সভ্য সমাজে বসবাস করার দাবি তুললেও আচার-আচরণ-সততা শিক্ষায় জাতি হিসেবে আজও আমরা অনেক পিছিয়ে। নীতির বুলি মুখে আওড়ালেও কাজের বেলায় লবডঙ্কা। সমাজে ঘটে চলছে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। একশ্রেণির মানুষ নিজেদের বেশি যোগ্য প্রমাণ করতে গিয়ে সমাজে নানা রকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে চলেছে। সেখানে শিক্ষিত ব্যক্তিরা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে অশিক্ষিতও। সরকারি চাকরিজীবী যেমন আছে, তেমনি আছে নানা পেশাজীবী মানুষও। কথা হলো সুশিক্ষিত মানুষ সমাজে কি আদৌ আছে?
বিবেক ও দায়বোধই কেন একজন ব্যক্তির জীবন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠেছে না। রক্ষকই যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের তখন আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। তারা হয়ে পড়ে অসহায়।
গত ৬ আগস্ট (শুক্রবার) দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটের দিকে মালয়েশিয়া থেকে মালিন্দা এয়ারের ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন ইমতিয়াজ মাহমুদ। কাস্টম জোনে এলে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহেল রানা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে ঢাকায় আসা যাত্রী ইমতিয়াজের গালে তিনি চড় মারেন। ঢাকা কাস্টমস হাউজ বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তী কালে আমলে নেয়। আর ওই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহেল রানাকে ৭ আগস্ট সাময়িক বরখাস্ত করে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, কোনো সরকারি কর্মকর্তা জনগণকে চড় দিতে পারেন কি? মূলত সরকারি কর্মকর্তা বা তিনি সমাজের যে পর্যায়ের মানুষই হোন, এভাবে কারও গায়ে হাত তোলার অধিকার তো নেই তার।
একটি সভ্য রাষ্ট্রের সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব হলো জনগণকে সেবা দেওয়া। এই সেবা দেওয়ার বিনিময়ে তারা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। এই দিক থেকে যদি বিবেচনা করি, তাহলে বলতে হয়, বেতন-ভাতার টাকার জোগাড় যেহেতু জনগণের পকেট থেকে হয়, সেহেতু প্রভু-ভৃত্যের হিসাব কষলে জনগণই মালিক।
বর্তমানের প্রেক্ষাপটে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, প্রজাতন্ত্রের কতিপয় কর্মচারীর মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার অভাব রয়েছে। তাই তারা কখনোই জনগণকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারে না। আরেকটা বড় কারণ হয়তো এই যে, তারা যোগ্যতা নয়, অসদুপায়ে চাকরি পায়। চাকরি পাওয়ার জন্য তদবির, ঘুষের কারবার থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই, যা তারা করে না। আর যারা এমন অসদুপায়ে চাকরি পায়, তারা পদ-পদবির জোরে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। তখন মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে গেলে তারা বিব্রত বোধ করে। তারা ভাবে এই বুঝি তাদের উচ্চতা কমে গেলো। তাই নিজেকে উঁচুতে তুলে ধরার জন্য বয়সে ছোট-বড়, পেশায় শিক্ষক থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সবার সঙ্গেই তারা ‘তুই-তোকারি’ সম্বোধন করে। আর সুযোগ পেলে মানুষের গালে চড় দিতেও দ্বিধাবোধ করে না।
দেশে যখন পরিস্থিতি এমন, তখন দেশ-জাতিকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। প্রজাতন্ত্রের যেসব কর্মচারী শিষ্টাচার মেনে চলে না, তাদের শিষ্টাচার মানতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সরকারকে এই শুভ কাজে উদ্যোগী করতে সুশীল সমাজেরও ভূমিকা রাখতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যেন কখনোই জনগণের সঙ্গে অসদাচরণ করতে না পারে, সেই বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এরপরও যদি প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী কোনো নাগরিকের গায়ে হাত তোলে কিংবা দুর্ব্যবহার করে, তাহলে তাকে তাৎক্ষণিক বরখাস্তের মধ্যেই শাস্তির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। প্রয়োজনে চাকরি বিধিমালা সংশোধন করে হলেও দায়ী কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজুর বিধান যুক্ত করতে হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক।







































