• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চলচ্চিত্রে ২৫ মার্চের প্রাথমিক চিত্রটা থাকলেও নির্মিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৪, ১২:৫২ পিএম
চলচ্চিত্রে ২৫ মার্চের প্রাথমিক চিত্রটা থাকলেও নির্মিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র
গেরিলা সিনেমার দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল কালরাত ২৫ মার্চ । ১৯৭১ সালের এদিন রাতে আচমকা বাঙালি জাতির ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা। রক্তে ভিজে গিয়েছিল বাংলার মাটি। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সেদিন হাজার হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। শোকাবহ সেই দিনটির চিত্র উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধনির্ভর বিভিন্ন চলচ্চিত্রে।

এখন পর্যন্ত যেসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্র কিংবা ওয়েব সিরিজ নির্মিত হয়েছে, সেগুলোতে একঝলকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেই কালরাতকে। যেখানে প্রথমেই দেখা যায়, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে ৭ মার্চের ভাষণ। মুক্তিকামী বাঙালির হাতে হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা। তারপর ঘনিয়ে আসা সেই লোমহর্ষক রাত। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা মেতে ওঠেছে হত্যাযজ্ঞে। দলে দলে রাজধানী ছাড়ছে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ। পাড়ি জমাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চলচ্চিত্রেই ২৫ মার্চের প্রাথমিক চিত্রটা মোটামুটি এমন। যে কারণে সমালোচকদের ভাষ্য, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেলুলয়েডে বিস্তারিত উঠে আসেনি সেদিনের ঘটনাবলী। নির্মিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। তবে কোনো কোনো চলচ্চিত্রে ২৫ মার্চের চিত্রটা তুলনামূলক সাবলীলভাবে উঠে এসেছে। এর মধ্যে নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’, মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ উল্লেখযোগ্য। এ তিন সিনেমায় রাজধানী ঢাকা, মফস্বল ও গ্রামে ২৫ মার্চের ঘটনাগুলো চিত্রায়িত করা হয়েছে।

২০১১ সালে মুক্তি পায় গেরিলা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এটি। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত প্রমুখ। সিনেমাটির গল্পে সাংবাদিক হাসান চরিত্রে আছেন ফেরদৌস আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী বিলকিসের ভূমিকায় জয়া আহসান। রাত ১১টার মধ্যে বাসায় ফেরার কথা থাকলেও সাংবাদিক হাসানের আর ফেরা হয় না। অপেক্ষার প্রহর গুণে তার স্ত্রী। পরদিনও সে স্বামীকে খুঁজে পায় না। এদিকে, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক-মর্টার নিয়ে টহল চলছে। জীবন বাঁচাতে ছুটছে অসহায় মানুষ এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে দেশীয় অস্ত্রে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টারত একদল বাঙালি পুলিশকে দেখানো হয়েছে। সেই ভয়াল রাতে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ি ও ভোরের দিকে অগণিত মানুষের লাশের দুর্বিষহ অতীত বড়পর্দায় তোলে এনেছেন নির্মাতা।

এদিকে, কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে মোরশেদুল ইসলামের আমার বন্ধু রাশেদ। এতে দেখানো হয়েছে দিনাজপুর শহরের গল্প। সিনেমাটিতে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবের দৃশ্য না দেখালেও আতঙ্কিত মানুষের চিত্র উঠে এসেছে। একটি মহল্লায় উৎকণ্ঠিত মানুষের জটলা, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন তারা। এরপরই ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’—স্লোগানে মিছিল শুরু। সিনেমাটির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ছেলেকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘ঢাকায় মিলিটারি আক্রমণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলেছে। বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, ছাত্রজনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।’


নির্মাতা তৌকীর আহমেদ পরিচালিত জয়যাত্রা ছবিতে ২৫ মার্চে ঢাকার ভয়াবহতা না দেখালেও গ্রামের আতঙ্কিত মানুষের ভাবনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নৌকা নিয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। মূলত কালরাতের বর্ণনা শুনে গ্রামের সাধারণ মানুষের মনের অবস্থার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ সিনেমায়। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, তারিক আনাম খান প্রমুখ।


মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘মেঘের পরে মেঘ’ ও ‘সংগ্রাম’। আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’। খান আতাউর রহমানের ‘এখনো অনেক রাত’ ও ‘আবার তোরা মানুষ হ’। শহীদুল হক খানের ‘কলমীলতা’। সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। হারুনর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’। জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘জীবন থেকে নেওয়া’। তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলী’, ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘রাবেয়া’, ‘১৯৭১’ ও ‘স্মৃতি ৭১’। মোরশেদুল ইসলামের ‘অনিল বাগচীর একদিন’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘সূচনা’, ‘শরৎ ৭১’ ও ‘আগামী’। হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘আগুনের পরশমণি’। তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’ ও ‘নরসুন্দর’। নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’ ও ‘একাত্তরের যীশু’। তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ ও ‘স্ফুলিঙ্গ’। নুরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’।


একাত্তরের পটভূমিতে নির্মিত চলচ্চিত্রে এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছেন নির্মাতারা। বর্তমানেও মেধাবী নির্মাতারা রয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের সংখ্যা নেহাতই কম। এ বিষয়ে নির্মাতা তৌকীর আহমেদের ভাষ্য, ‘এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এখনও সিনেমা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও হবে। তবে খুব যে বেশি বা ভালো সিনেমা নির্মিত হয়েছে তা বলব না। এ নিয়ে আরও কাজ করার আছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নির্মাণের বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, এ ধরনের সিনেমা নির্মাণে ব্যয় প্রচুর। একটা সময়কে তুলে ধরতে হয়। একটা সাধারণ সিনেমা নির্মাণ করতে যতটুকু খরচ হয়, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নির্মাণে সেই খরচটা বেড়ে যায়। আমার জয়যাত্রা এবং ফাগুন হাওয়া নির্মাণ করতে গিয়ে এমনটা উপলব্ধি করেছি।’

Link copied!