• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

শেখ কামাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য


সাদাত উল্লাহ খান
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২১, ০৫:০৩ পিএম
শেখ কামাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য

আমরা সমাজবিজ্ঞানী শেখ কামালকে কতটুকু জানি? তিনি সমাজে পরিচিতি অর্জন করেছেন একজন ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সেতারবাদক, অভিনেতা, নাট্য সংগঠক, সংগীত সংগঠক, ক্রিকেটার, বাস্কেটবল, বলিবল খেলোয়াড়, মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ ইত্যাদি নানা উপাধিতে। এসবই সত্য। বাস্তব। এসবের বাইরেও তাঁর একটা মৌলিক শিক্ষাগত পরিচয় আছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেছেন। তিনি যাকে বিয়ে করেছেন সুলতানা কামাল খুকী, তিনিও একজন সমাজবিজ্ঞানী। আমরা এই প্রবন্ধে দেখব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পুত্র শেখ কামাল সম্পর্কে কী ভাবতেন।

শেখ কামাল বাল্যকাল থেকে মিশুক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৯ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হলেও পড়ালেখা করেছেন ঢাকায়। ঢাকার সেগুনবাগিচায় ডনস্ স্কুলে পড়ালেখা করেছেন, শাহীন স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। আর একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং ভারতে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি (এইড-দ্য-ক্যাম্প) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ শেষে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখায় ফিরে আসেন।

অন্যান্য কাজের হাজারো কর্মব্যস্ততার মাঝেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা অব্যাহত রাখেন। ইতিমধ্যে তাঁর খ্যাতি ও কর্মপরিসর বিস্তৃতি লাভ করে আর তাঁর মাথায় নানাবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও দেশগঠনমূলক চিন্তা প্রসার লাভ করে। ১৯৭৪ সালে তিনি সমাজবিজ্ঞানে সম্মান শেষ পরীক্ষা পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। আর ১৯৭৫ সালে এমএসএস পরীক্ষায় শেষ করেন এবং মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে ১২ আগস্ট (১৯৭৫) তারিখে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন, (Habibul Haque Khondker ‘Memory, History, and Sheikh Kamal’, একজন শেখ কামাল, সুজাত মনসুর সম্পাদিত, সিলেট, ২০১৮, পৃ. ৪২ এবং ৪৩)। তাঁদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নাজমুল করিম (১৯২২-১৯৮২)। শেখ কামালের মৃত্যুর পর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয় এবং তাঁর নব পরিণীতা সুলতানা কামাল খুকীও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন (Habibul Haque Khondker, ‘Memory, History, and Sheikh Kamal’, একজন শেখ কামাল, সুজাত মনসুর সম্পাদিত, সিলেট, ২০১৮, পৃ. ৪৪)।

বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ রাজনৈতিক জীবনের একটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ জেলের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এমন জেলজীবনের একটা সারসংক্ষেপ প্রদান করেছেন গবেষক ও লেখক শেখ সাদী। অধিকার আদায়ের লড়াই করতে গিয়ে ১৪ বছর ৩ মাস ১৭ দিন জেলে কাটাল (শেখ সাদী, বঙ্গবন্ধু : ভাষা ও মনোজগৎ, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১২)। জীবনের এতগুলো দিন জেলখানায় আটক অবস্থায় যাপনের ফলে পরিবারের প্রতি তেমন সময় দিতে পারেননি। পরিবার থেকে অনেক সময় দূরে থাকার যন্ত্রণা বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে বলেছেন, স্বীকার করেছেন। ‘যে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত তাদের মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নাই, (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৮৭)।

শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্ম। শৈশব থেকে বাবার আদর ও স্নেহের স্পর্শ বড় ছেলে শেখ কামাল তেমন পাননি। বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে কারাগারে রাজবন্দি হিসেবে। শেখ কামালের জন্মের সময়ও তিনি কারাগারেই ছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর মনে সন্তানস্নেহ দেখা দেয় শত রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততার মাঝেও। পিতার মনে পুত্রসন্তানের কথা উদয় হবেই। তাই তো বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘মন চলে গেছে বাড়িতে। অনেক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাসিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৪৬)।

শেখ কামাল বাল্যকালে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বিষয়টা বঙ্গবন্ধুর নজর এড়ায়নি। তাই তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পিতা ও পুত্রের সম্পর্কটা তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সকাল আটটায় হরিদাসপুর স্টেশনে নেমে নৌকায় গোপালগঞ্জ পৌঁছালাম। সঙ্গের পুলিশদের আমাকে থানায় নিয়ে যেতে বললাম। তাহলে আমাকে রেখে যেখানে হয় তারা যেতে পারবে। গোপালগঞ্জ যেয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা, মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল। এরাও এইমাত্র বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেছে। গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ি চৌদ্দ মাইল দূরে। এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনেও না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৮৩)।

বঙ্গবন্ধু জীবনে অনেক মামলা মোকাবিলা করেছেন। তাই তাঁকে বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন সময়ে আদালতে ও থানায় যেতে হয়েছে। তাই সেই সুবাদে কারাগারের বাইরে আসতে পেরেছে, মানে কারাগারের বাইরে আনা হয়েছে। এমন এক ঘটনা ও সময়ের বিবরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘থানায় ফিরে এলাম এবং দারোগা সাহেবের বাড়িতেই আমার মালপত্র রাখা হলো। আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন। যে সমস্ত পুলিশ গার্ড এসেছে ফরিদপুর থেকে তারাই আমাকে পাহারা দেবে এবং মামলা শেষ হলে নিয়ে যাবে। আব্বা, মা ও ছেলেমেয়েরা কয়েক ঘণ্টা রইল। কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসল না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও  বোধ হয় ভাবত, এ  লোকটা কে?’ (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৮৩-১৮৪)।

বঙ্গবন্ধু দেশকে ভালোবাসতেন, মানুষকে ভালোবাসতেন এবং তাই দেশ ও মানুষের কল্যাণ সাধন করতে অনেকবার কারাগারে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। ফলে পরিবার ও পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন সময় যাপন করতে হয়েছে। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাই বেদনাবিধুর বিবরণ দিয়েছেন: একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাসু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাসু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাসিনাকে বলছে, “হাসু আপা, হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে এসে ওকে কোলে নিয়ে বললাম। “আমি তো তোমারই আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন দেশে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২০৯)।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথায় ও কাজে দেখা যাবে শত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারের কথা, বাবা-মায়ের কথা, স্ত্রীর কথা এবং ছেলেমেয়ের কথা স্মরণে রাখেন। সময় ও সুযোগ পেলেই তাদের কথা নিজের আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাতেই তাঁর সংগ্রামী জীবনচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। একবার চরম সংকটকালে লাহোর সফর করেন। সফর শেষে ঢাকা ফিরে আসার খণ্ডবিবরণ দেখুন কত মায়াবী। তিনি সেই বিবরণে পুরো পরিবার ও ছোট শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বোনের বাড়িতে পৌঁছালাম, এক দিন, দুই দিন করে সাত দিন সেখানে রইলাম। ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি?... রাতে রওয়ানা করে এলাম, দিনেরবেলায় আসলে হাচিনা কাঁদবে। কামাল তো কিছু বোঝে না (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৬৪-১৬৫)। 

দেশের বিভিন্ন এলাকায় মামলার কারণে ও কারাবাসের জন্য বঙ্গবন্ধুকে যাতায়াত করতে হেয়েছে। তাঁকে মামলায় হাজিরা দেবার জন্য আর একবার গোপালগঞ্জে আনা হয়েছিল। সেইবারের বিবরণ থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থা ও ছেলেমেয়েদের সাথে নিজের আন্তরিকতা গাঢ়তর হবার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন : ‘রেণু আমাকে সাবধান করল এবং বলল, “ভুলে যেও না, তুমি হার্টের অসুখে ভুগছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।” ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কি করা যায়। হাচু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ শুরু করেছে (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৮৫)।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন বড়ই যন্ত্রণার, কষ্টের ও বেদনার। তিনি নিজে কারাবাস করেছেন আর বাইরে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা এবং পরিজনরা দারুণ মর্মবেদনায় ভুগেছেন। সেই মর্মবেদনা ও যন্ত্রণার কথা বঙ্গবন্ধু স্বয়ং বিবরণ দিয়েছেন। দেখুন সেই কষ্টের জীবনকাহিনি : রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ।  তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হল উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাসু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম “খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি? (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৯১)।

বঙ্গবন্ধু ১৯৫১-১৯৫২ সালে দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে ছিলেন। সেই সময় তিনি অনশন ধর্মঘট করছিলেন। দীর্ঘদিন অনশন ধর্মঘট করার কারণে তাঁর শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটছিল। মনের অবস্থাও চরম উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই চরম সংকটময় সময়ের কথা তিনি বলেছেন: বার বার আব্বা, মা, ভাইবোনদের চেহারা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে। রেণুর দশা কি হবে? তার তো কেউ নাই এই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থায়ই বা কি হবে? তবে আব্বা ও ছোট ভাই এদের ফেলবে না, এ বিশ্বাস আমার ছিল। চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলছিলাম। হাচিনা, কামালকে একবার দেখতেও পারলাম না (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২০৫)। আমরা বঙ্গবন্ধুর এই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের প্রতি তাঁর পিতৃস্নেহ ও সন্তানদের প্রতি আকুতি দেখতে পাই। তখনই আমাদের স্মরণে আসে তিনি তো কেবল শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের পিতা না বরং জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধু সেই দীর্ঘ দিনের অনশন ধর্মঘট অবসানের পর ফরিদপুর কারগার থেকে গোপালগঞ্জ বাড়িতে যান। তিনি সেই সময়ের  কথাও সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানেও শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের কথা উল্লেখ করেছেন: পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছলাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাসু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।” ২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনছে তাই বলে চলেছে। কামাল আমার কাছে আসল না, তবে আমার দিকে চেয়ে রইল (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২০৭)। 

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ মনোযোগসহ পাঠ করলেই যেকোনো জ্ঞানশীল ও চিন্তাশীল মানুষ সহজেই বুঝতে পারবেন বঙ্গবন্ধুর উদার মনোভাব, সত্য প্রকাশে দৃঢ়তা ও পারিবারিক জীবনের খুঁটিনাটি। এতেই প্রকাশ পায় ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব। তাঁর লিখিত দিনপঞ্জিতে মহান নেতার যাবতীয় গুণ আপনাআপনি প্রতিফলিত হয়েছে। একই সাথে আর একটা বিষয় নজরে আসে একজন গদ্যশিল্পী হিসেবেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তিনি অত্যন্ত সহজসরল ও গতিশীল ভাষায় লিখছেন : আমার শরীর ভাল না, চিকিৎসা করাতে হবে। রেণুও কিছু টাকা দিল গোপনে। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা করলাম, এপ্রিল  মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। হাচিনা ও কামাল আমাকে ছাড়তে চায় না, ওদের উপর আমার খুব দুর্বলতা বেড়ে গেছে। রওয়ানা করার সময় দুই  ভাইবোন খুব কাঁদল (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২০১)।

বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে পারিবারিক জীবন বলতে গেলে স্থির কিছু ছিল না।  এইতো কারাগারে আর এইতো রাজপথে। এমনই এক সময় তিনি কারাগার থেকে বের হতেই শুনতে পেলেন বাবা মারাত্মক অসুস্থ। তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে ঢাকার বাসায় পৌঁছার কয়েক মিনিট আগেই তাঁর সহধর্মিনী মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা জাহাজে করে গোপালগঞ্জ রওয়ানা করেছেন। সেই বিষয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু লিপিবদ্ধ করেছেন: জাহাজ ছাড়ার পনের মিনিট পূর্বে আমি নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়েছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল। হাচিনা ও কামাল আমার গলা ধরল, অনেক সময় পর্যন্ত ছাড়ল না, ঘুমালও না, মনে হচ্ছিল ওদের চোখে আজ আর ঘুম নাই (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৮৫)। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে যে কয়বার শেখ কামালের কথা উল্লেখ করেছেন তাতে পিতা হিসেবে সন্তানের প্রতি পিতৃস্নেহ আমরা দেখতে পাই এবং সাথে সাথে এটাও দেখতে পাই যে ছোটবেলায় শেখ কামাল তেমন একটা পিতার আদর ও সোহাগ উপভোগ করতে পারেন নাই। তারপরও শেখ কামালের ব্যক্তিজীবনে আদবকায়দা ও চিন্তাভাবনায় বঙ্গবন্ধুর অনেক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। শেখ কামালের চারিত্রিক গুণাবলিতে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামে প্রকাশিত। আমরা তাঁর এই আত্মজীবনীতেও শেখ সম্পর্কে পাঁচ জায়গায় কথা  বলতে দেখেছি। বড় পুত্রসন্তান  হিসেবে শেখ কামাল সম্পর্কে অনেক সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে। ১২ জুলাই ১৯৬৬ সাল রোজ মঙ্গলবার বেগম মুজিব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎটা ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত। বঙ্গবন্ধু লিখছেন: আমি কিছু সময় বাচ্চাদের সাথে আলাপ করলাম। মাকে আব্বা খুলনা থেকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। অনেকটা ভাল তখন, তবে আপাতত ঢাকা আসবে না। রেণু বলল, কামাল খুব লেখাপড়া আরম্ভ করেছে। আগামীবার ম্যাট্রিক দিবে। কামালকে মন দিয়ে পড়তে বলে বিদায় নিলাম (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮, পৃ. ১৫৯)।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। ২৩ শে মার্চ ১৯৬৭ সাল থেকে ৭ই এপ্রিল ১৯৬৭ বঙ্গবন্ধু দিনপঞ্জিতে লিখেছেন: ৬ই এপ্রিল থেকে আমার বড় ছেলে কামাল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। কোনো খবর পাই নাই কেমন পরীক্ষা দিল (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮, পৃ. ২১৬)।

আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু কারাগারে আটক থাকলেও পুত্র শেখ কামালের পরীক্ষার কথা ভেবেছেন। আর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু নিয়মিত দিনপঞ্জি লিখেছেন। সেই দিনপঞ্জি আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা মূল্যবান দলিলে পরিণত হয়েছে। আবারও শেখ কামালের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। তিনি এবার অনেকটা উৎফুল্ল। দেখুন তিনি লিখেছেন : কামাল এসেছিল। বলল, পরীক্ষা ভাল দিয়েছে। আব্বা খুলনায় আমার ভাইয়ের বাসায় চিকিৎসাধীন আসেন। একটু ভালর দিকে (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮, পৃ. ২১৭)। আমরা দেখতে  পাই বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামাচায় এই কয়টা কথা মোটের ওপর সু খবর। পুত্র শেখ কামাল পরীক্ষা ভাল দিয়েছেন। আর বাবার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে।

১২ই এপ্রিল-১৩ই এপ্রিল ১৯৬৭ বঙ্গবন্ধু নিজের লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’য় অনেক দুঃখের, যন্ত্রণার ও নিঃসঙ্গতার কথা বলেছেন। আবার মাঝে মাঝে আনন্দের কথাও বলেছেন। তবে এখানে আমরা শুধু শেখ কামাল প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যা লিখেছেন তাই-উল্লেখ করছি। এখানেও বঙ্গবন্ধুকে আমরা কারাগারে বসেও খানিকটা ভারমুক্ত দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন : নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোস্তাফা, কামাল এসেছিল। কামাল পরীক্ষা ভালই দিয়েছে। এই খবরটার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। আব্বা একটু ভালর দিকে চলেছেন  (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮, পৃ. ২২০)। 

২৭ শে মে-২৮ শে মে ১৯৬৭ বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘‘কারাগারের রোজনামচা’য় দেখা যায় পরিবারের অধিক সংখ্যক সদস্য কারাগারে সাক্ষাৎ করতে আসে। শেখ রেহানা ও শেখ কামাল, শেখ রাসেল এবং বেগম মুজিব সবাই কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সাথে সুখ-দুঃখের পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেছেন। কারাজীবনের এই পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে তুলনামূলকভাবে অনেকটা দুর্ভাবনামুক্ত দেখা যায়। ছেলেমেয়েদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন : জামাল খুলনা থেকে ফিরে এসেছে। রেহানা খুলনায় যাবার জন্য অনুমতি চায়। বললাম, ‘স্কুল বন্ধ চলে যাইও।’ কামালও বাড়ি যেতে চায় আব্বাকে দেখতে। বললাম, ‘যেও।’ কোথা থেকে যে সময় কেটে যায় কি বলব?  জেলে সময় কাটতে চায় না, কেবল দেখা করার সময় এক ঘণ্টা দেখতে দেখতে কেটে যায় (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮, পৃ. ২৪৭)। 

১৯৬৮ সালে ১৭ই জানুয়ারির ঘটনাবলি। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেষবারের মতো শেখ কামালের কথা বলছেন । ইতিমধ্যে শেখ কামাল অনেক বড় হয়েছেন। আমাদের জানা মতে সেই সময়ে শেখ কামাল ঢাকা কলেজের ছাত্র। আমরা প্রথম দিকেই আলোচনায় উল্লেখ করেছি ঢাকা কলেজে পড়ার সময় শেখ কামাল অনেক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন  এবং নিজেকে একজন বলিষ্ঠ ছাত্রনেতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। ১৭ই জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে গভীর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে অন্য কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। যাবার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : বইখাতা ও খাবার জিনিষপত্র রেখে এলাম। বলেছিলাম, আপনাদের জিনিষগুলি রেখে আমার জিনিষপত্র কামালকে (আমার বড় ছেলে) খবর দিলে নিয়ে যাবে এসে। আমাকে কোথায় নিয়ে যায় ঠিক নাই (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮, পৃ. ২৫৪)। 

আমরা বঙ্গবন্ধুর ‘অসামপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ এই দুই বইতে বঙ্গবন্ধুর চোখে শেখ কামালকে দেখতে পাই। আবার অন্যখানেও শেখ কামাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য দেখতে পাই। শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ সহচর ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব র আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির  চৌধুরী চমৎকার কথা আমাদের জানিয়েছেন। শেখ কামাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ উক্তি “… দেখলে হে, সবাই আসে মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে, আর তারা কিনা এসেছে কামালের সাথে দেখা করতে, আমার সাথে নয়। এই কে আছিস এখানে ওদেরকেও মুড়ি দে” (র আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ‘স্বাধীনতা গণতন্ত্র এবং সময়ের কথা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ৭৬)।

সাংবাদিক পাভেল রহমান বয়ান করেন শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুর সংলাপ। শেখ কামাল বলেন: ‘ আব্বা এর নাম পাভেল। আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার। আমি কিং কর্তব্য বিমূঢ়! বঙ্গবন্ধু কামাল ভাইয়ের কথায় বিস্মিত, ‘তোদের আবাহনীতে ফটোগ্রাফারও আছে নাকি? কামাল ভাই বললেন, হ্যাঁ আছে। ওর নাম পাভেল’ (পাভেল রহমান, স্মৃতিতে শেখ কামাল ও আবাহনী, একজন শেখ কামাল, সুজাত মনসুর সম্পাদিত, সিলেট, ২০১৮, পৃ. ৭৪)।

পুত্র শেখ কামালের জন্য বঙ্গবন্ধু  বিবাহোত্তর সংবর্ধনা উৎসবে মেহমানদের  কাছ থেকে দোয়া কামনা করেছেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম জ্ঞানশীল ব্যক্তিত্ব আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) বিষয়টা হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপন করেছেন। ছেলে শেখ কামালের জন্য বঙ্গবন্ধুর দোয়া কামনা প্রসঙ্গে জাতীয় শোকদিবস ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে অধ্যাপক আবুল ফজল লিখেছেন : মাত্র একমাস আগে ১৫ই জুলাই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা উৎসবে গণভবনের দরজায় তার সঙ্গে দেখা। এ যে শেষ দেখা তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি সেদিন। পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য গণভবনের সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

গাড়ি থেকে নেমে আমি আর ডক্টর এনামুল হক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই তিনি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর স্বাভাবিক উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলেন-

‘আপনি চাটগাঁ থেকে এসেছেন, খুব খুশি হলাম।

পাশে দাঁড়ানো ছেলের দিকে ইশারা করে বললেন-

ছেলেকে দোয়া করুন।

ছেলে শেখ কামাল জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলো আমার ও ডক্টর এনামুল হকের সঙ্গে (আবুল ফজল, শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি, বাতিঘর, চট্টগ্রাম, ২০১৬ পৃ. ৭৩)।

আমরা দেখতে পাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজপুত্র শেখ কামালের জন্য আগে যেমন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তেমনি বিবাহোত্তর সংবর্ধনা উৎসবেও অতিথিদের কাছ থেকে শেখ কামালের জন্য দোয়া কামনা করছেন।  ইতিহাস তাই বলে।

 

লেখক: সম্পাদক, প্রতিবুদ্ধিজীবী

Link copied!