আলোটা টুকরো টুকরো হয়ে দুলছে। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থাকলেই ঘোর লেগে যায়। দুহাত দিয়ে আঁজলা ভরতে গেলে ফসকে যায় টুকরোগুলো। তবু বেপরোয়া ভঙ্গিতে ওদের বাগে আনার চেষ্টা চলে। টলটলে পানিজুড়ে যে বনপাতাদের ছায়া, তার ভেতর থেকে টুকরো টুকরো আলোগুলো উড়ে এসে শরীর ছুঁয়ে যায়। তারা মুঠোয় ধরা পড়ে না, ফসকে গিয়ে উড়াল দেয়।
কোমরের নিচ থেকে ধূর্ত ভঙ্গিতে ইলিবিলি কাটে পানি। তাতে শিরশিরানি ভাবটা হামাগুড়ি দিয়ে বুক পর্যন্ত ওঠে। বল্গাহীন বাতাসটাও থেমে থেমে ছোবল মারে শরীরে। ওর মনে হয় আলো, বাতাস, পানি সবকিছু ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে। আবছায়ায় সুযোগ বুঝে পুরো বিশ্বসংসারটা ওকে খুবলে খুবলে খাবে বলে এগিয়ে আসছে। অসহ্য যাতনায় ক্ষিপ্র বেড়ালির ভঙ্গিতে সে এবার নিজেই নিজের গায়ে এলোপাতাড়ি আঁচড় বসাতে শুরু করে। গলা দিয়ে ঘরঘর শব্দ বেরোয় তার।
ওপারে মোন্তাজ মিয়াদের উঠানে লাইট জ্বলে ওঠে। হলুদ রঙের অশ্লীল আলোটা ছড়িয়ে পড়তেই লুঙ্গি পরা লোকটার অবয়ব স্পষ্ট হয়। কোনোক্রমে আলুথালু কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে সে এবার পানি থেকে উঠে আসে। বাতাসের ছোবল থামে না। নিঃশব্দে পা ফেলে হেঁটে যায় আলেকজান। বাড়িভর্তি মানুষ ঘুমে অচেতন। কেউ জেগে উঠলে রাতদুপুরে এমন উদ্ভট কাজের কোনো ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। মাঝে মাঝে এমন হয় ওর, সেসব কথা দিনের আলোয় ভাবতে গেলে নিজের চোখেই নিজেকে নরকের কীট মনে হয়।
দূর থেকে গান ভেসে আসে। সশব্দে কফ ফেলছে লোকটা। আলেকজানের গা ঘিনঘিন করে। ঘরের দরজায় খিল দিয়ে ভেজা কাপড়েই মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে সে। এ ঘরের চওড়া মেঝেতে পাটি পেতে সে আর আদরজান ঘুমিয়েছে দুদিন আগে। মেয়েরা শুয়েছিল চৌকিতে। ঘুমায়নি কেউ। সারা রাত গুটুর গুটুর গল্প। বিয়েবাড়ির গল্প ভোর হয়ে গেলেও ফুরায় না। আলেকজান ওদের আরও এক দিন থাকার জন্য জোরাজুরি করলেও গতকাল বাড়ি ফিরে গেছে ওরা।
বাড়ির মেয়েরা স্বামী-সন্তানসহ সদলবলে এসেছে। এরা কবে ফিরবে, জানার উপায় নেই। সূর্য ওঠার আগে দিন শুরু হলেও মেহমানদারি করতে করতে চোখের পলকে বেলা শেষ হয়ে যায়। আলেকজান দুদণ্ড বসার সুযোগ পায় না। বাড়ির মেয়েরা ফোড়ন কাটে। পোলার বউ আনছো কী করতে? মাথায় তুলবার লাগি?
আলেকজান হ্যাঁ না কিছুই বলে না। দরজার পাশ থেকে ইতস্তত ছায়াটা সরে গেলে, চুরির টুংটাং শুনতে পেলে চোখের ইশারায় থামতে বলে ওদের। তবু নির্দয় সমালোচকদের কথার ফলা থামে না।
ছেলেকে আড়ে আড়ে দেখে আলেকজান। এক দিনেই কেমন গেরস্তবাড়ির কর্তা হয়ে গেছে সেদিনের ছেলে টুনু। টুনুর বাবাও এমন অল্প বয়সে বিয়ে করে এনেছিল আলেকজানকে।
ছেলের বউকে আরও বেশি করে দেখে সে। নিজেই পছন্দ করে বাপের বাড়ির গ্রাম থেকে মেয়ে এনেছে। সেই মেয়ে এত বড় ঘোমটা পরে ঘরময় হেঁটে বেড়ায়। ঘোমটা খসলে দেখা যায় মাথার চেয়ে ওর খোঁপাটা বড়।
টুনু আছে বাড়িতে। বেলা অব্দি ঘুমাবে আজ। কাল অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে। দুদিন ছুটি কাটিয়ে আবার সদরে ফিরতে হবে। বিয়ের পর গেল সপ্তায় প্রথম কাজে গিয়েছিল সে। ছেলে যে কদিন ঘরে থাকে রোজ পাড়া বেড়াতে যায় আলেকজান। সারা সকাল ঝিলিকমারা রোদ মাথায় নিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেশ খানিকটা দেরি করে তারপর ফেরে।
আজকেও তাই করেছে। ফিরে এসে রান্নাঘরের দাওয়ায় আঁচল ছড়িয়ে বসে পড়েছে আলেকজান। জ্যৈষ্ঠ মাসের ছাতি শুকানো তাপে ঝাঁঝাঁ করছে চারদিক। চামড়ায় গরমের ছ্যাঁক লাগছে।
আলেকজান দুজনকে একা রেখে গিয়েছিল৷ কিন্তু এই পুষ্প মেয়েটার বুদ্ধিশুদ্ধি কম। ঘরের কাজে মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগী। আলেকজান ফিরেই রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছে স্বামীর সঙ্গে খুনিসুটিতে না মেতে কোমরে আঁচল গুঁজে রাজ্যের রান্না করতে লেগেছে মেয়েটা।
খেতে বসে আলেকজান গরম আর ঝোলেঝাঁঝে হাঁসফাঁস শুরু করে। বিয়েতে পাওয়া নতুন প্যাডেল স্ট্যান্ড ফ্যানটা সামনে এনে ফুল স্পিডে চালু করে দেয় টুনু। হাওয়ার তোড়ে ধীরে ধীরে বিনবিনে ঘাম শুকিয়ে শরীর হালকা হয়ে আসে। এর মাঝেই টুকটাক সাংসারিক আলাপ চলে। জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। তেলের দামের সাথে সাথে বাস ভাড়াও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এমন চলতে থাকলে প্রতি সপ্তায় বাড়ি আসা কঠিন।
মেস ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে সদরে ঘর দেখতে বলে আলেকজান। বউকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে সপ্তায় সপ্তায় আর আপডাউন করতে হয় না ওর। এমন প্রস্তাব শুনে টুনু ঝট করে মুখ তুলে তাকায়। মায়ের ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করে। লাল টুকটুকে ঝোল মেখে দু-লোকমা ভাত মুখে দেয়। মনে মনে কথা সাজায়। তারপর সলাজ হেসে প্রশ্ন করে—অয় কি তোমারে অহনই জ্বালান শুরু করছে?
এবার আলেকজানের হাসবার পালা। এমন নির্বিবাদী মৃদুভাষী মেয়ে নিয়েও মাঝেমধ্যে তার জ্বালা হয় বৈকি। কথা আর হাসির তোড়ে আলেকজান বিষম খায়। পানিভর্তি গ্লাস এগিয়ে দেয় পুষ্প। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে ওর, গালে চিবুকে স্বেদবিন্দুর সাথে অভিমানও জমছে।
মুখে কিছু না বললেও আলেকজান জানে সে নিজেই ক্রমশ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। সারা জীবন এই তো দেখেছে। মন থেকে মেনে নিতে না পারার যাতনা কীভাবে অবচেতনে মানুষকে পুড়িয়ে মারে, তা সে জানে। তাই এই বন্দোবস্ত বহু আগে থেকেই ভেবে রাখা।
আজকাল সংসারের দেখাশোনায় সে খুব একটা থাকছে না তাই। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলেই আঁচলের গেরোতে বেঁধে রাখা ছোট্ট কৌটা থেকে ঝিরিঝিরি তামাকপাতা দাঁতের গোড়ায় নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে চলে যায়। গাছগাছালির ঠান্ডা ছায়ায় বসে শরীর জুড়িয়ে আসে ওর। শিমুলগাছের গোড়াটা কদিন আগে শান বাঁধিয়ে দিয়েছে টুনু। দুপুরবেলা আজকাল এখানে আঁচল পেতে শুয়ে থাকে আলেকজান।
পাশের বাড়ির রুকসানার মা গলা বাড়িয়ে আলাপ জুড়তে চায়। অহনই ঘর থুন বাইর কইরা দিছে নি তোমারে? আলেকজান চোখ বুজে থাকে। ঘুম না এলেও ভান করে। কুঁচুটেপনায় কোনোকালে আগ্রহ ছিল না ওর। তেতে থাকা রোদটা ততক্ষণে থিতিয়ে আসে। তার ফিতে তিরতির করে কাঁপে ডুরে শাড়ির পাড়ে, পায়ের পাতায়, কনুইয়ের ভাঁজে।
সুযোগ পেয়ে টুকরো টুকরো আলোগুলো আবার উড়তে শুরু করে। নরম নরম স্বরে ওরা আলেককে ডাক দেয়। একবার, দুইবার, অসংখ্যবার। সারা গায়ে কাঁটা দেয় আলেকজানের। দুহাতে চোখ ঢাকে সে। নিজের অজান্তেই চাপাগলায় সাড়া দেয়—উ!
‘আর কত দিন সবুর করতে কও? বিরান দিন শ্যাষ হয় না, নিশুত রাইতে আর তো ঘুমাইতে পারি না।’
জবাব আসে। এবার দুহাতে কান চেপে রাখে আলেক। আর শুনতে চায় না এসব নিষিদ্ধ কথা।
‘তুমি কি আমারে মারবার চাও, আলেক? কথা কও একবার।’
বাঁকা ছুড়ির মতো শরীরটা মুচড়ে ওঠে এবার। ‘আমি নিজেই মরবার চাই। তুমি আমারে মুক্তি দেও না ক্যান?’ সাপের মতো হিশহিশ শব্দে আলেকজান কথা বলে।
‘আর যদি মরণের কথা কও! মরুক তোমার শত্তুর।’
গমগমে গলার স্বরটি এত বেশি স্পষ্ট, যেন ঠিক পাশে বসে কথা বলছে লোকটা। দমবন্ধ করা অনুভূতি নিয়ে আলেকজান ন্যাতানো ফুলের মতো নিশ্চল পড়ে থাকে।
‘মরুক তোমার শত্তুর’’এই এক আন্তরিক আশিস বাণীই হয়তো মুমূর্ষু দাম্পত্যের প্রথম দিন থেকে তাকে আজ অব্দি বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রেমহীন সংসারের গরল পান করেও সে বয়ে চলেছে মধ্য চল্লিশের এ চিতিপড়া জীবন।
ভেতরে ভেতরে সতৃষ্ণ সে আরও এবার কান পাতে। খুব কাছে কোথাও কুলকুল শব্দ শোনা যায়। হয়তো এপারে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আরাম আরাম শব্দে আলেকজানের শরীর শিথিল হয়ে আসে। ঘোরলাগা দিনের আলোটা ঝুপ করে নিভে যায়। সঁপসঁপে অন্ধকারে সাঁতার কেটে কেটে সেদিনের মতো ছোট্ট টাবুরে নৌকাটি তীরে এসে থামে। সেই সঙ্গে সময়টাও ওখানে থেমে যায়৷ কেউ আসে না আলেকের কাছে। তবু মেঘ শিমুলের গাঢ় ছায়ায় অপেক্ষারত ষোড়শী মেয়েটি নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন কারও সঙ্গে জীবন চালিত হয়ে গেলেও সেই অপেক্ষা ওর এখনো ফুরাতে চায় না।
ঠিক কতক্ষণ পর চাপকলের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে দৃশ্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে, তা ঠিক জানে না আলেক। শুধু নিমীলিত চোখ দুটো খুলতেই দেখে অবেলায় গা ধুতে বসেছে মেয়েটা। ওর মুখটা অন্যদিকে ফেরানো। সাবানের ফেনায় একঢাল চুল আর শরীর মাখামাখি। এ বাড়িতে এসেছে অব্দি পুষ্পকে একবারও পুকুরে নামতে দেখা যায়নি। প্রতিদিন সে কলপাড়ে পিঁড়ি পেতে বসে গোসল সারে। শুচিবাই আছে কি ওর? আলেকের মনে পড়ে সেই সাতসকালেও একবার ওকে গা ধুতে দেখেছে।
দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে দেখতে দেখতে মেঘশিমুলের ছায়াটা দীর্ঘতর হয়। লালচে হয়ে ওঠে তার রং। টুনু সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরে। তবে আগের মতো ঘন ঘন নয়। দুই-তিন সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, তবু ওর বাড়ি ফেরার নাম নেই। পুষ্প নির্বিকারভাবে ঘুরে বেড়ায়। শেষমেশ আলেকজান ধৈর্যহারা হয়ে ছেলের খবরাখবর নেয়। ছেলে ব্যস্ত গলায় বলে—বড় কাজের চাপ গো আম্মা।
শহরে ওর ঘর নেয়া হয়নি এখনো। আলেকের মাঝে মাঝে মনে হয় এই একদিক দিয়ে ভালো। পুষ্প চলে গেলে ঘরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যেত। হঠাৎ হঠাৎ ওর ওপর যে পাগলামি ভর করে, বয়সের সাথে যা বিশ্রীরকমের বেমানান, ঘরে আর অন্য একটি প্রাণী না থাকলে আলেকের পক্ষে নিজেকে এসব সময়ে সামলে রাখা মুশকিল হতো।
কিন্তু পুষ্প মেয়েটা ভীষণ গম্ভীর প্রকৃতির। দশ কথা বললে এককথায় উত্তর দেয়। এমন লোকের সঙ্গে সারা দিন আর কত বকবক করা যায়! মাঝে মাঝে ওকে এত বেশি নিস্তব্ধ দেখায়, মনে হয় মানুষটা চলছে ফিরছে ঠিকই কিন্তু ও আসলে ঠিক এখানে নেই। ওর চেতনাজুড়ে অন্য কিছু বা অন্য কেউ।
শুরুর দিকে নববিবাহিতার এমন উদাস ভঙ্গি খুবই যৌক্তিক বলে মনে হতো। আলেকজান বিবেকহীন মানুষ নয়। ছেলেকে সে শুধু পারিবারিক শান্তি বজায়ের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আলাদা ঘর দেখতে বলেনি। স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকা জরুরি বলেই প্রস্তাবটি দিয়েছিল। কিন্তু এই মেয়েটি বোধ হয় সে সবের ধার ধারে না।
টুনু এবার মাস পার করে এসেছে। সে-ও দুদিনের জন্য। আলেকজানের হাতে এখন অনেক কাজ। অন্য সময়ও গেরস্তবাড়ির কাজের শেষ থাকে না। কুটোবাছা, রান্না, ধোয়ামোছা, পোষা প্রাণীদের দেখভালসহ আরও কত কী। আশ্বিন মাসের দুপুর আলটপকায় ফুরিয়ে যায়। তারপর ঝেঁপে সন্ধ্যা নামে। বিকেল বলতে কিছু নেই। ভাতঘুম শেষে বিছানা ছাড়তে আলেকজানের বেশ কসরত করতে হয় আজকাল। প্রতিবছর এ সময় হাঁটুর ব্যথাটা নিয়ম করে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিয়ে যায়।
উঠানের রোদে ঝুলতে থাকা কড়কড়ে কাপড়গুলো হিম হাওয়ায় নেতিয়ে থাকে। আলেক ধীর পায়ে সব কটি কুড়িয়ে এনে স্তূপ করে বিছানায় রাখে। এ সময় সারা ঘর খুঁজেও পুষ্পকে পাওয়া যায় না। আলেকজান কদিন ধরে লক্ষ করছে এমনটা প্রায় রোজ হচ্ছে।
এদিক-ওদিক ঘুরে আবার উঠানের শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। এদিকটায় প্রগাঢ় শীত। ঝোপড়ানো লতাপাতার ছায়ায় হিমবুড়ি সারা দিন ঘাপটি মেরে থাকে। আলেকজান মাথা তুলে শিমুলগাছটাকে দেখে। ন্যাড়া হয়ে পাতাহীন গাছটার একেবারে হতশ্রী দশা। আবার কবে ওর ফুল হবে, পাতাদের দল ঝামড়ে উঠবে? লালিমায় উপচে পড়বে বাঁধানো শান। সেসব দিনের অপেক্ষায় আছে সে।
অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে দুপা এগিয়ে গাছের নিচে বসতে গিয়েও আলেক চমকে সরে আসে। কয়েক সেকেন্ড হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নিঃসাড়ে ফিরে যায়। তাকে খুব পুরোনো এক দৃশ্যের প্রতিলিপি আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
অনেক রাত অব্দি আলেকজানের চোখে ঘুম আসে না। ঘুম নিয়ে তার অবশ্য মাথাব্যথাও নেই। মধ্য চল্লিশের জীবনে এসব বিভ্রাট থাকাটাই দস্তুর। নির্ঘুম চোখে শুয়ে শুয়ে সে বরং সংসারের অমীমাংসিত সব জট খোলার চেষ্টা করে। আঁধারে বসে হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে মেয়েটির কান্না, স্বামীর সঙ্গ পেলেও যার উদাসীন ভঙ্গির ব্যতিক্রম ঘটে না, প্রথম দিনের সেই ঢলোঢলো রক্তিম মুখটা এমন শুকিয়ে যাচ্ছে, মন কি তবে অন্যমুখী ছিল ওর, আলেকজান কি না জেনেই এমন একটা ভুল করে ফেলেছে! এসব সম্ভাবনার কথা সমস্ত রাত তাকে গিলে খেতে চায়।
তবু দিঘল রাত ফুরিয়ে আসে। শুধু কুহেলিকা ফোরাতে চায় না। আলেকজান অনেকটা সময় নিয়ে বিছানা ছাড়ে। গায়ে চাদর জড়িয়ে ধীর পায়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ফজরের ওয়াক্ত। বাতি জ্বালিয়ে টুনুর ঘরের দরজার দিকে লক্ষ করতেই ওর চোখ পড়ে যায় উঠানে।
আবছায়া আলো-আঁধারির মশারির মতো জাল পেতে আছে। সেদিকে চোখ রেখে অবাক হয় না আলেকজান। অবয়বগুলো তখনো স্পষ্ট নয় বলে সে স্থানুবৎ হয়ে অপেক্ষা করে, যতক্ষণ না অব্দি ছায়ামূর্তি দুটি পরস্পরের থেকে আলাদা হয়।
কয়েকটা মুহূর্ত হয়তো এভাবেই চলে যায়। আজানের ধ্বনি থেমে গেলে আলেকজান সংবিৎ ফিরে পায়। দ্রুত পায়ে উঠান পেরিয়ে সে ন্যাড়া গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারদিক এখন সুনসান। শুধু জলবিন্দুগুলো ঝরে পড়ছে পাতার বুক থেকে মাটির বুকে।
আরও দূরে চোখ রাখে আলেকজান। তার মাঝে এখন আশ্চর্য এক স্থিরতা। কোনোরকম প্রতিরোধের চেষ্টা সে করে না। মেঘ শিমুলকে পেছনে ফেলে পানির ধার ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে ছায়া দুটো। আলেকজানের মনে হয় এই সেই স্বপ্নদৃশ্য।