একাত্তরের সশস্ত্র গেরিলা জনযুদ্ধ আমাদের শিল্পের সকল মাধ্যমে বিরাজিত। কিন্তু ‘সকল’ আর ‘কেউ কেউ’ এর তফাৎ আছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখিত অবিনশ্বর সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’র অনন্যতা এখানেই। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা শহীদ রুমীর মা এই জাহানারা ইমাম। ১৯২৯ সালের আজকের দিন ৩ মে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এক রক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম পরিবারে তার আবির্ভাব। দেশভাগের পর তিনি সপরিবারে ঢাকায় আসেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ছয় মাস যুক্তরাষ্ট্রে পাঠ নেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও সন্তানহারা এই মায়ের লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রথম প্রকাশিত ১৯৮৬ সালে বিচিত্রায়। প্রয়াত জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এই বই সম্পর্কে লিখেছেন,
“সত্যিকার শিল্পীদের হৃদয় হয় পাথরের, নয়তো এত দুঃখকে তাঁরা কোথায় ধারণ করবেন? জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে লিখলেন তার ডায়েরি। কী অসম্ভব আন্তরিকতা সঙ্গেই না তার গল্প বলে গেছেন। সেই গল্প তার একার থাকেনি। কোনো এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে গেছে আমাদের সবার গল্প।”
শুধু বই লিখে নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করে। দেশে তীব্র গণবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। জাহানারা ইমাম এ বিক্ষোভকে সাংগঠনিক রূপ দেন। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় তার নেতৃত্বে। এ কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ গণ-আদালতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার আয়োজন করে।
ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হন। কিন্তু বাংলাদেশে তখনও তার ওপর জারি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে অনেক কথা হয় দেশে এখন। কিন্তু জাতির তাগিদে একাত্তর ফিরিয়ে আনার কৃতিত্বময়ী জাহানারা ইমান তাতে উপেক্ষিত। জনযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে খাওয়াই যেন গদি রক্ষার পথ। এমন সময়ে একজন জাহানারা ইমাম হতে পারেন পথের দিশা।