যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশে আবাসন খাতে এক নীরব বিপ্লব ঘটছে। ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে বড় বড় বেসরকারি ইক্যুইটি তহবিল এবং ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগ সংস্থাগুলো দ্রুতগতিতে আবাসন-বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনে নিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য আবাসন কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং ভাড়া এতটাই বেড়েছে যে তা সামলানোই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। এই সমস্যা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এশিয়ার অনেক দেশ, এমনকি বাংলাদেশের এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে, যেখানে অর্থনীতি ক্রমেই আর্থিক খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বাড়িওয়ালা কোনো ব্যক্তি নয়, বরং একটি বিশাল ওয়াল স্ট্রিট বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকস্টোন, যাকে বলা হচ্ছে ‘করপোরেট ল্যান্ডলর্ড’ বা ‘প্রাতিষ্ঠানিক জমিদার’।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই বেসরকারি ইক্যুইটি ফান্ডের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে ৩ লাখের বেশি ভাড়া বাসা ছিল এবং এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই প্রবণতা বাংলাদেশেও বাড়ছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় আবাসন খাতের অর্থের প্রবাহ-প্রবৃদ্ধি এবং রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বাড়বাড়ন্ত রূপ দেখে। আন্তর্জাতিক বাজার গবেষক সংস্থা স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে রিয়েল এস্টেট বাজারের আকার ছিল ২ দশমিক ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালে ২ দশমিক ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ২ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের আবাসনের বাজার ২ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মৃদু স্তিমিত হয়েছে। হিসাব মতে, ২০২৪ থেকে ২০২৮ সাল নাগাদ এই বাজার বার্ষিক ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে বাড়বে এবং বাজার দাঁড়াবে কমপক্ষে ৩ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশে করপোরেট ল্যান্ডলর্ডরা পাশ্চাত্যের মতো প্রকাশ্যে আবির্ভূত না হলেও, ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে আড়ালে থেকে বাজার দখল করছে। বাংলাদেশের ক্রমাগত ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতুষ্টি পুঁজিবাদে গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবণতাতেও বোঝা যায়, অদূর ভবিষ্যতে করপোরেট ল্যান্ডলর্ডরা সদর্পে আবির্ভূত হবে। কিন্তু এর পরিণতি কেমন হতে পারে, তা পাশ্চাত্যের আলোকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, পশ্চিমা অর্থনীতিতে একধরনের ‘প্রতি-বিপ্লব’ ঘটেছে, যেখানে শিল্প-পুঁজিবাদের বদলে রেন্টিয়ার পুঁজিবাদের জয় হয়েছে। একসময় শিল্প-পুঁজিবাদ অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছিল, কিন্তু এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল দ্রুত মুনাফার দিকে নজর দিচ্ছে, অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এরা এমন খাতে ঋণ দেয়, যা উৎপাদনশীল নয়, কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করে না। যেমন ঋণ নিয়ে কোনো কোম্পানি কিনে তার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া বা নিজেদের শেয়ার নিজেরাই কেনা। ব্ল্যাকস্টোনসহ অন্যান্য বিনিয়োগ সংস্থা আবাসন কিনে বছর বছর ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা অনেককে গৃহহীন করছে। ব্ল্যাকস্টোনের সিইও স্টিফেন শোয়ার্জম্যান, যিনি ওয়াল স্ট্রিটের সর্বোচ্চ বেতনভোগী সিইও, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম প্রধান অর্থদাতা ছিলেন। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ধনীদের জন্য কর কমানোর যে নীতি গ্রহণ করেন, তা শোয়ার্জম্যানের মতো বিলিয়নিয়ারদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হয়েছে। কিন্তু এর ফলে ব্ল্যাকস্টোনের মতো অন্য বিনিয়োগ সংস্থার আবাসন কিনে নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছরই গৃহহীনতায় হাজারও মানুষ যোগ হচ্ছে। ২০০৭-২০২৪ সময়কালে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ওঠানামা করলেও ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে ৭ লাখ ৭১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
অপর দিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অঞ্চল ইউরোপের ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংজ্ঞার ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে গড়ে মোট জনসংখ্যার প্রায় শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষই গৃহহীন। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এরা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো, জরুরি বা অস্থায়ী আশ্রয়ে থাকা, কোনো প্রতিষ্ঠানে বসবাস করা, অপ্রচলিত বাসস্থানে থাকা অথবা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের আশ্রয়ে থাকা মানুষ এবং এদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সরকারের ভূমিকা ও করপোরেট সহায়ক নীতি এবং ধনীদের তুষ্ট করার সব আয়োজন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করপোরেট ল্যান্ডলর্ডদের উত্থানে সহায়তা করছে এবং গৃহহীনের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর ওয়াল স্ট্রিটের কারণেই লক্ষাধিক মানুষ তাদের বাড়িছাড়া হয়। এরপর সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলো আবাসন খাতের সংকট মোকাবিলায় বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের প্রবেশ সহজ করে দেয়, যা ছিল এই করপোরেট ল্যান্ডলর্ডদের উত্থানের জন্য মহা এক সুযোগ। ক্যালিফোর্নিয়ার কংগ্রেস সদস্য রো খান্না ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, “নথিভুক্ত-অনথিভুক্ত নাগরিকের করের টাকা ওয়াল স্ট্রিটকে বাড়ি কিনতে সাহায্য করছে, যা খুবই অন্যায়।” ওয়াল স্ট্রিটের এই আগ্রাসন কেবল শহরকেন্দ্রিক নয়। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়াল স্ট্রিট বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের শার্লট, নর্থ ক্যারোলিনার মতো ছোট ছোট পাড়ার প্রায় সব বাড়ি কিনে নিয়েছে। একটি পাড়ায় ৩৪টি বাড়ির মধ্যে ৩৩টিই এখন বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন। তারা পুরোনো বাড়ি কিনে সামান্য সংস্কার করে উচ্চমূল্যে ভাড়া দিচ্ছে বা বিক্রি করছে। এসব বাড়ি মূলত মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনো জনগোষ্ঠীর এলাকায় অবস্থিত। ফলে এই জনগোষ্ঠী ক্রমেই তাদের নিজেদের বাড়ি কেনার ক্ষমতা হারাচ্ছে, রাস্তায় গিয়ে থাকছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসেই দিন কয়েক আগেই ওয়াশিংটনের গৃহহীন মানুষকে ‘নর্দমা কীট’ উল্লেখ করে তাদের রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেছেন এবং প্রয়োজনে মেরিন সেনা নামানোর হুমকি দিয়েছেন। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্প, যিনি নিজেও একজন প্রধান ল্যাল্ডলর্ড; আসলে করপোরেট ল্যান্ডলর্ডদের জন্য মাঠ পরিষ্কার করছেন, যাদের প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্পেনের মাদ্রিদেও যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ সংস্থাগুলো বাড়ি কিনছে। ব্ল্যাকস্টোন শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাড়িওয়ালা এবং মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত আবাসন মালিক। মাদ্রিদে তাদের ১৩ হাজারের বেশি এবং পুরো স্পেনে প্রায় ২০ হাজার ভাড়া ইউনিট রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে স্পেনে বাড়ি ভাড়া ৫৭ এবং বাড়ির দাম ৪৭ শতাংশ বেড়েছে এই ল্যান্ডলর্ডদের সুবাদে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও একই পরিস্থিতি।
বাংলাদেশে করপোরেট ল্যান্ডলর্ড প্রসারের প্রবণতাও দিন দিন বাড়ছে, যা আবাসন খাতের প্রতি সরকারের সহায়ক নীতি, বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থার ঋণের পরিমাণ, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাপক অর্থপ্রবাহ, কালোটাকার বিস্তার এবং বছর বছর বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির ধরন বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়। চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো আবাসন কোম্পানি গড়ে ওঠাও ল্যান্ডলর্ড বৃদ্ধির অন্যতম প্রমাণক। এর কারণে দেশের ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের উপার্জিত অবৈধ অর্থ বা কালোটাকা এই খাতের বিকাশের শুরু থেকেই সব সময় সবচেয়ে বেশি হারে বিনিয়োগ করে আসছে। তবে বিগত দশকে এই ত্রিরত্নের দেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগের প্রবণতাটি দিক বদলে বিদেশমুখী হয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচারের সহজ পথ চিনিয়ে দেওয়ার প্রভাবে। তবে ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভাঙে’, তেমনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ নানাভাবে উপার্জিত অবৈধ ও কালোটাকা বিদেশে পাচার হয়ে বিশ্বের নানা দেশের আবাসন খাতেই বিনিয়োজিত হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের একজন প্রতিনিধির লন্ডনে ৩০০ শতাধিক বাড়ি থাকার প্রমাণে খোদ ইংল্যান্ডের রাজাও বিস্মিত হয়েছেন। অপর দিকে এখন ২০২৪ সালের আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ-আমলার আত্মগোপন এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অপ্রদর্শিত অর্থ নামের কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ হওয়ায় এই খাতটিতে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছে এবং কমবেশি ৩৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়া এ খাতের লোকজনকে বেতন দেওয়াটাই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের মতো জরুরি উৎপাদনশীল খাত যেখানে অর্থের অভাবে মাথা কুটে মরেছে, সেখানে আবাসন খাতের মতো অনুৎপাদনশীল খাতের বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি বহুমাত্রিক বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধির অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এই খাতে কালোটাকার পাশাপাশি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ঋণ দিয়েছে দেদার, যার অধিকাংশই এখন খেলাপি।
বাংলাদেশে ল্যান্ডলর্ড সংস্কৃতির প্রসার মূলত শুরু হয়েছে আবাসন খাতে কালোটাকা পার্কিংয়ের নিরাপদ আশ্রয় বানানোর মাধ্যমে, যা ব্যাংকের জামানতনির্ভর ঋণ-প্রণোদনা ও বারবার শিথিল ও পুনঃ তফসিলের ফলে শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। এখানে ঘোষণাবহির্ভূত আয় ফ্ল্যাট-জমিতে ঢুকে যায়, বিক্রি মন্থর হলেই ঋণের কিস্তি প্রদান থেমে যায়। ফলে ঋণ শ্রেণিকৃত হয় এবং কিস্তি শিথিল ও পুনঃ তফসিল, প্রণোদিত হয়। এতে শক্তিশালী মালিকগোষ্ঠী ভাড়া-আয়ের ওপর নির্ভরশীল ল্যান্ডলর্ড-অর্থনীতিতে তার অবস্থান আরও স্থায়ী করে নেয়। আবার রড-সিমেন্ট-অমুক-তমুক অজুহাত দেখিয়ে আবারও সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন করে ঋণ অনুমোদনে বাধ্য করে। খেলাপি হয়, আবারও ঋণ নেয়, আবারও মেরে দেয়। এভাবে দুষ্টচক্রটি চলতে থাকে এবং আরও শক্তি অর্জন করে। ২০২৪ সালে আবাসন ঋণের স্থিতি প্রায় ১.২৮৩ ট্রিলিয়ন টাকা হলেও জুলাই-আগস্টের ঝড়ের কবলে পড়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৭.৫১ শতাংশ, যা এই খাতের উৎস ও পরিপুষ্ট হওয়ার কারণটি ষ্পষ্ট করে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ ১৬.৯ শতাংশ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪-এ ২০.২ শতাংশে লাফ দেওয়া এ কথাই বলছে, সম্পদ-মূল্যায়নের ফুলানো চর্চা ও নগদ অগ্রিম-হাওলা লেনদেনের ওপর দাঁড়ানো আবাসন প্রকল্পের ‘ডিফল্ট প্রণোদনা’ এবং কালোটাকা-ঋণখেলাপিদের মধ্যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে। এই করপোরেট ল্যান্ডলর্ডরা এতই শক্তিশালী যে অন্তর্বর্তী সরকারও তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে কালোটাকা সাদা করার বিধান রাখতে বাধ্য হয়, যা তীব্র সমালোচনার মুখে ২০২৫ মাসের জুনে বাতিল হয়। তবে ১৯৮০-এর দশকে শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে চলা এই কালোটাকা শক্ত ভিত্তি দিয়েছে আবাসন খাতের বিস্তারে। অথচ নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য দীর্ঘকালীন কিস্তিতে আসাবনের ব্যবস্থা করা হলে এই খাতটি আজকে এমনতর দুর্দশায় পড়ত না। তবে করপোরেট না হলেও ঋণখেলাপি ও কালোটাকার ছদ্মাবরণে সৃষ্ট দেশীয় ল্যান্ডলর্ডদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কারণ এখনো আড়ালে-আবডালে অনেক নীতি-সুবিধা রয়ে গেছে, অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ধরার নীতির শিথিল প্রয়োগই যার প্রমাণ।
অন্তর্বর্তী সরকার তার দীর্ঘমেয়াদি বদনাম এড়ানোর চেষ্টা করাতে সর্বোত মুনাফাকামী প্রাতিষ্ঠানিক জমিদাররা এখন হয়তো বেকায়দায় আছে। কিন্তু দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বলছে, অচিরেই তাদের সুদিন ফিরে আসবে, আমলা-রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীরা আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের শক্তি জোগাবে। আর তাছাড়া যেহেতু শহর-উপশহরের আবাসন বাজারে ভাড়ানির্ভর মালিকানা, লালফিতার প্রকল্প, জমি-ফ্ল্যাটের ওপর কর ও রেজিস্ট্রি, মূল্যবাজার ও মূল্যের ফাঁক এবং সম্পদ ও সঞ্চয়ের বহুমুখী ধারা সৃষ্টি হচ্ছে, সেহেতু বলা যায় বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক জমিদারির সংস্কৃতিও পাশ্চাত্যের মতোই দ্রুতই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে। তবে মনে রাখা উচিত, অনুৎপাদনশীল এই বিনিয়োগ-বিস্তার উৎপাদনশীলতাকে ঠেলে দেবে আড়ালে এবং ঋণখেলাপি ঝুঁকিকে ঠেলে দেবে ওপরে। ফলে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে এবং সমাজে বহুমাত্রিক বৈষম্য আরও গভীরতর হবে। আর বৈষম্যপূর্ণ সমাজ যে কখনোই টেকসই হয় না এবং তার পতন যে অনিবার্য, তা গ্লোবাল সাউথের উত্থান ও পাশ্চাত্যের ক্যানসারে আক্রান্ত অর্থনীতি দেখে অনুধাবন করতে হবে।
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়