিধ প্রয়োজন আবশ্যক হয়েছে। তাছাড়াও আগামী ১২/৮/২০২৩ তারিখে তাঁর প্রয়াণের ৪ শত ২১ বছর পূর্ণ হবে। সেই সুযোগে তাঁকে সম্মান জানানো এবং বাঙালি সংস্কৃতির বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি আর দুনিয়াবি চিন্তা, মানে মুক্তচিন্তা বিকাশে তাঁর সম্পর্ক দেখানো। ষোল শতকের শেষদিকে শেখ আবুল ফজল এবং তাঁর পরিবার মোল্লাতন্ত্রের নির্যাতন, হিংসা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে তৎকালীন মোল্লাতন্ত্র নানা অভিযোগ এনেছিল যেমন, তিনি যথার্থ ইসলামি চিন্তা করেন না ও অধার্মিক, মাহদি তরিকার অনুসারী, এমনকি নাস্তিক বলেও অভিযোগ এনেছিলো। তাই চারশত বছর পরেও দেখা যায় বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারত এই মানসিকতা থেকে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারে নাই। এতোদিন পরে ভাবতে ভাবতে বিস্মিত হতে হয় শেখ আবুল ফজলের মতো এমন একজন রত্নভাণ্ডার নিয়ে বাঙালি বলতে গেলে একেবারে নিশ্চুপ। কেন? মুক্তচিন্তার ভয়? এমন প্রসঙ্গের জবাবে আহমদ ছফা বলেন, “বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসাভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে, আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত। বাঙালি মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না।”

 

বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের সমস্যা মোকাবিলায় শেখ আবুল ফজল আমাদের সহায় হতে পারেন। তিনি একজন দূরদর্শী চিন্তাবিদ ছিলেন। ধর্মীয় উগ্রবাদ বিষয়ে আবুল ফজলের অভিমত ও দূরদর্শিতা প্রসঙ্গে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালিক আহমদ নিজামি বলেন, ‘শাসকগণের উদাসীনতার মাধ্যমে প্রতিটি ফেরকা নিজেদের ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে গোঁড়ামিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং ক্রুদ্ধ বাদানুবাদ তীব্র আকার ধারণ করে। প্রত্যেকেই মনে করে তার নিজের প্রত্যয়ই এককভাবে সত্য, ঈশ্বরের অন্যান্য উপাসনাকারীর নিপীড়ক হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করে।” এই আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিতে শেখ আবুল ফজলের চিন্তা এখনও অতি প্রাসঙ্গিক।

 

বাঙালি সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা শেখ আবুল ফজলের লেখায় ও কর্মে দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন খ্যাতনামা অধ্যাপক নোমান আহমদ সিদ্দিকি শেখ আবুল ফজল সম্পর্কে বলেন, ‘ভারতের ইতিহাস নিয়ে তাঁর নব দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘস্থায়ী মূল্য বহন করে। মোগল সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতি জনপ্রিয় করতে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ছিল। রাজকীয় আধিকারিক ও হিন্দু সামন্তদের দষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের ওপরও এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছিল। শেষ অবধি আবুল ফজল কৃত ভারতীয় ইতিহাসের ধর্মনিরপেক্ষ ভাষ্য জমিতে শেকড় পেয়েছিল।’

 

বাঙালি মুসলমান কেবল মুক্তচিন্তা বা স্বাধীনচিন্তাকে ভয় পায় তাই নয়। মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে রীতিমতো সংগ্রামও করেছে এবং এখনও অব্যাহত রেখেছে। শেখ আবুল ফজল ও তাঁর মহান মুক্তচিন্তাকে গ্রহণ করতে বাঙালি অপারগ ছিল। আবার বলা যায় তাঁর প্রতি মোল্লাতন্ত্রও বিরাগভাজন ছিল। অথচ পশ্চিম, মানে ইউরোপ, শেখ আবুল ফজলকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে– সমাদর করেছে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক খালিক আহমদ নিজামি বলেন, ‘আবুল ফজলের প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক রচনা ‘আকবরনামা’ এবং তারই সম্পূরক ‘আইন-ই-আকবরি’ সমগ্র ফারসি ঐতিহাসিক সাহিত্যের মধ্যে উৎকৃষ্টতম কয়েকটির অন্যতম। ভিনসেন্ট এ. স্মিথ উল্লেখ করেছেন, এটা আসলেই অতুলনীয়, এশিয়াতে আদৌ এরকম কোনো কিছু লেখা হয় নাই এবং এমনকি ইউরোপও এমন ধরনের প্রামাণিক সংকলন খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।’

 

মোগল সম্রাট মহামতি আকবরের সময়ে সমগ্র দেশের শাসনপদ্ধতি পরিবর্তিত হয়। আচারব্যবহার, আহারবিহার, সংগীত, শিল্পকলা ও জীবন উপভোগের উপকরণেও লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া। মুসলমানদের আগমন ও শাসনের ফলে সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়। উত্তর ভারত পায় সংগীত, স্থাপত্য, চিত্রকলা ও অভিজাত জীবনচেতনা আর তুলনামূলকভাবে লাভবান হয় বাংলাদেশ। সে পায় মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা ও বিকাশের সুযোগ।

 

‘সন’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ বর্ষ বা বর্ষপঞ্জি। বাংলা সন অর্থ বাংলা পঞ্জিকা বা বৎসরের দিন, ক্ষণ ইত্যাদির তালিকা। বাংলা সন বলতে আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত একটি বিশেষ বৎসরের হিসাব বুঝি। বাংলা সনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় মহামতি সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। আর শেখ আবুল ফজল বাংলা সন প্রসঙ্গে তাঁর ‘আকবরনামা’ বইতে বলেছেন যে, ‘হিজরি বর্ষপঞ্জির ব্যবহার ছিল কৃষক শ্রেণির জন্য একটি ক্লেশকর ব্যাপার। কারণ চন্দ্র ও সৌরবর্র্ষের মধ্যে ১১/১২ দিনের ব্যবধান এবং এ কারণে ৩১ চান্দ্রবর্ষ ৩০ সৌরবর্ষের সমান ছিল। সে চান্দ্রবর্ষ অনুয়ায়ী রাজস্ব আদায় করা হতো তবে ফসল সংগ্রহ করা হতো সৌরবর্ষ অনুযায়ী। ফলে খাজনা আদায়ের ব্যাপারে অসুবিধায় পড়তে হতো। এ সকল অসুবিধার কথা সম্রাট আকবরের নবরত্ন ও অন্যান্য সভাসদগণের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সভাসদদের আলোচনার ভিত্তিতে মোগল সম্রাট আকবর সৌর মাসভিত্তিক বর্ষ গণনার কথা চিন্তা করেন। সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বকালের ২৯ তম বর্ষে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্যাপকভাবে সর্বত্র ১লা বৈশাখ ফসলি সনের প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে এ ফসলি সনই বাংলা সনে পরিণত হয়। পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটা বাঙালির সর্বজনীন একটি লোক উৎসব। বাঙালির আর এক মহান সংস্কৃতিসাধক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৬১-১৯৪১) পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতিকে স্বাগতম জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:

এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ।

          তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষরে দাও উড়ায়ে।

          বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।

 

শেখ আবুল ফজল বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হিসেবে সম্মানিত হবার মূল কারণ তাঁর রচনায় বৌদ্ধিক উপাদানের সর্বব্যাপী উপস্থিতি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিবর্তনে সর্বদাই যুক্তির পক্ষে তাঁর আবেদন। ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি, সে যুগের রাজনৈতিক ও প্রসাশনিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক ইতিহাস ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা, নতুন পদ্ধতিবিদ্যা যা তিনি গৃহীত কর্তব্যে প্রয়োগ করতে মনস্থ করেছিলেন এবং গদ্য রচনায় তাঁর অনন্য আশ্চর্যসুলভ শৈলী। সবশেষে, ঐতিহাসিকের ভূমিকায় তাঁর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কীর্তি হলো ‘আকবরনামা’ এবং ‘আইন-ই-আকবরি’।

 

ইতিহাসবিদ্যা মধ্যযুগীয় ভারতে চিন্তাবিদ, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ আকর্ষণের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। তাঁরা এটাকে স্বগুণে স্বতন্ত্র একটি বিদ্যাবিভাগ হিসেবে লালন ও চর্চা করতেন। তাঁদের কেউ কেউ, যেমন জিয়া উদ-দিন বারানি, নিজাম-উদ-দিন আহমদ, মোল্লা আবদুল কাদির বদাউনি, মুহাম্মদ কাসিম ফেরেশতা এবং কাফি খান বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় ইতিহাস রচনার বিশেষ অবদান রেখেছেন। ইতিহাস রচনায় পূর্বানুসৃত ঐতিহ্য তাঁদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তবে তাঁদের একেক জনের শিক্ষার ধারা লব্ধ শিক্ষা, সামাজিক অবস্থিতি এবং ধর্ম ও রাজনীতির প্রতি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র হওয়ায় তাঁরা নিজস্ব পন্থায় ইতিহাসবিদ্যায় দৃষ্টিপাত ও একে বিচার করতেন। তাহলেও এঁদের মধ্যে শেখ আবুল ফজল এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন এবং মধ্যযুগীয় ভারতে ইতিহাসমূলক রচনার ধারায় তাঁর চিহ্ন রেখে গেছেন।

 

হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন যে বর্ণিত যুগের ভাবনাকে, বারানি ও বদাউনি অধিকতর উত্তমরূপে ধরে রেখেছেন। সেভাবে নিজাম-উদ-দিন ও ফেরেশতা সফলতর ঐতিহাসিকের স্থান পেতে পারেন কারণ তাঁরা পক্ষপাতহীনভাবে বিষয়বস্তুর দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং অধিকতর বাস্তবসম্মত পথে ও স্বচ্ছ ভঙ্গিতে ঘটনাবলি নথিভুক্ত করেছেন। সকলেই সহজেই স্বীকার করেন যে কাফি খান সমাজে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং এই দুইয়ের ভেতর গড়ে ওঠা সম্পর্ক উপলব্ধি ও নথিভুক্ত করার জন্যে ন্যায়সম্মতভাবে কৃতিত্বের দাবিদার। শেখ আবুল ফজল হয়তো ঐতিহাসিকরূপে এসব গুণের অভাবী, তবে তিনি ব্যতীত অন্য কোনো মধ্যস্থানীয় ঐতিহাসিক যুক্তিনিষ্ঠ ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইতিহাস বিচার এবং নতুন পদ্ধতি প্রণালি প্রয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ, সেসবকে পর্যালোচক দৃষ্টিতে যাচাই করে সাজানো ও সংকলনের দাবি করতে পারেন না। এসব ইতিহাসমূলক রচনায় শেখ আবুল ফজলের বিশেষ মুন্সিয়ানার বিশিষ্ট লক্ষণ।

 

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে বিপুল তথ্য নথিভুক্ত এবং প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থা ও বিভিন্ন প্রদেশের ভূ-প্রকৃতি সংক্রান্ত বিবরণ সম্বলিত কয়েকটি পরিচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করে তিনি ইতিহাসের পরিসর প্রসারিত করেছেন। কঠিন পরিশ্রমে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাদান সংগ্রহ এবং সযত্নে অনুসন্ধান ও যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি বাছাই করে তারপর তিনি তাদের সুস্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল উপায়ে উপস্থাপন করতেন। একটি উৎসের বৈধতা নিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন এবং ঐতিহাসিক অনুসন্ধান সম্পর্কে তাঁর উদ্ভাবিত শর্তসমূহ পালিত হলে তবেই তিনি সেই উৎসকে গ্রহণ করতেন। তাহলে, এই অভিমত দান করা যায় যে শেখ আবুল ফজলের রচনায় আমরা ইতিহাস বর্ণন অর্থাৎ ইতিহাসের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য তার ব্যাখ্যার নীতিসূত্র, তথ্য-উপাদান সংগ্রহ এবং নির্বাচনের জন্যে একটি জিজ্ঞাসামূলক পদ্ধতি সমষ্টি বিষয়ে নির্দিষ্ট ধারণা লাভ করতে পারি।

 

২. 

শেখ আবুল ফজলের জন্ম ১৫৫১ সালের ১৪ জানুয়ারি আগ্রার যমুনা তীরে রামবাগে। সেকালে যা চারবাগ নামে পরিচিত ছিল। তাঁর বাবা শেখ মুবারক তাঁর সময়ের একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত এবং সেইসঙ্গে উদার চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। সে কারণে মোল্লারা তাঁকে বিধর্মী বলে তাঁর ওপর সব রকম উৎপীড়ন চালাতে উদ্যত হয়েছিল এবং শেখকে আত্মগোপন করে চলতে হতো। তিনি কখনো সুফি-সন্তের বেশ ধারণ করে সাধনা-উপাসনা করতেন, কখনো মোল্লাদের থেকেও দুই পা বেশি এগিয়ে গিয়ে সংগীতের আওয়াজ শোনামাত্র কানে আঙুল দিতেন, কেউ ইসলামধর্মশাস্ত্র বিরুদ্ধে দীর্ঘ পোশাক পরিধান করলে তাকে বাড়তি অংশ ছেঁটে ফেলার জন্যে বাধ্য করতেও দ্বিধা করতেন না। তাঁর পাণ্ডিত্য থেকে লাভবান হতে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্ররা আসত তাঁর কাছে। মোল্লা আবদুল কাদের বদাউনি তাঁরই শিষ্যদের অন্যতম ছিলেন।

 

শেখ আবুল ফজলের পিতা শেখ মুবারকের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপনের মধ্যেই তাঁর শৈশব কেটেছে। তিনি ‘আকবরনামা’র তৃতীয় খণ্ডের নিজের প্রথম জীবনের কিছু কথা লিখেছেন। বলেছেন, “এক সওয়া-এক বছরের মধ্যে আল্লাহর রহমতে আমার মুখে আরও পরিস্কার কথা ফুটতে শুরু করল। পাঁচ বছর বয়সেই অলৌকিক প্রতিভার জানালা খুলে গেল। এমন সব কথা আমার বোধগম্য হতে থাকে যা অন্য কারো কপালে জোটে নাই। পনেরো বছর বয়সে আমি পূজনীয় পিতার জ্ঞানভাণ্ডারের খাজাঞ্চি এবং তত্ত্বরত্নের পাহাদার বনে গেলাম। কোষাগারে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলাম। শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনার জন্যে আমায় মন সর্বদা উৎসুক হয়ে থাকত। তুচ্ছ সাংসারিক কাজকর্মের কথা শুনলে মন শত যোজন দূরে বিক্ষিপ্ত হতো। প্রায়ই কিছু বুঝে ওঠতে পারতাম না। বাবা নিজের মতো করেই আমাকে পড়াতেন, কানের কাছে জ্ঞানের মন্ত্র আওড়াতেন। প্রত্যেক বিষয়ে এক-একখানা বই লিখে মুখস্থ করাতেন। যদিও জ্ঞান বাড়ছিল, তথাপি মন বসছিল না। কখনো কখনো কিছুই মাথায় আসত না, কখনো সংশয় পথ অবরোধ করে দাঁড়াত, ভাষার বাণী সাহায্য করত না, অবরোধ সামান্য হালকা করে দিত মাত্র। বক্তৃতাতেও আমি পারদর্শী ছিলাম, তবে মুখে কথা যোগাত না। লোকজনের সামনে আমার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসত, নিজেকেই ধিক্কার দিতাম। ... যাদের বিদ্বান বলা হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যায় দেখেছি, তাই মনে মনে চাইতাম, একা থাকব, কোথাও পালিয়ে যাব। দিনের বেলায় মাদ্রাসায় জ্ঞানচর্চার আলোয় থাকতাম। রাতের বেলা নির্জন ধ্বংসস্তুপে ছুটে বেড়াতাম। ইতোমধ্যে একজন সহপাঠীর সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেল, ফলে মাদ্রাসার প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়ল।”

 

শেখ আবুল ফজল আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। নাম-ধাম যাই হোক তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ভারতীয়। গায়ের রঙও ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। তিনি বলতেন– ফর্সাদের হৃদয় কালো হতে পারে তবে আমার গায়ের রঙ কালো হলেও হৃদয় সাদা।’ তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘরে দারিদ্র্যের সীমা-পরিসীমা ছিল না তবে শেখ আবুল ফজল বুঝতে পারতেন না তাঁর ক্ষিদে পেয়েছে না পেট ভর্তি। যখন পড়ালেখায় মন দিতেন তখন যেন দশ বছরের জন্যে সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। দুই-তিন দিন পর্যন্ত তাঁর খাওয়ার কথা খেয়াল থাকত না; জ্ঞানের ক্ষুধার সামনে পেটের ক্ষুধা বেমালুম ভুলে যেতেন। তখনও তিনি বালকমাত্র। তবুও আলিমদের কথাবার্তা শুনে তাঁর সংশয় দেখা দিত। তাঁরা পরস্পরের কাছে নিজেদের মত প্রকাশ করতেন, শিশু ভেবে তাঁর দিকে মনোযোগ দিতেন না। শেখ আবুল ফজলের মন তিক্তবিরক্ত হয়ে ওঠত। তাঁর সৌভাগ্য ছিল যে শেখ মুবারকের মতো বাবা পেয়েছিলেন, তিনি সংশয়কে অহেতুক মনে করতেন না।

 

পনেরো বছরে পা দিতে না দিতেই শেখ আবুল ফজল অধ্যাপনা শুরু করলেন। ‘হাশিয়া-আস্ফাহানি’ (আসফাহানি রচিত টীকা) পাড়ানো হচ্ছিল। বইখানিও এমন জুটেছিল যে তা পৃষ্ঠাসমূহের অর্ধেকের বেশি উইপোকায় খাওয়া। শেখ আবুল ফজল প্রথমে পোকা-খাওয়া পাতাগুলোর ধারে ধারে কাগজ সাঁটলেন। তারপর উষাকালে বসে যে যে বাক্য কাটা পড়েছে তার আদি ও অন্ত দেখে, কিছু ভেবেচিন্তে খানিকটা অর্থ অনুমান করে লিখে গেলেন। এভাবে সম্পূর্ণ বইটা পূর্ণ কররেন। মিলিয়ে দেখা গেল মাত্র বত্রিশ জায়গায় কেবল বিকল্প শব্দের ব্যবধান, তিন-চার জায়গায় একই শব্দ। লোকে দেখে অবাক হয়েছিল।

 

৩.

সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণ আঠারো বছর অতিক্রান্ত। তখন তাঁর বয়স ত্রিশ বছর। সাম্রাজ্য সুদৃঢ় হয়েছে, তবে সম্রাট আকবর তাতেই সন্তুষ্ট হবার মানুষ নয়। তিনি ভারতের জন্যে এক নতুন স্বপ্ন দেখছিলেন– বিশাল, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী ভারত। সম্রাট আকবরের দরবারে ফৈজির

যোগদান পাঁচ বছর হয়ে গেছে। শেখ আবুল ফজলের বয়স তখন কুড়ি বছর, বয়সে নবীন, তবে বিদ্যায় প্রধান। তিনি তাঁর চারদিকের জগত দেখে দেখে অসন্তুষ্ট। যেসব শাস্ত্র পাঠ করছেন, তাতেও তাঁর অসন্তোষ কাটে নাই। যখন আলিমদের মধ্যে আরও বেশি অন্যায়-অবিচার লক্ষ করলেন, তখন তাঁর মন সংসার ছেড়ে বিবাগী হতে চাইল। কখনো ফকির-সন্তদের কাছে যেতে ইচ্ছে করত, কখনো বা তিব্বতের লামাদের বিষয়ে নানা কথা শুনে তাঁদের কাছে যাবার জন্যে মন ছটফট করত। কখনো মন বলত, পর্তুগালের পাদ্রিদের সংঘে সামিল হয়ে যাও। কখনো আবার ভাবতেন, আতা পারসি মোবিদদের কাছে চলে যাব। শেখ আবুল ফজলের যোগ্যতার খবর আগেই পেয়েছিলেন সম্রাট আকবর। যখন দরবারে যোগ দেয়ার প্রস্তাব এল, তখন প্রথম প্রথম তাঁর যেতে ইচ্ছে করছিল না। বাবা বোঝালেন– সম্রাট আকবর অন্য রকমের মানুষ। তাঁর কাছে গেলে তোমার সংশয় দূর হবে। যদি বাবা অন্য মোল্লাদের মতো সংকীর্ণমনা হতেন, তাহলে সম্ভবত শেখ আবুল ফজলের ওপর তাঁর কথার কোনো প্রভাব পড়ত না। তবে তিনি বাবার চিন্তাভাবনা জানতেন, তাঁর পরামর্শ মনঃপূত হলো। সম্রাট আকবর সে সময় ছিলেন আগ্রায়। তাঁকে কুর্নিশ করার সৌভাগ্য হলো শেখ আবুল ফজলের। তখনকার মতো ওই পর্যন্তই হয়ে থাকল। বাংলাদেশে গোলমাল দেখা দিলে সম্রাট সেদিকে যাত্রা করেন। বড় ভাই ফৈজি ছিলেন সম্রাট আকবরের ছায়া। তিনি চিঠি লিখে জানাতেন সম্রাট তোমার কথা স্মরণ করেন। পাটনা জিতে আজমির এলেন তো ফের জানতে পারলেন, সম্রাট তাঁর কথা মনে রেখেছেন।

 

যখন সম্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে এলেন, তখন বাবার অনুমতি নিয়ে শেখ আবুল ফজল ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলেন। পরদিন জুমা মসজিদে বাদশাহ এলেন। শেখ আবুল ফজল দূর থেকে কুর্নিশ করলেন। চোখে পড়তেই সম্রাট আকবর তাঁকে নাম ধরে নিজের কাছে ডাকলেন। শেখ আবুল ফজল ভাবলেন, হয়তো অন্য কোনো আবুল ফজল হবে। তবে যখন বুঝলেন যে তাঁরই ভাগ্য ফিরেছে, তখন সেখানে দৌঁড়ে গেলেন। সেই সংসার ও ধর্মের মানুষের ভিড়েও সম্রাট বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন তাঁর সঙ্গে। শেখ আবুল ফজল কোরআনের সুরা ‘ফাতিহা’র ভাষ্য লিখে রেখেছিলেন সেটা সম্রাট আকবরকে উপহার দিলেন। সম্রাট আকবর তাঁর মোসাহেবদের এই সুরাটি সম্পর্কে এমন এমন কথা বললেন যা তাঁর নিজেরও জানা ছিল না। তখন থেকেই শেখ আবুল ফজল সম্রাট আকবরের দরবারে থেকে গেলেন তবে দুটি বছর তাঁর মনের উচাটন দূর হয় নাই।

 

মোল্লা আবদুল কাদের বদাউনি তখনকার বিষয়ে লিখেছেন– “৯৮২ হিজরিতে (১৫৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে) সম্রাট আকবর আজমির থেকে ফিরে ফতেহপুর ছিলেন। খানকাহ্ (সেলিম বিশতির আখড়া) এর পাশে উপাসনা-মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তাতে চারটি কক্ষ ছিল। সেই সময় শেখ মুবারক নাগৌরীর উপযুক্ত পুত্র শেখ আবুল ফজল। অনেকে যাঁকে আল্লামি বলে কি লিখে থাকেন। সম্রাটের কর্মচারী নিযুক্ত হন। তিনি জ্ঞানবুদ্ধিতে জগতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। যে তাঁর বিরোধিতা করেছেন, তাঁকেই শেষ করেছেন। সমস্ত ধর্মমতের বিরোধিতা করাটাই যেন নিজের কর্তব্য বলে মনে করেন। সেই কাজের জন্যে কোমর বেঁধে নেমেছেন তিনি।”

 

মোল্লা আবদুল কাদের বদাউনি যে পর্যন্ত প্রবীণ গোঁড়াপন্থিদের মূলোচ্ছেদ করার প্রশ্ন ছিল, ততদূর অবধি শেখ আবুল ফজলের সঙ্গে ছিলেন। তবে নিজের মোল্লাপনার প্রতিও তাঁর দুর্বলতা ছিল। মোল্লা আবদুল কাদের বদাউনি আবার লিখেছেন, “এখন শেখ মুবারকের দুই পুত্রের আধিপত্য চলছে। শেখ আবুল ফজল সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতা, তাঁর সেবা করা, নিজের বাস্তব বুদ্ধি, অধর্মাচরণ এবং সীমাহীন খোশামোদে এমন ক্ষমতা লাভ করেছেন, যে দল চুকলি খেয়েছে, অনুচিত চেষ্ট-চরিত্র করেছে, তিনি তাদের জঘন্যভাবে দুর্নাম রটিয়েছেন। পুরনো গম্বুজের মূলোৎপাটন করে ফেলে দিয়েছেন। বলতে গেলে, সমস্ত ঈশ্বর ভক্ত, সন্ত, আলিম, অনাথ, অক্ষমের বৃত্তি-অনুদান খারিজ করে দেয়ার মূল কারণ তিনিই। শেখ আবুল ফজল সত্যসত্যই আগুন জ্বালিয়ে সমস্ত জঞ্জাল ভস্মীভূত করে দেয়ার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন।

 

মোল্লারা প্রাচীনকালের বড় বড় আলিম ও ধর্মাবলম্বীদের বক্তব্য পেশ করতেন। বিতর্ক হতো। শেখ আবুল ফজল বলতেন, ‘অমুক ময়রা, অমুক মুচি, অমুক চামারের বক্তব্যও পেশ করছেন না কেন? তারা কোনো বিখ্যাত নাম ও বাক্যবাগীশের মধ্যে পড়ে না। যে কথা যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বোঝানো যায় না, তাদের মনে সে কথার কোনো ইজ্জত নাই। সম্রাট আকবরও তার মতামত সমর্থন করতেন।

 

শেখ আবুল ফজল ছিলেন বাণীর বরপুত্র। এমন বাণী ও লেখনীর খুব প্রয়োজন ছিল সম্রাট আকবরের। তিনি লিপি বিভাগে শেখ আবুল ফজলকে কাজ দিয়েছিলেন এবং ‘সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অভিযানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করারও ভার দিয়েছিলেন তাঁর ওপর। যে কোনো কাজই তিনি এমন সুচারুরূপে সমপন্ন করতেন যে তাঁকে ছাড়া কোনো কাজই সম্রাটের পছন্দ হতো না। পেটে ব্যথা হলে তো হাকিমও শেখ আবুল ফজলের মতামত নিয়ে ঔষধপত্র দিতেন। ঘা-ফোড়ায় মলম লাগাতে হবে, তার ব্যবস্থাপত্রও শেখ আবুল ফজলের পরামর্শ জুড়ে দেওয়া হতো। তখন আর কুরআনের ভাষ্যকার হওয়ার প্রয়োজন ছিল না শেখ আবুল ফজলের।

 

সম্রাট আকবরের দরবারে আসার চার বছর পরে ৯৯৩ হিজরিতে (১৫৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে) শেখ আবুল ফজলের অনেক উন্নতি ঘটে। সেই সময় তিনি এক হাজারী মনসব লাভ করেন। চেঙ্গিস খান তাঁর শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন পদমর্যাদাকে দশ, শত, হাজার ইত্যাদি ক্রমানুসারে ভাগ করেছিলেন। বাবরও তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমুর খানের মর্যাদা কম ছিল না এবং তাঁরা বহু ব্যাপারে চেঙ্গিস খানের প্রথা অনুসরণ করতেন। চেঙ্গিস খানের দপ্তরে কাজ প্রথমে সেখানকার ভিক্ষুরা সামলাতেন। মঙ্গোল ভাষায় ভিক্ষুকে বখশি বলা হয়। পরে মুনশিদের (লেখক) নামই বখশি হয়ে যায়। এই পদটিও বাবরের সাথে ভারতে এসেছিল। বর্তমানে কত হিন্দু-মুসলিম নিজেদের নামের সঙ্গে বখশি জুড়ে গৌরব অনুভব করেন। একইভাবে একহাজারী দুহাজারী, পাঁচ হাজারী পদ(মনসব)ও বাবরের মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল।

 

১৫৮৮-৮৯ খ্রিস্টাব্দে (৯৯৯ হিজরি) শেখ আবুল ফজল সম্রাট আকবরের সাথে লাহোরে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স উনচল্লিশ বছর। সেই বছরেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। নিজেদের মাতাপিতার প্রতি দুই ভাইয়েরই অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল। তাই তাঁরা দুই ভাই মাতৃশোকে খুবই মর্মাহত হন।

 

সম্রাট আকবর তাঁকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘যদি পৃথিবীর সমস্ত মানুষ অমর হতো এবং একজন ব্যতীত কাউকেই মৃত্যুপথের যাত্রী হতে না হতো, তবুও তার বন্ধুদের জন্যে আত্মসংবরণ করা ছাড়া উপায় থাকত না। তাহলে এ পান্থনিবাসে যখন কারও বেশি সময় থাকার কথা নয়, তখন অধৈর্য হয়ে লাভ কি?’

 

শেখ আবুল ফজলের একজনই পুত্র ছিলেন। শেখ আবদুর রহমান। পিতার মতো সমস্ত যোগ্যতা তো তাঁর ছিলই, সেইসঙ্গে কুশলী তলোয়ারবাজও ছিলেন। মাতার মৃত্যুর দুই বছর পর শেখ আবুল ফজলের পুত্র জন্মগ্রহণ করে। সম্রাট আকবর তার নাম রাখেন পশোতন। সেটা আরবি নামও নয়, ইসলামিও নয়। এ থেকেই বোঝা যায় যে সে সময় কি রকম হাওয়া চলছিল।

 

১৫৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে (১০০০ হিজরি) শেখ আবুল ফজল দু’হাজারী মনসব পান এবং তার চার বছর পর আড়াই হাজারী। একজন সমালোচক লিখেছেন, ‘তিনি আকবরের পারিষদ, উপদেষ্টা, বিশ্বাসভাজন, মির-মুনশি (প্রধান সচিব), ওয়াকিয়া নেগার (ইতিহাস লেখক), আইনপ্রণেতা, দিওয়ান (শাসন বিভাগ)– অধ্যক্ষই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সম্রাটের মুখের ভাষা, না না, তাঁর বুদ্ধির চাবিকাঠি। বলুন, আলেকজান্ডারের সামনে এরিস্টটল। লোক মুখে যাই বলুক, প্রশ্ন করেন, ওই সব পদের যোগ্যতা তাঁর ছিল কি ছিল না। তাহলে দৈববাণী শুনতে পাবেন– ওইসব পদের চেয়ে অনেক উঁচু পদের যোগ্য ছিলেন তিনি।”

 

৪.

১৫৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দে (১০০৬ হিজরি) দাক্ষিণাত্যের সমস্যা খুবই সংকটজনক হয়ে ওঠে। দক্ষিণের দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজের অধিকারে নিয়ে আসার জন্যে আকবর অনেক বড় বড় সেনাপতির সঙ্গে শাহজাদা মুরাদকে প্রেরণ করেছিলেন। তবে মুরাদ সুরাপান করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকেন এবং সেনাপতিদের নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। তার এক বছর আগে সমরখন্দের উজবেক সুলতান আবদুল্লাহর মৃত্যু হয়। উজবেকরা বাবরকে তাদের দেশ থেকে মেরে তাড়িয়েছিল। আকবরের রক্তে প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল যে তিনি সমরখন্দ পুনরাধিকার করেন। তখন তাঁর অনুকুল পরিস্থিতি, কেননা তৈমুর বংশীয় শাহজাদাদের আত্মকলহের নিমিত্ত উজবেকদের পক্ষে সমরখন্দ গ্রাস করার যেমন সুযোগ হয়েছিল তেমনি সুযোগ এখন আকবরের সম্মুখে। তবে এদিকে দক্ষিণেরও দিগবিজয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সেখান থেকেও পিছিয়ে আসতে পারেন না। আকবর এবং তাঁর দেশের দুর্ভাগ্য যে তিনি একজনও উপযুক্ত পুত্র লাভ করেন নাই। বাসনা ছিল বড় পুত্র সলিমকে সৈন্য-সামন্তসহ তুর্কিস্তান প্রেরণ করবেন, তবে তিনিও মদ্যপানে মত্ত হয়ে থাকেন। দ্বিতীয় পুত্র দানিয়াল সম্পর্কে সংবাদ পেয়েছেন, তিনি এলাহাবাদ থেকে আরও আগে চলে গিয়েছেন, তাঁর মনোভাব ভালো নয়। তুরানের চিন্তা ত্যাগ করে সম্রাট আকবর প্রথমে আহমদনগরের যুদ্ধ সামলানোই সঠিক মনে করলেন, কারণ সেখানে বীরাঙ্গনা চাঁদবিবি সম্রাট আকবরের সেনাপতিদের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। সম্রাট আকবর লাহোর থেকে রওনা দিলেন এবং শেখ আবুল ফজলকে বললেন, ‘ভেবে দেখলাম, দাক্ষিণাত্য অভিযানে হয় আমাকে না হয় তোমাকেই যেতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো সঠিক উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’

 

সম্রাট আকবর ১৫৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে শেখ আবুল ফজলকে হুকুম দিয়ে বললেন, ‘শাহজাদা মুরাদকে সঙ্গে নিয়ে যাও। যদি কোনো সেনাপতি সেখানকার কাজের দায়িত্ব নিতে চায় ভালোই, নইলে শাহজাদাকে পাঠিয়ে দেবে, আর তুমি সেখানেই থেকে সব দেখাশোনা করবে। শেখ আবুল ফজলকে এবার লেখনী ছেড়ে তরবারি ধরতে হলো। তাঁরা বুরহানপুর পৌঁছুলেন, তো আসিরগড়ের শাসনকর্তা বাহাদুর খানও চার ক্রোশ পথ নিচে নেমে স্বাগত জানাতে এলেন। তিনি তাঁকে আতিথ্য গ্রহণ করার জন্যে অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন তবে এমন আতিশ্য গ্রহণ করার অবকাশ কোথায়! বুরহানপুরে উপস্থিত হলেন তো বাহাদুর খানও সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন। শেখ আবুল ফজল বাদশাহী ফৌজের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্যে তাঁকে বললেন, তবে তিনি নানা অজুহাত দেখাতে শুরু করলেন। তবে হ্যাঁ, এক হাজার সৈন্যসহ তাঁর পুত্র ফকির খানকে শেখ আবুল ফজলের সঙ্গে দিলেন।

শেখ আবুল ফজল লিখেছেন, ‘আমাকে এই কাজ দেয়া দরবারের বহু আমিরের পছন্দ ছিল না। তাঁরা সব রকমের বাধা সৃষ্টি করছিলেন।’ অনেক পুরনো সঙ্গী-সাথী দূরে সরে গিয়েছিল। তাঁকে নতুন সৈন্যের বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল। ভাগ্য ভালো ছিল, বহু সেপাই  এসে যোগ দিয়েছিল। শেখ আবুল ফজল একজন অভিজ্ঞ সেনাপতির মতো সম্মুখে অগ্রসর হলেন। শাহজাদার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। শেখ আবুল ফজল গিয়ে পৌঁছানোর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে এই রকম একটা পরিস্থিতি সামলাতে হলো। শাহপুরে শাহজাদার মৃতদেহ পাঠিয়ে সেখানে দাফন করা হলো। তখনও কিছু লোক তিলকে তাল করার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। এমন সময় পেছনে রেখে আসা তিন হাজার সৈন্য এসে হাজির হলো, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের মাথা ঠাণ্ডা হলো তাতে। এই যুদ্ধে শেখ আবুল ফজলের পুত্র শেখ আবদুর রহমানও পিতার সাথে ছিলেন। বাদশাহী ফৌজ নিয়ে শেখ আবুল ফজল আহমদনগরের দিকে অগ্রসর হলেন। পথে গোদাবরি নদী, তার পানি বাড়ছিল। কপাল গুণে দ্রুতই তাঁরা সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন বলে সৈন্যবাহিনী সহজেই নদী পার হলো। নদী তীরে আহমদনগরের সৈন্যদের নজর পড়তেই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেল।

শেখ আবুল ফজল যখন আহমদনগরের বিশৃঙ্খলা দমন করতে ব্যস্ত, সেই সময় সম্রাট আকবরের পুত্র সলিম ওরফে জাহাঙ্গীরের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটল, পিতার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আগ্রা ত্যাগ করে চলে গেলেন তিনি। সলিম অযোগ্য ছিলেন তবে অন্য পুত্ররাও তাই। অনেক তপস্যা ও সাধুমন্ত্রের আশীর্বাদে সম্রাট আকবর এই প্রথম পুত্র লাভ করেছিলেন, সেজন্যে তাঁর প্রতিই সম্রাট আকবরের স্নেহ ভালবাসা ছিল অধিকতর।

 

আহমদনগরের সুলতান বুরহানুলমূলক রাজপাটে বঞ্চিত হয়ে আকবরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। বাদশাহের সাহায্যেই তিনি পুনরায় রাজ্যশাসন লাভ করেন। আশা করা হয়েছিল, তিনি সম্রাট আকবরের প্রভুত্ব অস্বীকার করবেন না। তবে দাক্ষিণী তাতে রাজি ছিলেন না। এখন বুরহানুলমূলক নাই, তিনি দেহত্যাগ করেছেন। তাঁর পুত্র বাহাদুর খানকে সিংহাসনে বসিয়ে পিতৃষ্বসা চাঁদবিবি সুলতানি রক্ষা করার জন্যে হাতে তরবারি তুলে নিয়েছেন। চাঁদবিবি যেমন সাহসিনী ছিলেন, তেমনি বিচক্ষণও ছিলেন। দরবারে সভাসদদের তিনি বিশ্বাস করতে পারতেন না। তিনি সম্রাট আকবরের বাদশাহীর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে আপস করার কথা ভাবলেন। সে কথা লিখে জানালে আবুল ফজল জবাব দিলেন, ‘যদি দূরদর্শিতা ও সৌভাগ্যের জন্যে দরবারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে চান, তাহলে তার চেয়ে ভালো কি?’ চাঁদবিবি নিজ হাতে অঙ্গীকারপত্র লিখে পাঠিয়ে দিলেন, ‘যখন আপনি আমঙ্গ খানকে (আহমদনগরের সেনাপতি) পরাজিত করেন, তখন আমি আপনাকে দুর্গের চাবি দিবো। তবে এইটুকু প্রার্থনা, দৌলতবাদ যেন আমার জায়গির থাকে, আর এই অনুমতিও চাই যে, আমি কয়েকদিন সেখানে গিয়ে থাকব এবং যখন আমার ইচ্ছে হবে দরগায় হাজির হব। বাহাদুরকে আমি দরবারে পাঠিয়ে দেবো।

তবে সেসবের কিছুই হলো না। তরবারির সাহায্যেই আবুল ফজলকে জয়লাভের চেষ্টা করতে হলো।

 

এদিকে আমিরগড়ের দিকে মনোযোগ দেয়া জরুরি হয়ে পড়ল। কেননা আমিরগড় বিদ্রোহী হয়ে পড়লে বাদশাহী ফৌজের পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশংকা। আমিরগড় দক্ষিণের প্রবেশপথ। পাহাড়ের ওপর এমন অনেক দুর্গ ছিল, যার উচ্চতা ও দৃঢ়তা অতুলনীয়। পাহাড়ের কটিদেশে উত্তর দিকে মালি দুর্গ। মালি হয়েই আমিরগড়ে যাওয়া যেত। ওই দুর্গের উত্তরে ছোট মালি, আর প্রাচীরের সামান্য অংশই নির্মিত রাকি সমস্তটাই পাহাড়ের পার্শ্বদেশ প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দক্ষিণের দিকে কর্দা নামক পাহাড় আর পার্শ্বদেশকে পাহাড়ী সর্পিণী চলা হতো।  শত্রুরা প্রতিরক্ষার জন্যে সব রকমের কামান আর সেপাই মোতায়েন করে রেখেছিল। আসিরগড়কে লোকে বলত অজেয়। বাদশাহী ফৌজ আক্রমণ করত তবে তাতে শত্রুদের কোনো ক্ষতি হতো না। শেখ আবুল ফজলকে সেই আসিরগড় জয় করতে হবে। তিনি একটা গোপন পথ খুঁজে বের করলেন। যে পথে আচমকা মালিয় প্রাচীরের নিচে গিয়ে পৌঁছানো সম্ভব।

 

অন্ধকার রাত্রি, বৃষ্টি পড়ছিল। সেই সময় শেখ আবুল ফজল কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সর্পিণী পাহাড়ে চড়তে শুরু করলেন। তৃতীয় প্রহরে সৈন্যরা সেই চোরাপথে গিয়ে মালি দুর্গের ফটক ভেঙ্গে ফেলল। কিছু সৈন্য দুর্গে প্রবেশ করে নাকাড়া বাজাতে লাগলো। নাকাড়ার আওয়াজ শুনেই শেখ আবুল ফজল সেদিকে দৌঁড়ালেন। ভোরের আলো ফুটতেই সকলে হাজির হলেন সেখানে। প্রাচীরের অন্য দিকে মই লাগিয়ে সকলের আগে শেখ আবুল ফজল উপরে উঠে দুর্গের মধ্যে লাফিয়ে পড়লেন। তারপর অন্য সৈন্যরাও পিপড়ের সারির মতো উপরে উঠে পড়লো। বাধ্য হয়ে শত্রুসৈন্য আসিরগড়ের দিকে পালিয়ে গেল। তখন মালি দুর্গ শেখ আবুল ফজলের দখলে। ওদিকে খবর পাওয়া গেল যে দানিয়াল ও খানখানা আবদুর রহীম আহমদনগর জয় করে নিয়েছেন। বাহাদুর খানের আর ততটুকু সাহস অবশিষ্ট রইলো না। তিনি আসিরগড় সমর্পণ করলেন। সেটা ১৬০০-১৬০১ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। এই সময় বীরত্বের এক আশ্চর্য দৃশ্য শেখ আবুল ফজল প্রত্যক্ষ করলেন। পরাতম নামে সুলতান বাহাদুর খান গুজরাতীয় একজন কর্মচারী ছিল। সে বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে পড়েছিল বলে তার যুবক পুত্র দুর্গের দেখাশোনা করত। দুর্গের চাবি থাকত বৃদ্ধের কাছেই। সে যখন শুনল যে বাহাদুর খান মোগলদের হাতে দুর্গ সমর্পণ করেছে, তখন সে মনে এত আঘাত পায় যে তৎক্ষণাৎ তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। তার পুত্ররা বলল– ‘এই সুলতানির কপাল পুড়েছে। আমাদের আর বেঁচে থাকা লজ্জার কথা।’ এই বলেই তারা আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করে।

 

দক্ষিণে আসিরগড় ও আহমদনগর বিজয় এক অসাধারণ জয়লাভ। সুতরাং আনন্দ হওয়ারই কথা। তবে খবর এল জাহাঙ্গীর প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বাদশাহর হুকুম এল, আহমদনগর গিয়ে খানখানার (রহিম) সঙ্গে কাজে হাত দাও। শেখ আবুল ফজল সেখানে গিয়ে খানখানা ও নিজ পুত্র আবদুর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজকর্ম সামলালেন। তারপর তাঁর প্রত্যাবর্তনের ফরমান এল বাদশাহের কাছ থেকে। সলিমের বুদ্ধি কম ছিল। সেটা এ থেকেই বোঝা যায় যে তিনি বরাবর নূরজাহানের হাতের পুতুল হয়ে ছিলেন। একবার হয়ত সুমতি হয়েছিল তবে ১৬০২-৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় লোকে তাঁর মন বিষাক্ত করে তোলে। জয়পুরের রাজা মানসিংহের বোনের সঙ্গে সলিমের বিবাহ হয়, তাদেরই পুত্র শাহজাদা খসরো। পিতামহ তাঁকে অত্যন্ত আদর করতেন। লোকে সলিমকে বেঝায় যে বাদশাহ তাঁকে বঞ্চিত করে খসরোকে যুবরাজ করবেন এবং এ কথাও বোঝানো হয় যে, এর পেছনে শেখ আবুল ফজলের মন্ত্রণা আছে। শেখ আবুল ফজল সম্রাট আকবরের জন্যে নিজের সবকিছু সমর্পণ করেছিলেন, তবে তার অর্থ এই নয় যে তিনি পিতাপুত্রের মতবেদ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াবেন। তবে সলিম ভাবতেন যে শেখ আবুল ফজল তাঁর নামে কুৎসা রটায় সে ভাল। যখন তিনি জানতে পারলেন, সম্রাটের ফরমান পাটানো হয়েছে এবং শেখ আবুল ফজল প্রত্যাবর্তন করছেন, তখন তিনি আরও শঙ্কিত হলেন। শেখ আবুল ফজলকে তিনি পথের সরচেয়ে বড় কাঁটা মনে করতেন।

 

৫.

১৬০২ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট। শেখ আবুল ফজল অশ্বারোহণে দ্রুতবেগে আগ্রার দিকে চলেছেন, সঙ্গে অল্পসংখ্যক সেনা। বররা সরাই থেকে আধ ক্রোশ এবং ছোট শহর অন্তরি থেকে তিন ক্রোশ– এমন স্থানে পৌঁছলে সামনে উৎক্ষিপ্ত ধূলিবালি দেখে শেখ আবুল ফজল ঘোড়ার বল্গা টেনে ধরে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করছিলেন তাঁর ভক্ত সেবক গদাই খান পাঠান নিকটে ছিলেন, তিনি অনুরোধ করলেন– “এখন দাঁড়াবার সময় নাই। মনে হচ্ছে শত্রুরা খুব দ্রুতবেগে আসছে। আমাদের লোকজন কম। আপনি ধীরে সুস্থে ফিরে যান। আমি আমার লোকজন নিয়ে ওদের আটকাব। আমাদের প্রাণ দিতে দিতেই আপনি সহজে অন্তরি পৌঁছে যাবেন। সেখানে পৌঁছতে পারলে আর কোনো ভয় নাই, কারণ রাজা রাজসিংহ সেখানে তিন হাজার সৈন্য নিয়ে পৌঁছে গেছেন।”

 

শেখ আবুল ফজল বললেন, “গদাই খান, তোমার মতো মানুষের মুখে এ কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। এ সময়ে কি রকম পরামর্শ দেয়া উচিত? জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর বাদশাহ আমার মতো এক ফকির সন্তানকে মসজিদের কোণ থেকে তুলে এনে সদর (প্রধানমন্ত্রী)-এর পদে বসিয়েছেন। আজ কি আমি তাঁর প্রতিষ্ঠা মাটিতে মিশে যেতে দেব? ওই চোরের সামনে থেকে পালিয়ে যাব? তারপর অন্যদের সামনে মুখ দেখাব কি করে? যদি পারমায়ু শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, কপালে মৃত্যু লেখা থাকে তাহলে আর কি করা যাবে।

শেখ আবুল ফজল নির্ভয়ে ঘোড়ার লাগাম হাতে ধরে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলেন। গদাই খান আবার দৌঁড়ে সামনে এসে বললেন, ‘এরকম পরিস্থিতিতে সৈন্যদের অনেকবার পড়তে হয়। এখন মোকাবিলা করার সময় নয়। অন্তরী গিয়ে সেখান থেকে লোকজন নিয়ে এসে প্রতিশোধ নেয়াই সৈনিকের রণকৌশল।”

 

তবে শেখ আবুল ফজল তাঁর কথা মানতে চাইলেন না। শাহজাদা সলিম তাঁর পথের কাঁটা শেখ আবুল ফজলকে সরিয়ে দেয়ার কথা ভেবেছিলেন। তাঁকে জানানো হয়েছিল শেখ আবুল ফজলের ফিরে আসার পথ বুন্দেলদের দেশের ভিতর দিয়ে। ওরছার রাজা নরসিংহদেবের পুত্র মধুকর ইদানিং বিদ্রোহের কাজে নেমে পড়েছেন। তিনি এ কাজে সাহায্য করতে পারেন। সলিম মধুকরকে লিখেছিলেন যে, ‘যদি তুমি শেখ আবুল ফজলকে খতম করতে পারো তাহলে আমি সিংহাসনে বসার পর তোমাকে অঢেল ধনসম্পদ দেবো।’

মধুকর তাঁর লোকজন নিয়ে শেখের কাছে পৌঁছে গেলেন। শেখ আবুল ফজলের এখন একান্ন বছর বয়স তবে যেন যৌবনের তেজে তাঁর রক্ত ফুটছে টগবগ করে। তরবারি হাতে নিয়ে তিনি মুখোমুখি সংঘর্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন। সঙ্গী পাঠানরাও প্রাণপণ লড়াই করছিল। শেখ আবুল ফজলের শরীরে কয়েকটা চোট লেগেছিল। তারপর একটা বর্শা এসে তাঁকে এমন সজোরে আঘাত করল যে তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলেন। অন্য সৈন্যরা যখন যুদ্ধে  ব্যস্ত। শেষে বুন্দেলরা শেখ আবুল ফজলের নিষ্প্রাণ শরীর একটা গাছের নিচে দেখতে পায়। সেখানে আশেপাশে আও অনেক লাশ পড়েছিল। মধুকর শেখ আবুল ফজলের মাথা কেটে শাহজাদা সলিমের নিকট পাঠিয়ে দেন। শাহজাদা সলিম সেটাকে শৌচাগারে নিক্ষেপ করেন। বেশ কিছুদিন সেখানেই তা পড়ে থাকে। শাহজাদা সলিম জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করে ওরছার রাজা মধুকরকে তিনহাজারী মনসব দিয়েছিলেন। শেখ আবুল ফজলকে অন্তরিতে সমাধিস্থ করা হয়। গওয়ালিয়রের পাঁচ ক্রোশ দূরে অবস্থিত একটা ছোট পলি­গ্রামে আজও ইতিহাসের অদ্বিতীয় রাজনীতিবিদ, পরম দেশপ্রেমিক শুয়ে আছেন।

 

সম্রাট আকবরের কাছে সেই দুঃসংবাদ পৌঁছানের সাহস দেখাতে পারে কে? সকলেরই চিন্তা, বাদশাহের কাছে প্রসঙ্গটি কিভাবে উত্থাপন করা যায়। সম্রাট আকবরের নিকটে শেখ আবুল ফজল ছিলেন বাইরে বিচরণশীল তাঁর প্রাণ। তিনি জানতেন, আবুল ফজলই তাঁর সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ হিতাকাঙ্ক্ষী। তৈমুর বংশের রীতি ছিল, যখন কোনো শাহজাদার মৃত্যু হতো তখন সেই সংবাদ বাদশাহকে সরাসরি জানানো হতো না। মৃত ব্যক্তির প্রতিনিধি হাতে কালো রুমাল বেঁধে বাদশাহের সম্মুখে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়াতো। বাদশাহ জানতে পারতেন যে তাঁর প্রভুর মৃত্যু হয়েছে। আবুল ফজলের প্রতিনিধি হাতে কালো রুমাল বেঁধে ভয়ে ভয়ে ধীর পদক্ষেপে মাথা নিচু করে সিংহাসনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সম্রাট আকবর দারুণ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খয়ের বাশদ্’ (কুশল তো)? প্রতিনিধি আসল কথা জানাতেই বাদশাহের এমন অবস্থা হলো যে পুত্রের মৃত্যুতেও পিতার এমন দশা হয় না। কয়েকদিন তিনি দরবারে এলন না। কোনো আমিরের সঙ্গেও কথা বললেন না। অনুশোচনা করতেন আর কাঁদতেন। হাত দিয়ে বার বার বুক চাপড়াতেন আর বলতেন– ‘হায় হায়, শেখুজি, বাদশাহি নেবার ইচ্ছা ছিল তো আমাকে মারতে হতো, শেখকে মেরে কি হলো” সম্রাট আকবর শাহজাদা সলিমকে শেখুজি বলে ডাকতেন।

 

৬.

শেখ আবুল ফজলের ধর্ম ছিল মানবধর্ম। মানবতাকে তিনি বিভিন্ন ধর্ম অনুসারে বণ্টন করতে রাজি ছিলেন না। হিন্দু, মুসলমান, পারসি, খ্রিস্টান সকলেই তাঁর কাছে সমান ছিল। সম্রাট আকবরেরও ছিল একই ধর্মমত। যখন লোকে খ্রিস্টানদের বাইবেলের প্রশংসা করল, তখন তিনি শাহজাদা মুরাদকে বাইবেল পড়ার জন্যে বসিয়ে দিলেন এবং শেখ আবুল ফজলকে অনুবাদ করতে লাগিয়ে দিলেন। গুরজাত থেকে অগ্নিপূজক পারসিরা আকবরের দরবারে এসেছিলেন। তাঁরা জরাতুস্টের ধর্মের কথা কলতে বলতে অগ্নিপূজার মাহাত্ম্য কীর্তন করেন। তারপর আর কি, শেখ আবুল ফজলকে হুকুম দিলেন, ‘ইরানে যেরকম অগ্নিমন্দির চিরকাল প্রজ্বলিত রয়েছে, এখানেও তাই করো। দিনরাত অগ্নি প্রজ্বলিত রাখে।’ অগ্নি পরমেশ্বরের আলোরই এক বিচ্ছুরিত কিরণ। হিন্দুদের মধ্যেও অগ্নিপূজা প্রচলিত হছে। হয়তো সেজন্যেই তিনি তার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। যখন শেখ মুবারকের মৃত্যু হয় তখন শেখ আবুল ফজল তাঁর ভাইদের সঙ্গে মাথা মুণ্ডন করেছিলেন। সম্রাট আকবর নিজেও তাঁর মা মরিয়াম মাকানি ওরফে হামিদা বানুর মৃত্যুতে মাথা মুণ্ডন করেছিলেন। লোকজনকে বুঝিয়েছিলেন, এই প্রথা কেবল হিন্দুদের মধ্যেই নয়, তুর্কি সুলতানাতেও রয়েছে। এইসব কারণেই গোঁড়া মুসলমানরা শেখ আবুল ফজলকে বিধর্মী বলত। অথচ, না তিনি বিধর্মী ছিলেন, না ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন। রাত্রিবেলা তিনি সন্ত-ফকিরদের সেবা করতে যেতেন। তাদের চরণে স্বর্ণমুদ্রা প্রণামী দিতেন। তিনি কেবল এইটুকুই কামনা করেছিলেন যে সমস্ত মানুষ নিজেদের ভেদাভেদ ত্যাগ করে নিজের নিজের নিয়মে ঈশ্বরের আরাধনা করুক।

 

বাস্তবে আবুল ফজল, ঐতিহাসিক সমীক্ষার লক্ষ্যে সংখ্যাতাত্ত্বিক উপাত্ত সংগ্রহ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত হবেন। ১৭৭৬ সালে, ফরাসি বিপ্লবের ১৩ বছর আগে ফরাসিদেশ কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে চলছিল, লা পার টাইফেনটাল প্রকাশিত তাঁর ‘ডেসক্রিপশন জিওগ্রাফি ডি লা হিন্দুস্তান’ পুস্তকে ‘আইন-ই-আকবরি’-তে প্রদত্ত ভূ-সম্পত্তির সামগ্রিক আয় উদ্ধৃতি দিয়েছেন। খুব সম্ভবত আবুল ফজল ছিলেন প্রথম ইন্দো-পারস্য ইতিহাসবিদ যিনি ইউরোপীয় বিদ্বানদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছিলেন। যাহোক, তাঁর রচনাবলির একটা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন এখনও অভিকাক্সিক্ষত রয়েছে। তাঁর রচনাবলি সতর্কভাবে পঠিত হয়েছে, তবে সূ²ভাবে পরীক্ষা করা হয় নাই; তাঁর মতামত হয় অন্ধভাবে গৃহীত হয়েছে নতুবা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, লেখকের সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক মনমর্জি অনুসন্ধানের কোনো ধরনের প্রয়াস ব্যতিরেকেই; মানুষ, আন্দোলন এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ক তাঁর মূল্যায়নকে উচ্চমূল্য দেয়া হয়েছে এবং যথার্থভাবেই : তবে আবুল ফজলের চিন্তাধারার মৌলিক রীতি অনুসন্ধানে কোনো প্রয়াস নেয়া হয় নাই যা চূড়ান্তভাবে তাঁর ইতিহাস বিচারবিবেচনা নির্ধারণ করে। আবুল ফজলকে হয় প্রশংসা করা হয়েছে অথবা নিন্দা করা হয়েছে, তাঁকে অনুধাবন করা হয় নাই।

 

বরাত

১. সাদাত উল্লাহ খান সম্পাদিত প্রতিবুদ্ধিজীবী-২২, বাঙালি মুসলমান,  বৈশাখ/আষাঢ় ১৪২১/এপ্রিল/জুন ২০১৪, ঢাকা।

২. সাদাত উল্লাহ খান সম্পাদিত প্রতিবুদ্ধিজীবী-২৩, শেখ আবুল ফজল আল্লামি : প্রাচ্য সমাজজ্ঞিান-১, শ্রাবণ/কার্তিক/জুলাই/অক্টোবর ২০১৪, ঢাকা।

৩. ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ও মো. আবদুস সলাম, বাঙালি ও ইরানি : বঙ্গবন্ধু ও খোমেনি, আবিষ্কার, ঢাকা, ২০১৫। 

৪. ইরফান হাবিব সম্পাদিত মধ্যকালীন ভারত, চতুর্থ খণ্ড: কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, ২০১৫।

৫. রাহুল সাংকৃত্যায়ন, আকবর, অনুবাদ : আশরাফ চৌধুরী, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, ২০১০।

৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী, নবম খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ২০০৮।

৭. Khaliq Ahmad Nizami, On History and Historians of Medieval India, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 1982.

 

 

লেখক: সাদাত উল্লাহ খান, সম্পাদক প্রতিবুদ্ধিজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, গল্পকার, অনুবাদক ও সমালোচক।  

Link copied!