এক. ‘ ...স্কুলের যত ছাত্র তাহাদের মধ্যে এমন কেহই ছিল না...’
সুকুমার রায়ের দাশু বা দাশরথির জগৎটা বিশেষ বড়ো কোনো ভূভাগ নয়। আমরা তাকে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ এক গণ্ডীতেই বরাবর অবস্থান করতে দেখি। সেখানেই সে তার তাবৎ দৌরাত্ম্য সম্পন্ন করে। ।
দাশুর পূর্বসূরীদের প্রায় প্রত্যেকেরই আছে বিশাল পৃথিবী। দুরন্তপনাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য আছে বিপুল এক চরাচর। মানব-কিশোর কৃষ্ণ শুধু নিজগ্রাম বৃন্দাবনকেই নিজের জন্য পায় না; সাথে পায় কালিন্দী নদীর দুই তীর,পায় প্রবলা স্রোতবতী কালিন্দীর অগাধ জলরাশি,পায় বিস্তৃত গোচারণভূমি, ফসলের মাঠ অবাধ আকাশ আর তমাল-কদম্ব বৃক্ষরাশি, আর পায় দুরন্ত কালীনাগের উৎপাত।
অন্যদিকে, রাখাল শুধু ভ্রাতা-ভগ্নী ও মাতাপিতাকে যাতনা দেওয়ার জন্য নিজ বাড়িটিকেই পায় না, আরো বহু কিছু পায়। পাঠশালার পথে যেতে যেতে সেও নিত্য পায় বিশাল সব আম্রবাগান, বিবাদ-কলহ করার সঙ্গীসাথী ও মেঠো পথ। নিত্যই পায় পুস্তক খোয়ানোর বিবিধ বিচিত্র প্ররোচনা ও পরিস্থিতি। মোহনলাল বা ফটিককেও আমরা বরাবরই, মস্ত এক ভূখণ্ড জুড়েই বিরাজ করতে ও উৎপাত ঘটাতে দেখি। সেই ভূভাগেও আকাশ অপার। ঘন মেঘমোড়ানো সেই আকাশ। ফসল-উথলানো ক্ষেতের ধার ঘেঁসে ঘেঁসে নদী বয়ে যায় সেইখানে। সেইখানে নদীজলে ঢেউ বরাবরই তীব্র। একইরকম তীব্র-দুরন্ত তাদের বিধি-বাঁধা না-মানার বাঞ্ছা।
কিন্তু দাশরথির দুনিয়া অতোটা বিপুলা নয়। তার নিত্য পারিবারিক জীবনের কোনো পরিচয় আমরা তার গল্পগুলোর কোনোখানে পাই না। দাশুর খ্যাপামির যাতনা সইতে সইতে তার আত্মীয়জনেরা তাকে নিয়ে কতোটা তিতিবিরক্ত হয়ে আছে, সুকুমার রায় সেই বিবরণ রচনায় একেবারেই আগ্রহী হন না। তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে এক কিশোর-দুনিয়ার একটি বিশেষ কিশোরের অঢেল প্রাণচাঞ্চল্যের পরিচয় তুলে ধরা। ওই কিশোর-ভূভাগে নানাজাতের কিশোর আছে। কেউ কেউ বয়স্কদের মতোই হিংসাবাজ। কেউ কেউ নিপাট নিরীহ। কেউ কেউ কুঁচুটে কেউ কেউ নরম ও সহনশীল কেউ কেউ দাঙ্গাপ্রবণ ও দুষ্টতাগ্রস্ত। দাশু ওই তাদের বয়সীই বটে; তাদের সঙ্গেই তার চলাচলতি; কিন্তু সে অন্য কারো মতো নয়। সে একা এবং সে সকলের চেয়ে ভিন্ন। এই দাশরথি হাওয়ার মতন চলিষ্ণু; বরাবর অকুঁচুটে ও অকপট।
আমরা দেখি, কোনো এক তল্লাটে একটি স্কুল আছে। এক দাশরথি সেই স্কুলে নিত্য যায়। সে তার নিজের ক্লাশে, অন্য সকল সহপাঠীর সাথে পুরোটা দিনই কাটায়। সেইখানে,অন্যদের দিয়ে দাশু যেমন অকারণেই নানাভাবে উত্যক্ত হতে থাকে, তেমনি সেও সমবয়সী অন্যদের অন্যায্যপনার বিরুদ্ধে যুঝতে থাকে; একা এবং একা। আর, তার ওই ক্রিয়াবলী সামাজিকগণের চক্ষে গণ্য হতে থাকে নিন্দনীয় উৎপাত বলে। দাশু কাউকে অকাজে ত্যক্ত করে না; যদিও বিবিধ দুর্বুদ্ধি তার ভেতরে প্রবলরকমেই,হরদমই, আনাগোণা চালাতে থাকে। তাই নানামতে ওই সবকিছুকে নিংড়ে ফেলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করার কাজে দাশুকে সকলসময়ই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তবে যা-ই সে করে,করে নিজ শ্রেণীকক্ষের সীমানার ভেতরে থেকেই। কদাচিৎ হয়তো যায় আরেকটু দূরে। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথের পাশের কোনো আমবাগানের পাশে অথবা নিরালা পথের কোনোদিকে। ওই তল্লাটটুকুর বাইরে তার আর কিছু নেই। কোথাও যাবারও যেনো নেই।
দাশুর গল্পগুলোও তার জীবনের ধারাবাহিক গল্প নয়। এইখানে আমরা চারটি পৃথক গল্প পাই, যেগুলোতে দাশুর উপস্থিত সময়ের বিবিধ খ্যাপামির পরিচয় বিধৃত হয়েছে। ‘ পাগলা দাশু’, ‘ চীনেপটকা’,‘ দাশুর কীর্তি’, আর ‘দাশুর খ্যাপামি’ - এই গল্পগুলো আমাদের সামনে এমন এক কিশোর-নায়ককে হাজির করে, যে দিবালোকের মতো সরল ও ঘোরপ্যাঁচমুক্ত। তার চলন-বলনে সে তার সমবয়সী অন্যদের থেকে অনেক ভিন্ন; অনেকটাই অদ্ভুত, ‘ সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে,তখন তাহার হাত পা ছোঁড়ার ভঙ্গী দেখিয়া’ লোকের হঠাৎ কেনো জানি ‘ চিংড়ি মাছের কথা মনে’ পড়ে যায়।
দেখতেও দাশরথি বড়ো একটা সুদর্শন নয়; ‘তাহার চোখ দুটি গোল গোল,কান দুটি অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় এক বস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়- ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী/ যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারি।’ আর তার ; ‘মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চালচলনে বোঝা যাইত যে, তাহার মাথায় একটু ছিট আছে।’
সহপাঠীরা তার সামনেই ‘তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অপ্রীতিকর’ নানা কথা বলে চলে, কিন্তু ওইসব তেতোকথা দিয়ে দাশরথি বিচলিত হয় না। ওগুলোকে সে মোটেও গোণায় ধরার বিষয় বলেই গ্রাহ্য করে না। না সে ওইসব কথা শুনে বিরক্ত হয়,না নিজের বিদঘুটে চেহারা নিয়ে তার মনখারাপ হয়! বরং ‘এক এক সময়ে সে নিজেই’ নিন্দুকদের ওইসব কথাকে লুফে নিয়ে আজগুবী সব গল্প বানানো শুরু করে। এবং ওইসব অভিনব গল্প দিয়ে সে অন্যদের বাক্যহারা হয়ে যেতে বাধ্য করে।
সহপাঠীরা দাশুর এই প্রবণতাটির এমন পরিচয় দেয়:
“ একদিন সে বলিল, ‘ভাই,আমাদের পাড়ায় যখন কেউ আমসত্ত¡ বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস?’
আমরা বলিলাম, ‘খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি?’
সে বলিল: ‘ তা নয়। যখন আমসত্ত্ব শুকোতে দেয়,আমি সেইখানে ছাদের উপর বার দুয়েক চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই, ত্রিসীমানার যত কাক সব ত্রাহি ত্রাহি করে ছুটে পালায়। কাজেই আমাকে আর আমসত্ত¡ পাহারা দিতে হয় না’।”
দেখতে সে এইরকম; ওদিকে গণিতে তার মাথা ভারী পরিষ্কার; ‘ অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা লম্বা গুণভাগের বেলায় তাহার আশ্চর্য মাথা খুলিত।’ আর, ‘এক এক সময় সে’ অন্যদের ‘ বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য’ চূড়ান্ত উতলা হয়ে ওঠে। এইই তার একমাত্র আনন্দ বা ব্রত। কীভাবে ‘পড়াশুনায় ভালো’ কিন্তু ‘ হিংসুটে ভিজেবেড়াল’দের নির্বুদ্ধিতা ও দম্ভকে থেতলে দেওয়া যায়, ওটাই থাকে তার বরাবরের লক্ষ্য। দাম্ভিক মিচকেদের ‘ বোকা’ বানিয়ে ফেলার জন্য সে ‘ এমন সকল ফন্দি বাহির’ করে যে,’ সকলে ‘তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক’ হয়ে যেতে থাকে।
তার সাহস সকলকে হতভম্ব আর বাক্যহারা করে দেয়। দুষ্টজনকে শিক্ষা দিতে পিছপা হয় না দাশরথি। তা ওই দুষ্টজন তার চেয়ে বয়সে ও শক্তিতে যতো বড়োই হোক, তার বিরুদ্ধে রুখে দাশরথি দাঁড়ায়ই। কারো ভরসায় না থেকে,বা অন্য সাধারণদের মতো ভয়ে সিঁটিয়ে না গিয়ে, সে ওই উৎপাতকারীর মুখোমুখি হয়। একাই। ম্যাট্রিক ক্লাশের ছাত্র মোহনচাঁদ এসে ফোর্থ ক্লাশের সবাইকে অন্যায়ভাবে পীড়ন শুরু করে। ভীত ছোটোরা নিরুপায় মুখে মোহনচাঁদের অত্যাচার সহ্য করতে থাকে, কিন্তু ওই নিপীড়ন নিবৃত্ত করার কোনো উপায় খুঁজে পায় না তারা।
তখন দাশু একাই এগোয় ওই গোঁয়ারটিকে শায়েস্তা করার জন্য। নিজে পারবে কী পারবে না, সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না সে। শুধু সে বোধ করে যে,উদ্ধত গোঁয়ারের বিরুদ্ধে রুখে না-দাঁড়ালে কি নিস্তার পাওয়া যায়! দাশু তাই মোকাবেলা করতে ছোটে। সেই দুরন্ত রণের প্রত্যক্ষদর্শী হয় দাশরথির ত্রস্ত সহপাঠীগণ। তারা আমাদের জানায়: ‘জানোই তো দাশুর মেজাজ কেমন পাগলাটে গোছের, সে একটুখানি কানে হাত বুলিয়ে তারপর মোহনচাঁদকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে বসল। কিল, ঘুঁষি, চড়, আঁচড়, কামড় সে এম্নি চটপট চালিয়ে গেল যে আমরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। মোহন বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি যে, ফোর্থ ক্লাশের একটা রোগা ছেলে তাকে অমনভাবে তেড়ে আসতে সাহস পাবে—তাই সে একেবারে থতমত খেয়ে কেমন যেন লড়তেই পারল না। দাশু তাকে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে মাটিতে চিৎ করে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এর চাইতেও ঢের আস্তে মেরেছিল।” মাট্রিক ক্লাশের কয়েকটি ছেলে সেখানে দাঁড়িয়েছিল,তারা যদি মোহনকে সামলে না ফেলত,তাহলে সেদিন তার হাত থেকে দাশুকে বাঁচানোই মুশকিল হত।’
এমন স্পর্ধা ও সাহসকে নিয়ে, খ্যাপামি ও দৌরাত্ম্য করার প্রাণশক্তিকে নিয়ে, নিত্যদিনের সংসার-সমাজ কখনোই স্বস্তি বোধ করে নি। বরং এই সমস্তকিছুকেই নিজের জন্য অসুবিধাজনক ও বিঘ্নকর বলেই মনে করেছে। এই সচলত্ব যে এই বদ্ধ-সংসারের বিধিবিধানগুলো চালু রাখার পথের এক দুস্তর বিঘ্ন। একে খুব বেশী বরদাস্ত করলে কী রক্ষা আছে!
তাই আমরা লক্ষ্য করি, ওই উচ্চণ্ড উৎপাত ঘনায়ে আনার শক্তিসম্পন্নদেরকে এই সমাজ নানা অপ-অভিধায় চিহ্নিত করতে থাকে। কখনো কখনো ওই অপঅভিধাগুলোকে থাকে নির্ভেজাল ক্রূরতা-ঝলকানো; কখনো কখনো সেগুলোকে একটু তিরষ্কারমেশানো উপেক্ষা ও অবহেলা দিয়েও মুড়ে দেয়া হয়ে থাকে এইখানে। যেমনটা ঘটেছে দাশরথির বেলায়। দস্যি সাহসী আর রুখে ওঠার তেজঅলা দাশু শেষ পর্যন্ত আর নিজের নামে বিরাজ করার ভাগ্য পায় না। তাকে সকলে পাগলা বলে ডাকা শুরু করে। একে বিশুদ্ধ স্নেহসম্ভাষণ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এমন সব অভিধা দিয়ে বোঝানো হতে থাকে যে, এই যে জন, সে অন্য ,সে উৎপাতসৃজনকারী। তার ব্যাপারে সাবধান। সে আর দশজনের মতো নিরুপদ্রব ও পোষমানা নয়। সে অসহজ আর অপোষমানা। তাই তাকে অমন নামে চিহ্নিত করে রাখা।
আমরা দেখতে পাই, আশপাশে উচ্চণ্ড উৎপাত নিয়ে আসতে থাকা দাশুও অচিরেই উধাও হয়ে যায়,তার বৃত্তান্ত আর এগোয় না। এই দাশরথির পরে, আমাদের সাহিত্যে আসে তারা দুইজন- শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথ।
শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথকে আমরা গণ্য করতে পারি ওই অগ্রবর্তীগণের অতি-বিকশিত দুই উত্তরসূরী রূপে। পূর্ববর্তীদের সর্ববিধ দামালপনা যেমন তাদের দুজনের মধ্য দিয়ে রূপ পরিগ্রহ করেছে; তেমনি এই দুজনের নিজেদেরও আছে কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, যা কিনা তাদের করে তুলেছে স্বতন্ত্র আর অভিনব । তাদের ভুবন শুধু গৃহ ও বিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে বিরাজমান এক ভূভাগ নয়। ওটি বিশাল এক ভুবন। অবাধ ও প্রাণময় সমস্তটা প্রকৃতি এবং থিতু সংসারের সবটুকু ওইখানে এঁটে যায়। অমাবস্যার গহন রাত আর ভরা বর্ষার নদীর তেজ- ওই ভুবনে স্বমহিমায় বিরাজমান। মৃত্যু, মমতা, মহামারী, বেদনা আর ওইসব কিছুকে পেরিয়ে যাওয়ার পণ- এইখানে একত্রে অবস্থান করে চলে। অবস্থান করে চলে শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথের সাথে, কদমে কদমে।
দুই. তাদের জন্য কতোসব স্তব!
তাদের আবির্ভাব কাল থেকেই, শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথের সকল বৈশিষ্ট্য দিয়ে, সকল পণ্ডিতজনই মোহিত হয়ে আছেন। তবে তাঁরা ইন্দ্রনাথকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন বেশী, শ্রীকান্ত পেয়েছে তার থেকে ঢের কম মনোযোগ-উচ্ছ্বাস। পণ্ডিতগণের কারো কারো কাছে ইন্দ্রনাথ গণ্য হয়েছে দুর্জ্ঞেয় আর অমীমাংসিত রহস্যেরই অন্য নাম বলে । কারো কারো কাছে ইন্দ্রনাথ হচ্ছে অতুল্য অসাধারণ এক সত্তা, বাস্তব দুনিয়ায় কখনো তার দেখা মেলে না। শিল্পের পৃথিবীতেই শুধু তার দেখা পাওয়া সম্ভব। তাকে পাওয়ার ভাগ্য বাস্তব সংসারের কদাপি হয় না বলেই মত দেন তাঁরা। কারো কারো কাছে ইন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র কোনো মনুষ্য-সন্তান নয়,সে আদতে মানব-কিশোর কৃষ্ণেরই অন্য আরেক রূপ মাত্র। এই জন্মে যে কিনা ইন্দ্রনাথ নামে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রসিদ্ধ শরৎচন্দ্র বিশেষজ্ঞ ড.সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেন, ‘ইন্দ্রনাথের সবকিছুই বিস্ময়কর।’ তিনি বলেন, ‘ ইন্দ্রনাথ রূপকথার রাজ্যে বাস করে না। তাহার কারবার কঠিন বাস্তবের সঙ্গে। অথচ ইন্দ্রনাথের কার্যকলাপের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের এমন একটা ছাপ আছে,যাহা অতিমানবের আচরণে পাওয়া যায়।’ সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন: ‘বাংলা সাহিত্যে ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত- অসাধারণ দুই চরিত্র।’ ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে: ‘বর্ণপরিচয়ের রাখাল হইতে আরম্ভ করিয়া অনেক দুষ্ট,লেখাপড়ায় অমনোযোগী বালকের কাহিনী সাহিত্যে বা ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সমস্ত বাংলা সাহিত্য ইতিহাস তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও ইন্দ্রনাথের জোড়া মিলে না।’ মোহিতলাল মজুমদার মনে করেন: ‘ যেন সকল জ্ঞান,সকল প্রেম ও সকল শক্তি একটি চিরকিশোর রূপে লীলা করিতে নামিয়াছে।’
পণ্ডিতজনেরা ওই দুই কিশোরের মহিমা কীর্তন করেন; আর তাঁদের ব্যাখ্যা-ভাষ্য আমাদের জানাতে থাকে যে, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত হচ্ছে তাঁদের স্রষ্টা শরৎচন্দ্রের গভীরতম কল্পনা-প্রতিভার ফসল। শরৎচন্দ্র এদের গড়েছেন ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’, গড়েছেন নিজ কল্পনা দিয়ে। ওরা দুইজন দুরন্ত মৌলিক সৃজন, এরা কোনো প্রভাবজাত সৃষ্টি নয়।
তবে দু’একজন বিদ্বৎজন, বিশেষ করে শরৎচন্দ্রের হিন্দীভাষী জীবনীকার বিষ্ণু প্রভাকর, একটু ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন। তাঁর অনুমান, ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি শরৎচন্দ্র আসলে গড়েছেন তাঁর বাল্যসখা রাজু-র আদলে। কিশোর বয়সে, ভাগলপুরে,মামাবাড়িতে থাকার কালে,ওই রাজু নামের কিশোরটির সঙ্গে শরৎচন্দ্রের প্রবল সখ্য গড়ে ওঠে বলে জানা যায়। বিষ্ণু প্রভাকর এমন তথ্য দেন: ‘ অদ্ভুত চরিত্রের এই রাজু-শক্তিমান। বংশীবাদনে দক্ষ,ভালো অভিনেতা, কিন্তু নানাজনে নানা কথা তার বিষয়ে বলে। প্রতিভাশালী বংশে তার জন্ম,.. .. .. এই প্রতিভাই আবার তাকে কোনো জায়গায় কোনো একটা বিষয়ে টিকে থাকতে দিতো না। বদমাশ সে ছিল না, ছিল শুধু দুঃসাহসী। যোগ ও আনন্দে সে পূর্ণ থাকতো- যেমন গঙ্গাজল সবকিছুকে করে তোলে পবিত্র। নিজের একটা নৌকা ছিল, সেটাতে করেই রাজু ঘুরে বেড়াত। কখনো অন্ধকার রাতে,ভরা গঙ্গায়। শরৎকে বলত,‘চল, নৌকো চড়ে বেড়িয়ে আসি।’ বিষ্ণু প্রভাকর মনে করেন, “শ্রীকান্ত” প্রথম পর্বে রাজুই দেখা দেয় ইন্দ্রনাথ নামে,আর শ্রীকান্ত তার স্রষ্টারই কিশোর মূর্তি।
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব) প্রকাশিত হবার পরে বহু বছর পেরিয়ে গেছে। পুরোনো বিজ্ঞ পণ্ডিত মহাজনদের পরে এসেছেন নতুন নানা সমালোচক। তাঁরা প্রত্যেকেই শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে উপরোল্লিখিত ওই ধারণা-ভাবনা দিয়েই চালিত হয়েছেন।
শরৎচন্দ্র এই দুই চরিত্রসৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো লেখককে দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন কিনা, হলে সেটা কোন লেখক এবং সেই প্রভাব কতোটা ব্যাপক ও গভীর- এই বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাতের বিশেষ প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেছেন বলে মনে হয় না। তবে আমরা এখানে নব আলোসম্পাত করে দেখতে পারি যে, এই চরিত্রদুটি কি কেবলই লেখকের স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি, না বিদেশী কোনো কথাকারের প্রবল সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েই এই চরিত্র দুটিকে গড়ে তুলেছেন শরৎচন্দ্র।
(চলবে)
 
                
              
 
																                   
                                                         
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    






































