• ঢাকা
  • সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
ক্রিকেট

বাংলাদেশে এক শ এবং বাংলাদেশের এক শ


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২২, ০৩:৫৯ পিএম
বাংলাদেশে এক শ এবং বাংলাদেশের এক শ

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ। এখনো ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তারা। বিদীর্ণ অর্থনীতি। বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ক্রিকেটীয় মাস্তুলটা তারা উঁচিয়ে ধরে রাখতে চান জীবন বাজি রেখে। পেশাদার ভাবনা আর দেশপ্রেম, দুটোর মিশেল নিজেদের ভেতরে কাজ না করলে এটা সম্ভব নয়। আফগানরা ক্রিকেট মাঠে বারবার সেটাই বোঝাতে চান।

কিন্তু তারপরও কী দুর্ভাগ্য! অর্থনীতির উদারীকরণ আর স্যাটেলাইট টিভির এই জমানায় জাতীয় দলের জন্য কোনো স্পন্সর ছিল না আফগানাদের! শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাদের পাশে দাঁড়াল বাংলাদেশের এক তারকা ক্রিকেটারের কোম্পানি। আফগানরা কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন ওই ক্রিকেটারের প্রতি। যাকে তার নিজের দেশের অনেক মানুষ বলেন, ‘লোভী! দেশের হয়ে খেলার চেয়ে বেশি ভাবেন টাকার জন্য!’ পেশাদারদের ভাবনা পেশাভিত্তিক হলে সেটা আদৌ নিন্দনীয় নয়। এই চিন্তাটা এখনো ছুঁতে পারেনি এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের মন।

জাতীয়তাবাদ মানে দেশের গণ্ডিতে জবুথবু বসে থাকা নয়। জাতীয়তাবাদ মানে এমন কিছু, যা হাঁটে-চলে-নড়ে-চড়ে। এমনকি বিদেশি প্রতিপক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে আবার তাদের হারিয়ে প্রকাশ্যে জয়োল্লাসও করে। সাকিব আল হাসান কি সেটাই করলেন না? ক্রিকেটার সাকিবের চেয়ে ব্যবসায়ী সাকিবের জয়টাও ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। যদিও আফগানদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। তবে এই সিরিজেও কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে দাগ কেটেছেন আফগানরা।

সিরিজের প্রথম ম্যাচটা অদ্ভুত অবিশ্বাসী এক বাতাবরণের মধ্য দিয়ে জিতেছিল বাংলাদেশ। অথবা সোজাসাপটা বলে ফেলা যায়, মেহেদী ও আফিফ নামের দুই যুবক জিতিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। পরের ম্যাচটা অবশ্য আফগানদের রীতিমতো ভেঙেচুরে সিরিজ জেতে স্বাগতিকরা। কিন্তু শেষ ম্যাচে? আফগানাদের কাছে রীতিমতো অসহায় বাংলাদেশ!

এই ম্যাচে একটা কৃতিত্ব গড়লেন আফগান উইকেটকিপার ব্যাটার রহমানউল্লাহ। যে কৃতিত্বের পর ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হলো। ঢাকা-দুবাই-করাচিতে বার কয়েক কল করতে হলো। বাংলাদেশের মাটিতে ওয়ানডে ক্রিকেটে শততম সেঞ্চুরি এলো এক আফগান ক্রিকেটারের ব্যাট থেকে। ইনিংস ওপেন করতে নেমে ১১০ বলে অপরাজিত ১০৬ রান করলেন রহমানউল্লাহ। শততম সেঞ্চুরিটা তার। এবং সেটা চট্টগ্রামে। কাকতালীয়ভাবে এ দেশের মাটিতে ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরিটাও মানুষ দেখেছিল সেই চট্টগ্রামে। চৌত্রিশ বছর আগে এক পাকিস্তানি ক্রিকেটার প্রথম সেঞ্চুরি করেন বাংলাদেশের মাটিতে। তিনি এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। মইন-উল-আতিক। ’৮৮ সালে এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন তিনি। ১১৭ বলে ১০৫ রান করে যার বলে বোল্ড হয়েছিলেন, কাকতালীয়ভাবে রহমানউল্লাহর সেঞ্চুরির সময় তিনি কমেন্ট্রি বক্সে। আতহার আলী খান নিজেও ভুলে যেতে পারেন সেই পাকিস্তানি ক্রিকেটারকে।

করাচিতে ফোন করে পাকিস্তানের নামকরা ক্রিকেট সাংবাদিক কামার আহমেদের কাছে মইন-উল-আতিকের সেল নম্বর চাইতেই তিনি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলেন! ‘মইন? তার সঙ্গে তো বেশ কয়েক মাস আগে দেখা হয়েছিল। ও আবার কী করল!’ তার কৌতূহল থামাতে বললাম, তিনি তো বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেছিলেন। কাল বাংলাদেশের মাটিতে ১০০তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করলেন এক আফগান। শুনে কামার আহমেদ জানালেন; মইন করাচিতে আছে। তবে ও এখন ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে নেই। স্টেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করে, পরে এমবিএ করা মইন এখন করাচির একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।

কিন্তু আফগান ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের সঙ্গে মইনের একটা সম্পর্ক আছে, কাকতালীয় একটা যোগসূত্র আছে।  মোহাম্মদ নবীরা যখন প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন, তখন লাহোরে ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেই সময় যুদ্ধের ভয়াবহতায় আতঙ্কগ্রস্ত আফগানদের মনোবিজ্ঞান পড়িয়েছেন মইন-উল-আতিক। কঠিন পরিস্থিতিতে মনকে কীভাবে শক্ত রাখতে হয়। আবেগকে দূরে সরিয়ে বাস্তবের রুক্ষ জমিনে পা ফেলে এগিয়ে যেতে হয় কীভাবে, সেটা মইন-উল আতিক শিখিয়েছেন মোহাম্মদ নবীদের। করাচিতে জন্ম। বেড়ে ওঠা। উচ্চতর পড়াশোনা ব্রিটেনে। তারপর পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলা। আবার ক্রিকেট ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়া। আবার পাকিস্তানে ফিরে এসে ক্রিকেটের মনস্তত্ত্ব পড়ানো। এই হচ্ছেন মইন-উল-আতিক। চট্টগামে তার ক্যারিয়ারের প্রথম এবং শেষ এক দিনের সেঞ্চুরিটা যিনি দেখেছিলেন ফিল্ডিং করতে করতে, সেই আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে ফোনে ধরা গেল দুবাইতে। স্থানীয় সময় খুব ভোর বলা যায়। মইন-উল-আতিকের সেই সেঞ্চুরির কথা উঠতেই প্রথম কমেন্টস: ভেরি ক্লিন ইনিংস। ওই ম্যাচে ইজাজ আহমেদও সেঞ্চুরি করেছিলেন। তবে মইনের ইনিংসটা মনে রেখেছি অন্য কারণে, কোনো বাউন্ডারি ছাড়া ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেছিলেন। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন আর কারও আছে কি না! তবে এসিসির হয়ে যখন কাজ করেছি, তখন ওকে আমরা আফগান দলটাকে গড়ে তুলতে কাজে লাগিয়েছিলাম। ক্রিকেটের মনস্তত্ত্বটা ও ভালো বোঝে।’

মইন-উল-আতিক থেকে রহমানউল্লাহ। বাংলাদেশের মাটিতে ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরিয়ান আর সেঞ্চুরির কত কোলাজ। তবে মইন-উল-আতিকের সেঞ্চুরি মনে করিয়ে দেয়, সময়ের পথে ক্রিকেট কত পাল্টে গেছে। বাউন্ডারি-ওভারবাউন্ডারি ছাড়া ওয়ানডে সেঞ্চুরি! তা আবার সেই বাংলাদেশের বিপক্ষে, যারা তখন ওয়ানডে স্ট্যাটাসও পায়নি। তারপরও সেদিন তার ইনিংসের স্ট্রাইক রেটটা কোনোভাবেই ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। ৮৯ দশমিক ৭৪।

আর রহমানউল্লাহর পরপর তিন ওয়ানডে সিরিজে তিনটা সেঞ্চুরি করলেন। চট্টগ্রামে করলেন ১১০ বলে অপরাজিত ১০৬ রান। স্ট্রাইক রেট ৯৬ দশমকি ৩৬। ৭টা বাউন্ডারি আর ৪টা ওভার বাউন্ডারি। এই দুটো পরিসংখ্যান লেখার পর মনে হচ্ছে, একটা ফুটনোট দিতেই হবে। সেই সময় ত্রিশগজি বৃত্ত বলে কিছু ছিল না। ফিল্ড পজিশনে বাধ্যবাধকতা ছিল না। পাওয়ার-প্লে ক্রিকেট অভিধানে ঢুকে পড়েনি। সব মিলিয়ে ক্রিকেটটা তখনো শুধু ব্যাটারদের খেলায় পরিণত হয়নি। তবে এই লেখার মূল ফোকাস কিন্তু অন্য। বাংলাদেশের মাটিতে এক আফগান যে সেঞ্চুরিটা করলেন, সেটা এ দেশে ওয়ানডেতে এক শ সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করল। আর সেই সময়, যখন বাংলাদেশ আইসিসির ওয়ানডে সুপার লিগে তালিকার শীর্ষে। এবং ঠিক ১০০ পয়েন্ট নিয়ে!

সত্যিই, সাগরিকায় কাকতালীয় সংখ্যা হয়ে থাকল ১০০! মইন-উল-আতিক কিংবা রহমানউল্লাহ, আপনারা চট্টগ্রামে ওয়ানডেতে ফুটনোট নয়; রীতিমতো ইতিহাসে ঢুকে থাকলেন।

 

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!