মধুর প্রতীক্ষা কি একেই বলে? রাত থেকে প্রস্তুতির শুরু।সকাল হলেই ‘রেড লেটার ডে’র তকমা পাবে যে দিনটি, তার জন্য শপিং লিস্ট’টা নিখুঁত হওয়া চাই। তাই পরীক্ষার আগে মনোযোগী শিক্ষার্থীর মতো বারবার যাচাই করে নিচ্ছিলাম ক্যামেরাটাকে। ব্যাটারির চার্জ থেকে ট্রাইপড, মাইক্রোফোন, মোবাইল স্টিক—সবই যাচাই করে গুছিয়ে তবেই ঘুম।
সকালে সেজান ভাইয়ের গাড়িতে মোজা থেকে কান যখন পৌঁছালাম, তখন সমুদ্রপারের শহরটা যেন আরও উজ্জ্বল! আকাশটা যেন আরও ঝকঝকে। এমনটা আগে কখনো হয়নি।
হবেই-বা কেন? এর আগের তিনবার উৎসবে কখনোই তো এমন অভিজ্ঞতার স্বাদ পাইনি। ছবি দেখতে কতবারই তো ‘সালে দেবুসি’র সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এবারে ‘সালে দেবুসি’টা যেন কত আপন!
-20210902084947.jpg)
ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশ। থিয়েটারের সামনে দাঁড়াতেই হাজির ‘টিম ডি ডব্লিউ’। যুবায়ের আর অনুপম। তখনো ফাঁকা দেবুসির সামনেটা। ঢাকা থেকে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সিনেমার সহপ্রযোজক রাজীব মহাজন হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়ে রাখলেন ‘টিম রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবি শুরুর ১৫ মিনিট আগে ‘দেবুসি’র সামনে থাকবে। রাজীব হোয়াটসঅ্যাপে একটা গ্রুপও ক্রিয়েট করেছে ‘বিডি প্রেস ইন কান’ শিরোনামে।
সালে দেবুসির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা চার সাংবাদিক। নিউইয়র্ক থেকে সামিয়া জামান আপা গতকাল এলেও দেখা হয়নি আমাদের সঙ্গে। একটু পরেই এলেন আপা। কানে বরাবরই তিনি আমাদের অভিভাবক। সবাইকে দেখে খুশি হলেন এই সকালে। খোঁজখবর নেওয়া শেষে আমরা ব্যস্ত হলাম যার যার ক্যামেরা নিয়ে।
একটু একটু করে ভিড় বাড়ছিল ‘সালে দেবুসি’র সামনে। এর মাঝেই ঢাকায় সরাসরি যুক্ত হলাম ‘সংবাদ সংযোগে’ তখনকার আপডেট নিয়ে। জনি হক তার পত্রিকার অনলাইন ভার্সনেও লাইভে যুক্ত হলো। লাইনটা একটু বড় হতেই দাঁড়িয়ে পড়লাম।
গতকাল থেকেই ভাবছিলাম, বাংলাদেশের ছবি দেখতে এখানে আসা ফিল্ম প্রফেশনাল আর সাংবাদিকরা কতটা আগ্রহী হবেন? কিন্তু সেই আশঙ্কা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে দীর্ঘ লাইন।
বিভিন্ন দেশের সংবাদকর্মী এবং মার্শে দু ফিল্মে অংশগ্রহণকারী ফিল্ম প্রফেশনালদের মধ্যে বিপুল আগ্রহই দেখা গেল ছবিটি ঘিরে।
লাইন এগোচ্ছে। আমরাও এগোচ্ছি। সিকিউরিটির কাছাকাছি আসতেই মোবাইলে থাকা ডাউনলোড করা টিকিটটা যখন বাড়িয়ে দিয়েছি, তখনই চোখের সামনে একটু দূরে সিঁড়িতে লাল গালিচায় ‘টিম রেহানা মরিয়ম নূর’। গর্বিত লাল কার্পেটে যেন একগুচ্ছ স্বপ্ন!
তর সইছিল না। সিকিউরিটিকে পাত্তা না দিয়েই দ্রুত পৌঁছে গেলাম সাদ আর বাঁধনদের কাছাকাছি। তাদের চোখও যেন আমাদেরই খুঁজছিল।
সাত ভাইয়ের এক বোন যেন বাঁধন। মুখে দীপ্তি। ঝলমল করছিল জামদানিতে। একটুও থেমে নেই আমার ক্যামেরা। বাইরের দর্শকও অভিবাদন জানাচ্ছিল বাঁধনদের। দাঁড়িয়ে সেই অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিল বাঁধনরা। কখনো ক্যামেরায় সাড়া দিচ্ছিল। আবার কখনো নিজেরাই ‘সেলফি’ তুলছিল। সব মিলিয়ে মিনিট পাঁচেক। কিংবা তারও বেশি। খেয়াল করার সুযোগ হয়নি। কীভাবে যেন উড়ে গেল সময়টা।
সালে দেবুসিতে যখন প্রবেশ করলাম, তখন প্রেক্ষাগৃহ প্রায় ভরে উঠেছে। নিজের টিকিট সিরিয়ালটা খুঁজে নিয়ে সিটে বসলাম। ছবি তোলার জন্য খুব সুবিধাজনক স্থান নয়। পাশের সিটের ভদ্রমহিলা আমার ক্যামেরা, ট্রাইপডে কিছুটা বিরক্ত মনে হলো। বুঝলাম, এখান থেকে ছবি তোলা সহজ হবে না।
ধীরে ধীরে পূর্ণ ‘সালে দেবুসি’। মঞ্চে এলেন উৎসব পরিচালক থিঁয়েরি ফ্রেমো। জানিয়ে রাখলেন, দর্শক সারিতে উপস্থিত আছেন এবারের আসরের আ সার্টেন রিগার্ড বিভাগের বিচারকদের সভাপতি আন্দ্রেয়া আর্নল্ড।
এরপর একে একে আমন্ত্রণ জানালেন ‘রেহানা মরিয়ম নূরে’র প্রযোজক জেরেমি চুয়া, নির্বাহী প্রযোজক এহসানুল হক বাবু, অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন এবং পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদকে। দর্শকদের করতালিতে মুখর মঞ্চে মাউথ পিস হাতে নিলেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। আবেগাপ্লুত সাদের মুখে যেন কথাই সরছিল না। বারবার বলছিলেন ‘অবিশ্বাস্য’। বলছিলেন ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এখানে আসতে পেরেছি! আমাদের জন্য বিশেষ ব্যাপার হলো, কানের অফিশিয়াল সিলেকশনে বাংলাদেশের প্রথম ছবি এটাই। আমাদের কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। আসার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি, আমাদের ছবিটি ভালো লাগবে।’
এরপরই নিভে গেল ‘সালে দেবুসি’র আলো। সেলুলয়েডের নীল আলো এসে বুঁদ করে রাখল ১ হাজার ৬৮ দর্শককে পরবর্তী এক ঘণ্টা সাতচল্লিশ মিনিট!
(চলবে)