বারবার জাহাজ ডুবির কারণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পশুর নদী ও শিবসা নদী এখন চরম পরিবেশগত ঝুঁকির মুখে। একের পর এক ফ্লাইঅ্যাশ, কয়লা ও ক্লিংকারবাহী কার্গো ডুবে নদীর পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত পদার্থ। এর প্রভাবে জলজ প্রাণী, বনভূমি এবং মানবস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়ছে।
সর্বশেষ শুক্রবার (২৭ জুন) ভোরে পশুর নদীর ত্রিমোহনা চরের কাছে ডুবে যায় ফ্লাইঅ্যাশবাহী এমভি মিজান-১। জাহাজটি ভারতের কলকাতার ভেন্ডেল এলাকা থেকে ৯১৪ মেট্রিক টন ফ্লাইঅ্যাশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বসুন্ধরা ঘাটের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। মোংলা বন্দরে যাত্রাবিরতির সময় কে আলম গুলশান-২ নামের একটি লাইটার জাহাজের ধাক্কায় মুহূর্তেই তলা ফেটে জাহাজটি ডুবে যায়। ফলে নদীর পানিতে বিপুল পরিমাণ ফ্লাইঅ্যাশ ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক বছরে পশুর ও শিবসা নদীতে অন্তত ছয়টি বড় জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ডুবেছিল ফ্লাইঅ্যাশবাহী এমভি ফারদিন-১। ২০২১ সালের মে মাসে ডুবে যায় ক্লিংকারবাহী এমভি হাফিজ-৪। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নদীর বুকে হারিয়ে যায় এমভি সাকিনা-৭। এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কয়লাবাহী এমভি মেঘদূত-৫ শিবসা নদীতে ডুবে যায়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের আগস্টে ডুবে যায় ফ্লাইঅ্যাশবাহী এমভি রাজনীগন্ধা-২।
গবেষণা ও পরিবেশবিদদের মতে, ফ্লাইঅ্যাশে থাকা মার্কারি, সীসা, পারদসহ ভারী ধাতু নদীর তলদেশে জমা হয়ে যায়। সেখান থেকে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, ডলফিনসহ জলজ প্রাণীর শরীরে। দীর্ঘমেয়াদে এসব বিষাক্ত উপাদান মানুষের শরীরেও পৌঁছায়।
পরিবেশবিদ নুর আলম শেখ বলেন, “ফ্লাইঅ্যাশের মধ্যে থাকা ভারী ধাতু নদীতে মিশে ভয়াবহ দূষণ ঘটাচ্ছে। এটি নদীর ইকোসিস্টেম ধ্বংস করছে।”
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “একবার ফ্লাইঅ্যাশের বিষ খাদ্যচক্রে ঢুকে গেলে এর প্রভাব দশকের পর দশক থাকবে। মাছ ও ডলফিন কমে যাচ্ছে। এর প্রভাবে মানবদেহে ক্যান্সার, স্নায়ু বিকলতা এবং কিডনি সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে।”
২০০১-২০০২ অর্থবছরে পশুর ও শিবসা নৌপথে বার্ষিক জাহাজ চলাচল ছিল ৪২৮টি। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪৫-এ। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বেড়েছে কয়েকগুণ।
মোংলা বন্দরের উপপরিচালক মো. মাকরুজ্জামান জানান, নদীর চ্যানেল নিরাপদ আছে, নৌযান চলাচল স্বাভাবিক।
তবে পরিবেশবিদদের মতে, চ্যানেল নিরাপদ থাকলেও জলজ প্রাণী ও প্রকৃতি নিরাপদ নয়। যেভাবে বারবার কার্গো ডুবছে। এতে নদীর তলদেশে জমছে বিষাক্ত পদার্থ। এর প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকায়। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এই সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।