• ঢাকা
  • শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভাষা আন্দোলন শেষ, ভাষা-সংগ্রামের বাকি এখনো


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ০২:০৩ পিএম
ভাষা আন্দোলন শেষ, ভাষা-সংগ্রামের বাকি এখনো

একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্বব্যাপী। শহীদ দিবসের ধারণাটি রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের স্মরণের স্মারক, আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ধারণাটি মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের বৈশ্বিক স্বীকৃতি। দিনটি আমাদের জন্য আনন্দের নয়, শোকের। তবে একই সঙ্গে গৌরবের, কারণ বাংলা ভাষার কারণেই সারা বিশ্বের সব ভাষাভাষী মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

ইতিহাস বলে, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানের পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারসহ বেশ কজন শহীদ হন। এ জন্য দিনটি আমাদের কাছে শহীদ দিবস। রক্তের সিঁড়ি বেয়ে এরপর বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। আর ২০১০ সালে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। তাই দিনটি বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের জন্য গৌরবের। দিনটি গৌরবের হলেও তাই এটা আমাদের কাছে উদযাপনের নয়!

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী রচিত এবং আলতাফ মাহমুদের সুরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ কালজয়ী গানটি আমাদের কাছে ‘একুশের জাতীয় সংগীত’ হিসেবে পরিগণিত। মনে হয় এই গান ব্যতিরেকে একুশে-স্মরণ পূর্ণতা পায় না। একুশের প্রত্যুষে প্রভাতফেরিতে নগ্নপদে, বাদ্য ছাড়া এই গানটি সেই ছোটবেলা থেকে আমরা গেয়ে আসছি। হাতে ফুল আর ফুলের তোড়া এবং কণ্ঠে ‘একুশের জাতীয় সংগীত’ নিয়ে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আসছি। এটা একুশের চিরায়ত স্মারক হয়েই ছিল এত দিন। তবে কয়েক দশক ধরে রাতের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদ মিনারে হুড়োহুড়ি-হইহুল্লোড় চালু হয়েছে সেটা দিবসটির গাম্ভীর্য কতখানি ধারণ করছে, এ নিয়ে আলোচনার দরকার। কারণ, এই ঢঙে দিবস পালনের সঙ্গে উদযাপনের আমেজ চলে আসে, যদিও দিনটি আমাদের কাছে পুরোপুরি উদযাপনের নয়; শহীদ-স্মরণের।

একুশে ফেব্রুয়ারি নাকি আটই ফাল্গুন, কোন তারিখে আমাদের শহীদ দিবস পালিত হবে, এ নিয়ে নানা মত আছে। তবে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত দিবসটি বলে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখের নামেই দিনটির আয়োজনে আপত্তি দেখছি না। বায়ান্নর একুশের বিয়োগান্তক ঘটনার পর তেপান্নতে প্রথম শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হয় এবং এটা সকালে এবং নগ্নপদে। ‘একুশের পটভূমি ও একুশের স্মৃতি’ গ্রন্থে ‘শহীদ মিনারের কথা’ নিবন্ধে ভাষাসংগ্রামী রফিকুল ইসলাম এমনটাও জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ দিবসে প্রভাতফেরি করা হয় নগ্নপদে। কণ্ঠে ছিল গাজীউল হক রচিত গান, ‘ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না’। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালো পতাকাও তোলা হয় সেদিন। মায়ের ভাষার অধিকার আদায় করতে যে শহীদদের রক্তে রঙিন হয় রাজপথ শ্রদ্ধা জানাতে সেই পথে জুতা পায়ে যাবে কেউ—অচিন্তনীয় ব্যাপার ছিল সেটা। তবে এমনটা হচ্ছে। রাতে শ্রদ্ধা নিবেদন বলে প্রভাতফেরি ওসময় সম্ভব না বলে জুতা পায়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত পৌঁছায় মানুষ। শহীদবেদিতে ফুল দেওয়ার সময়ে কেবলই খুলে জুতা-জোড়া! এখানে শ্রদ্ধায় অবনত মস্তক-নিবেদিত হৃদয়ের যে ধারণা সেটার অনুপস্থিতি তাই স্বাভাবিকই! রাতের প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়টি আগে ছিল না, কিন্তু সম্ভবত আশির দশকের শুরুতে এটার প্রচলন। বাংলা বর্ষের দিনের শুরু আর খ্রিষ্টীয় বর্ষের দিনের শুরু রাতে হয় বলে কি এই পরিবর্তন? তবে এই যুক্তি সম্ভবত এতখানি দৃঢ় নয় যেখানে এই দিনের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক শ্রদ্ধা-সংযোগ!

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার স্বীকৃতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে সারা বিশ্বে উদযাপনের প্রপঞ্চ, কিন্তু আমাদের কাছে এটা পরিপূর্ণভাবে উদযাপনের নয়। ধারাবাহিক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ভাষার অধিকার আদায়ের দিন এটা। বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়ে আমরা কি তবে ভুলে যাব রক্তের কথা? সালাম, বরকতের রক্ত শুকিয়ে কি তবে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়-হাওয়ায়? বৈশ্বিক স্বীকৃতিতে ইতিহাসকে এভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিত হবে না আমাদের। রক্তে অর্জিত বিশ্ববাসীর মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের স্বীকৃতি-স্মারক এই একুশে ফেব্রুয়ারি—এই ভেবে আমরা গৌরবের অংশীদার হতে পারি কিন্তু ভুলে যেতে পারি না রক্তের কথা, আত্মত্যাগের ইতিহাস। অন্য ভাষাভাষীদের কাছে হলেও একুশে ফেব্রুয়ারি তাই আমাদের কাছে উৎসবের নয়। অন্যরা উৎসব করতে পারে এখানে, কারণ তাদের মায়ের ভাষার অধিকারের স্বীকৃতি মিলেছে; তবে আমাদের কাছে গৌরবের, স্মরণের, বিনত শ্রদ্ধার।

বাংলাভাষী জনগণের ওপর উর্দু ভাষা ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ‘না’ উচ্চারণ করতে পেরেছিল আমাদের ছাত্রসমাজ। সেই ‘না’ উচ্চারণ কেবল কণ্ঠনিঃসৃত উচ্চারণই ছিল না, ছিল অন্তঃস্থ প্রকাশও। তাই রক্ত দিয়ে ‘না’-কে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল বীর বাঙালি। সেটা ছিল আমাদের ভাষা-আন্দোলন। এই আন্দোলন সফলে আমরা পেয়েছি ভাষার অধিকার, বিশ্বব্যাপী পেয়েছে মাতৃভাষার অধিকারের স্বীকৃতি। আমরা নিজেদের জন্য শুরুতে যা আদায় করেছি অন্যরা তার সুফল ভোগ করছে, করবেও। তবে আমরা কি বাংলা ভাষাকে সেই মর্যাদা দিতে পেরেছি, পারছি, দিতে আগ্রহী? প্রশ্ন!

বায়ান্ন, সত্তর পেরিয়ে একাত্তরে পা দিয়েছে, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রয়োগে আমরা সফল হতে পারিনি। আবার এ-ও বলা যায় বাংলাকে প্রায়োগিক ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি না। সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও বাংলার শুদ্ধ ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ভুলভাল উচ্চারণ, ভুল বানানে বাংলার আধিক্য সর্বক্ষেত্রে। সরকারি-বেসরকারি দপ্তরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগপত্রেও ভুল বাংলার ব্যবহার দেখা যায়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরাও সচেতন বলে মনে হয় না। শুধু ভাষার মাস এলেই শুদ্ধভাবে বাংলায় লেখার আওয়াজ ওঠে। মাস পেরোলেই সব আগের মতন!

রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে বাংলাকে প্রায়োগিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি মানে অন্য ভাষা বিশেষত সারা বিশ্বে প্রচলিত ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ নয়। এই ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি না করেও সেটা করা যায়। বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষাগুলোকে বাদ দিতে হবে এমন না। ইংরেজি বা অন্য ভাষাকে বাদ দিয়ে নয়, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাংলাকে প্রাথমিক ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করে অন্য ভাষার ব্যবহারও করা যায়। এটা সংঘাতের বিষয় নয়, এটা প্রয়োগ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমাদের ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষার স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি সে শিক্ষাই দেয় আমাদের।

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে আমরা জয়ী হয়েছি। ভাষার অধিকার আদায় করেছি। ভাষা-আন্দোলন শেষ হয়ে গেলেও ভাষার-সংগ্রাম সম্ভবত শেষ হয়ে যায়নি। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের ভাষা-সংগ্রামের বাকি এখনো!

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

Link copied!