• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

‘বৃত্তের বাদামি খামে চিঠি দিও প্রিয়জনের নামে’


আবু সাঈদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২২, ০৯:০২ এএম
‘বৃত্তের বাদামি খামে চিঠি দিও প্রিয়জনের নামে’

বর্তমান সময়ে আমরা তথ্য ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এতোটাই উন্নত হয়েছি যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে খুব সহজেই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারি। কিন্তু অতীতে এমনটা ছিল না। বর্তমানে ই-মেইল, ফেইসবুক, টুইটার, ভাইবার, ইন্সটাগ্রামের মতো মাধ্যমগুলো যোগাযোগের স্থান দখল করে থাকলেও অতীতে ছিল আবেগ, অনুভূতি, অপেক্ষা ও ভালোবাসা মিশ্রিত এক অভিনব পদ্ধতি। তখন মানুষের অনুভূতিগুলো প্রকাশ পেত চিঠির ভাষায়।

খুব বেশিদিন হয়নি, এইতো কিছুদিন আগেও মানুষ তার মনের অনুভূতিগুলো কাগজের টুকরায় টুকে দিয়ে বাদামি খামে মুড়িয়ে ডাক পিয়নের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিত তার প্রিয়জনের ঠিকানায় এবং উত্তরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতো। এই অপেক্ষা যেন কিছুতেই শেষ হতে চাইতো না। এভাবে দিনের পর দিন কেটে যেত হঠাৎ একদিন ডাক পিয়নের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দের আওয়াজে বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসতো। কাঙ্ক্ষিত চিঠি হাতে পেয়ে প্রিয়জনের সাথে বছরের পর বছর দেখা না হওয়ার তীব্র আক্ষেপ যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেত।

আগের হাতের লেখা চিঠির আলাদা একটা গুরুত্ব ও মায়াতে ভরপুর ছিল। প্রিয়জনের হাতে লেখা চিঠি যখন পড়তো তখন মনে হতো শব্দগুলো যেন তাকে আলতো ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সেই চিঠির প্রচলন। যান্ত্রিকতায় পিষ্ট হয়ে মরে গেছে সেই আবেগ, অনুভূতি। হারিয়ে গেছে খাকি পোশাকের সেই ডাক পিয়ন। ডাকবাক্সগুলোও এখন হয়ে উঠেছে জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত।

সময়ের পরিবর্তনে সেই চিঠি ও ডাক বাক্সের ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও বর্তমান প্রজন্মকে সেই ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) একমাত্র গ্রাফিতি সংগঠন ‘বৃত্ত কুবি’ তৈরি করেছে ‘চিঠি চত্বর’। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই তাদের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। চিঠি চত্বরের ঠিকানায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কেউ চিঠি দিতে পারবে। ‘বৃত্ত কুবি’র সদস্যরা ডাক পিয়নের ভূমিকায় সেই চিঠি পৌঁছেও দিবে প্রাপকের ঠিকানায়।

‘বৃত্ত কুবি’র উদ্যোগে চিঠি চত্বরের কাজ শুরু হয় ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২। তারপর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন চিঠি চত্বরের ডাকবাক্সে চিঠি ফেলবার মধ্য দিয়ে উদ্বোধন করা হয় চিঠি চত্বরটি। হরেক রকমের রঙে সজ্জিত এই চত্বরে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে “আমি তবুও অপেক্ষায় রইলাম সেই কাঙ্ক্ষিত চিঠির যদি ভুল করে উত্তর চলে আসে।”, “মেসেজ কেন? আমি তোমার হাতের লেখার চিঠি চাই। ভুল বানান, বাঁকা অক্ষর, কিচ্ছু ক্ষতি নাই”—এরকম অসংখ্য প্রতীকী চিঠির টুকরো। তাছাড়া রাখা হয়েছে বিশাল আকৃতির একটি প্রতীকী খালি কাগজ। সেখানে প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর ডাকবাক্সে আসা চিঠিগুলোর মধ্যে খোলা চিঠি প্রদর্শন করা হবে এবং সেগুলো তাদের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করা হবে।

‘বৃত্ত কুবি’র সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিঠি চত্বরের ডাকবাক্সে দেওয়া যাবে তিন ধরনের চিঠি। নাম ঠিকানাসহ চিঠি, বেনামি চিঠি ও খোলা চিঠি।

চিঠিগুলোর মধ্যে নামসহ চিঠির গুরুত্ব সর্বাধিক। এই ধরনের চিঠির খামে প্রেরক এবং প্রাপক দুইয়ের নাম ঠিকানা উল্লেখ থাকবে। চিঠিতে প্রাপকের নাম, ঠিকানা (বিভাগ, ব্যাচ, হল) উল্লেখ থাকতে হবে। সেই নামসহ চিঠি সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় (ক্ষেত্রে বিশেষ) পৌঁছে দেওয়া হবে প্রাপকের কাছে।

বেনামি চিঠির খামে শুধু প্রাপকের নাম-ঠিকানা উল্লেখ থাকবে। বেনামি চিঠির ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে কিছু চিঠি চেক করে দেওয়া হবে। যাতে উদ্ভট, হুমকিসরূপ কিংবা অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ কোনো চিঠি না দেওয়া হয়। আর খোলা চিঠির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম নেই। যার যেভাবে খুশি সেভাবেই লিখতে পারবে।

‘বৃত্ত কুবি’র এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগের প্রশংসা এখন ক্যাম্পাস জুড়ে। কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়াতেও তাদের কাজের প্রশংসা করেছেন। তাদের এমন কাজে সাধুবাদ জানিয়ে কুমিল্লা ডাক বিভাগ থেকে ডাকবাক্স উপহার পাঠিয়েছে।

‘বৃত্ত কুবি’র এমন উদ্যোগের প্রশংসা জানিয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, “চিঠি এক নতুন প্রত্যয়, নতুন শক্তি যা আমাদের অনুভূতি সত্তার মৌলিকত্বকে বাড়াতে সহায়ক। চিঠির প্রতিটা লিখায় জড়িয়ে থাকে গভীর অনুভূতি, গভীর আবেদন ও গভীর প্রত্যাশা। বর্তমান যুগে আমরা এতটাই কৃত্রিমতায় মজেছি যে, চিঠির সেই ঐতিহ্যকে প্রায় ভুলেই গেছি। বৃত্ত কুবি’র এই নব উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয় ও স্মরণীয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম মৌলিক অনুভূতি খুঁজতে আবার চিঠির আঙিনায় গিয়ে আশ্রয় নেবে।”

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিয়া রিমি বলেন, “বৃত্ত কুবি গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত যতোগুলো উদ্যোগ নিয়েছে, গ্রাফিতি করেছে সবগুলোর মধ্যে এই ‘চিঠি চত্বর’ একেবারে অন্যরকম একটি উদ্যোগ। আমাদের জেনারেশন বলতে গেলে চিঠি আদান প্রদানের তেমন স্বাদ পায়নি যার ফলে একটা আক্ষেপ কাজ করতো সবসময়। চিঠি চত্বরের কল্যাণে এই আক্ষেপ এবার বোধ করি ঘুচবে।”

চিঠি চত্বর নিয়ে ‘বৃত্ত কুবি’র হেড অফ মার্কেটিং তাওহীদ সানি বলেন, “চিঠির একটা সোনালি যুগ ছিল। চিঠির মাধ্যমে মানুষ তথ্য আদান প্রদান করতো, বর্তমানে সেটা হারিয়ে গেছে। চিঠির হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ফিরে পাবার জন্যে এটা আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বলা যায়। আশা করছি এই উদ্যোগের মাধ্যমে বর্তমান জেনারেশন সেই ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারবে।”

Link copied!