• ঢাকা
  • রবিবার, ১২ মে, ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ৩ জ্বিলকদ ১৪৪৫

লোডশেডিংয়ে ম্লান শতভাগ বিদ্যুতায়ন


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২২, ০২:৫০ পিএম
লোডশেডিংয়ে ম্লান শতভাগ বিদ্যুতায়ন

দিনভর ব্যস্ততা শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু ওদিকে বিদ্যুৎ নেই অথবা হুট করে চলে গেছে—এমনটা এখন পরিচিত ঘটনা। ‘লোডশেডিংকে জাদুঘরে’ পাঠানোর যে প্রচারণা শুনেছিলাম কিছুদিন আগেও, সেটা এখন ফিকে হয়ে গেছে। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণবিষয়ক বাগাড়ম্বরও পানসে। লোডশেডিংয়ের যুগ ফিরেছে আবার। সংকট আগের চেয়ে ভয়াবহ হয়তো। আশাবাদের বাণী শোনান হচ্ছে ঠিক, কিন্তু সেগুলোতে আস্থা রাখা যাচ্ছে না।

কিছুদিন আগে ভয়াবহ গ্রিড বিপর্যয় ঘটেছিল। প্রাথমিক অবস্থায় জানা যাচ্ছিল কারিগরি ত্রুটি। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটির প্রতিবেদন জানাচ্ছে কারিগরি ত্রুটি নয়, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে এই গ্রিড বিপর্যয়। দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) একাধিক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, সন্দেহ করা হচ্ছে বিতরণ কোম্পানির আরও অনেককে। জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক আলোচনায় অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘গ্রিড বিপর্যয়ের পর আমরা কতগুলো মানুষকে আইডেন্টিফাই করেছি, যারা কথাগুলো শুনতে চেষ্টা করেনি। এদেরকে আমরা স্যাক করব। এটা কোনো টেকনিক্যাল ফল্ট ছিল না, ম্যানেজমেন্ট ফল্ট ছিল।’ গ্রিড বিপর্যয়ের পর প্রতিমন্ত্রী তাৎক্ষণিক দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, তবে ওই দুঃখ প্রকাশ ছিল তার যথাযথ পরিষেবা নিশ্চিত না করার কারণে। এবার কি ফের দুঃখ প্রকাশ করবেন সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলাজনিত ভোগান্তির কারণে? করা তো উচিত। বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সংশ্লিষ্টদের, এখানে অন্যথা মানে ব্যর্থতা। ব্যর্থতায় যদি দায়িত্বে অবহেলার যোগ থাকে, তবে সেটা ভয়ংকর। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান হিসেবে এ জন্য প্রতিমন্ত্রীর জবাবদিহি করা উচিত। তার উচিত হবে দায়িত্বে অবহেলাজনিত ব্যর্থতা স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়া।

সাম্প্রতিক লোডশেডিংয়ের কারণ কী? অন্য সবকিছুর জন্য যেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারের কথা বলা হয়, এটাও তেমনই। এ যেন সেই গরুর রচনা। ছাত্র গরুর রচনা শিখে গেছে, কিন্তু পরীক্ষায় এসেছে ঘোড়ার রচনা। কী আর করা! ঘোড়াকে গরু বানিয়ে লিখে ফেলা সারা; জায়গামতো কেবল বিশেষ্য বদল। দেশ কি চলছে এভাবে? চলবে কি? অথচ ভোক্তাসাধারণ হিসেবে এটা অপ্রত্যাশিত। ভোক্তা বিদ্যুৎ ব্যবহার শেষে তার দাম পরিশোধ করছে। সাধারণ ভোক্তা যারা তাদের বিদ্যুৎ বিল দীর্ঘদিন বকেয়া থাকার সুযোগ নেই। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এখানে বাদ-প্রতিবাদের সুযোগ নেই। নিয়মবহির্ভূত কিছু ঘটলে আইনি ঝামেলার মুখেও পড়তে হয়। তবু কেন নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাবে না? বিদ্যুৎ যখন জরুরি পরিষেবা তখন তার নিশ্চয়তা প্রদান করা সরকারের দায়িত্ব।

আমাদের চেনাজানা একটা বাক্য আগে বিদ্যুৎ যেত না মাঝে মাঝে আসত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ের বিদ্যুতের দুরবস্থার কথা স্মরণ করতে আমরা এটা বলে থাকি, সরকারি দল আওয়ামী লীগও বলে থাকে। এটা কেবল অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, জাতীয় সংসদেও এমন কথা রেকর্ড হয়ে আছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সেক্টরে সরকারের সাফল্যের দাবি করতে লোডশেডিংকে জাদুঘরে পাঠানোর দাবিও আমরা শুনেছি। সেগুলো বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। তবু এত কম সময়ের মধ্যে সাফল্যের সূচকের এমন অত্যাশ্চর্য অবনতি আমরা দেখলাম, দেখছি, দুর্ভোগে কাটাচ্ছি। কেন?

বিশ্ববাজার ও জ্বালানি তেলের কথা বলা হয়, কিন্তু জ্বালানি তেল নিয়ে সরকারের মধ্যে কি কোনো প্রস্তুতি ছিল না, পরিকল্পনা কি ছিল না? কেন থাকবে না? যখনই দুর্যোগ তখন থেকেই মোকাবেলার চেয়ে দুর্যোগ মোকাবেলার পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া কি জরুরি নয়? আমরা যারা ভোক্তা তাদের দায়িত্ব বিশ্ববাজার পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্থিতিশীল অবস্থা  নিয়ে গবেষণা নয়। ভোক্তার চাই নিরবচ্ছিন্ন সেবা, যার দাম সময়মতো সে পরিশোধ করবেই; করতে বাধ্যও বলা যায়।

দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন নিয়ে বিশ্ববাজারের গল্প শোনানো হয়, তেল-গ্যাসের দাম নিয়েও একই কথা শোনানো হয়। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়েও একই কথা। শুরুতে আমরা মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু এই সমস্যা দীর্ঘায়িত হওয়ায় এখন মেনে নেওয়ার পরিস্থিতি নেই। এখন মনে হচ্ছে সমূহ ব্যর্থতায় যখন একটাই বাক্য তখন প্রমাণ হয় সমস্যা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সরকার যখন সবকিছুতে মুখস্থ বুলি আওড়াচ্ছে তখন এটা স্রেফ ‘অজুহাত’ ছাড়া আর কিছু নয়। সাময়িক সমস্যায় নানা কারণ উল্লেখ হতে পারে, কিন্তু সমস্যা যখন স্থায়ী আকার ধারণ করে তখন সেই কারণগুলোকে সহজভাবে নেওয়ার সুযোগ কমে আসে। প্রমাণ হয় সমস্যার সমাধানে অক্ষমতার বিষয়টি। বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অক্ষমতার দিকটি আমরা দেখেছি, সয়ে যাচ্ছি; একই ঘটনা ঘটতে চলেছে বিদ্যুৎ খাতে। এখানেও বুঝি প্রতিকারহীন সক সমস্যা!

বলতে দ্বিধা নেই, বিদ্যুৎ নিয়ে কিছু সাফল্যের গল্প আছে সরকারের। শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসেছে দেশ। এ জন্য সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারে। কিন্তু শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর যদি প্রয়োজনীয় সেবা না দেওয়া যায়, তবে সেই সাফল্য আড়ালে পড়ে যায়। এখন সেটাই হয়েছে।

শুরুতে রাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম, বিদ্যুতের ভোগান্তি কেবল রাতেই নয়, চলছে পুরো দিনেও। লোডশেডিং-যুগে ফের প্রবেশের সময়ে বিদ্যুৎ বিভাগ লোডশেডিংয়ের এলাকাভিত্তিক সূচি দিয়েছিল। সেটাও ব্যর্থ হয়েছে। ঘণ্টার হিসাবের  লোডশেডিং দিনের অর্ধেক কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি সময় ধরে চলছে। রাজধানী এবং বিভাগীয় শহরগুলোই কেবল নয়, সারা দেশের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে। লোডশেডিংয়ের এলাকাভিত্তিক সময়সূচিও ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আশা দেখছি না। আক্ষেপে শুধু প্রশ্ন করি—কত দিন চলবে এভাবে?

দ্রব্যমূল্য কিংবা বিদ্যুৎ, সবখানে প্রতিকারহীন ব্যর্থতা সত্ত্বেও বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ না হওয়ায় সরকার হয়তো স্বস্তিতে, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাষা ভিন্ন। প্রতিবাদ যখন প্রকাশ্য হচ্ছে না, তখন ঠিকই অন্তরে শাণিত হচ্ছে সমূহ ক্ষোভ। অব্যক্ত এই প্রতিবাদ নির্বিবাদী চরিত্রের হলেও ভয়ংকর; যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের জন্যই ভয়ংকর!

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

Link copied!