• ঢাকা
  • রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ জ্বিলকদ, ১৪৪৪

চুল-গোঁফ কাটার জবরদস্তি


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২১, ০১:৫৭ পিএম
চুল-গোঁফ কাটার জবরদস্তি

হাটবাজার-পার্ক কিংবা এখান-সেখান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে যুবক অথবা অনতিতরুণকে যখন কোনো পুলিশ সদস্য চুল কেটে দেয়, তখন এই ঘটনাকে বাহবা দেওয়ার অনেক লোক পাওয়া যায়। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। এর কিছু সংবাদ হয়, কিন্তু বড় ধরনের খবর হয়ে ওঠে না এটা। পত্রিকার কোনো এক জায়গায় এক কিংবা দুই কলামের মধ্যেই আটকা থাকে সে খবর। অনলাইন গণমাধ্যমেও সচরাচর এটা প্রধান সংবাদ হিসেবে প্রকাশ পায় না, এটাও মফস্বল সংবাদ; যে সংবাদগুলো আড়ালে পড়ে থাকে।

তবু এ নিয়ে কিছুটা হলেও মাতামাতি হয়, অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। খবরের শিরোনাম দেখে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজে একশ্রেণির মানুষ সমর্থন করে, একটা শ্রেণি এর একটা প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করে। তবে প্রতিবাদকারী সংখ্যার হিসাবে অল্প। অল্প সংখ্যার প্রতিবাদকারী আবার এই প্রতিবাদ যতটা না করে প্রকাশ্যভাবে, তার চেয়ে বেশি অন্তর্গত। তাই তার প্রকাশ লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে থাকে। আর সমর্থক শ্রেণির সমর্থন প্রকাশ্য হওয়ায় মনে হয় এ ধরনের কর্মকাণ্ডগুলোর সমর্থক সারা দেশে, সব শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে; ব্যাপকভাবে।

আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি, চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলি; বলাই সংগত। কারণ, এগুলো মৌলিক এবং মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বেঁচে থাকার বিশেষত নিজের মতো করে বেঁচে থাকার যে স্বাধীনতার কথা বিশ্বস্বীকৃত, সেটা মেনে নিতে রাজি নই। এই চুল কাটা কিংবা চুল কাটতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে মানুষের স্বাধীনতাকে হরণ করার যে অপচেষ্টা, সে বিষয়টি স্রেফ এড়িয়ে যাচ্ছি, উড়িয়ে দিচ্ছি। অথচ এ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়া জরুরি ছিল আমাদের। কারণ, দৃশ্যমান এই ছোট্ট ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে বিস্তৃত পরিসরে আমরা অন্যের স্বাধীনতা হরণের পথে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছি।

জোরপূর্বক অন্যের চুল কেটে দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এটা অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। উদাহরণ ভূরি ভূরি। স্মরণশক্তি দুর্বল হলেও সমস্যা নেই, ইন্টারনেট সার্চে এমন অনেক ঘটনার চিত্র ওঠে আসবে। সম্পত্তির ভাগ চাওয়ায় স্কুলশিক্ষিকার চুল কাটা, পুত্রবধূর চুল শ্বশুর-শাশুড়ি কর্তৃক কেটে দেওয়া, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর চুল কাটা, শিক্ষক ছাত্রের, মারধরের পর শিশুর, বাউলদের চুল-গোঁফ কাটার এমন অনেক সংবাদ প্রায়ই দেখা যায়। এই যে জবরদস্তি এর অধিকার এদের কারও না থাকলেও সমানে করে যাচ্ছে, এবং খুব বেশি আলোচনা হয় না হলে প্রতিকারহীন সব।

সাম্প্রতিক যে চুল কাটার আলোচনা বিভিন্ন মাধ্যমে ঝড় তুলেছে, সেটা সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বোর্ডের সদস্য ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন ১৪ জন শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ করেছে, শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কারের আগে ওই শিক্ষক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। ঘটনা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। শিক্ষার্থীদের চুল কাটার এই ঘটনায় হাইকোর্টেও রিট হয়েছে। হাইকোর্ট ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন। ১৪ শিক্ষার্থীকে ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না জানতে চেয়েছেন আদালত। পাশাপাশি দেশে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে একটি গাইডলাইন তৈরিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চান হাইকোর্ট। কেবল উচ্চ আদালতই নয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথাও বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসিকে। এত কিছু ঘটছে এরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বলে! 

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, অভিযুক্ত শিক্ষক তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে অস্বীকার করেছেন। তিনি এখানে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত বিষয়টি অভিযোগ পর্যায়ে থাকার কারণে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাচ্ছে না, তবে জোরপূর্বক চুল কাটার যে অভিযোগ এবং এর বিরুদ্ধে সামাজিক যে প্রতিরোধ আর সেখান থেকে উচ্চ আদালত প্রতিকারে গাইডলাইন তৈরির যে প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, এটা ইতিবাচক। এবার অন্তত একটা ঘটনার কারণে নিপীড়নের এ ঘটনাকে মানবাধিকার পরিপন্থী বলে আওয়াজ ওঠার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আওয়াজ উঠল। নেতিবাচক ঘটনায় সত্ত্বেও মানবাধিকারের স্বীকৃতিসহ প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার যে আলোরেখা এটা ইতিবাচক নিঃসন্দেহে।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়— শিক্ষাব্যবস্থার ধাপগুলোতে শিক্ষা ও শিক্ষণ পদ্ধতি স্বাভাবিকভাবেই এক নয়। পর্ব ও পর্যায়ের স্বাতন্ত্র্যের সূক্ষ্ম দিক এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থান একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের আমলে নেওয়া জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোনো শিক্ষক তার পছন্দ-অপছন্দের কথা জানাতে পারেন, কিন্তু কাঁচি হাতে দাঁড়াতে যাওয়া তার জন্য মোটেও শোভনীয় নয়। আর কাঁচি চালানোর যে অভিযোগ, সেটা যোগ্যতার পাশে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেওয়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানিক অবস্থান ধর্তব্যের নয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতই বিশ্ববিদ্যালয় এটা মনে রাখা জরুরি।

এই তো কিছুদিন আগেও বগুড়ার শিবগঞ্জে মেহেদী হাসান নামের এক শিশু বাউলশিল্পীর মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এক স্কুলশিক্ষক ও দুইজন গ্রাম্য মাতব্বর। ঘটনার পর পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছে সত্য, এবং এই প্রক্রিয়া বিচারিক ধাপের কত দূর পৌঁছাবে, এ নিয়ে বাস্তবতার আলোকে আমরা সন্দিহান। কারণ, বাউলদের ওপর এ ধরনের নিপীড়ন নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও নানা সময়ে রাজবাড়ী, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাটসহ অনেক জায়গায় বাউলদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। ওই সব ঘটনা যতখানি আলোচনা হওয়ার কথা, ততখানি হয়নি। প্রতিবাদ হয়নি উল্লেখের মতো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাতে গোনা কজনের প্রতিবাদ সব জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। উপরন্তু বিভিন্ন জায়গায় সেই সে একটা শ্রেণির মানুষের সহজাত সমর্থন প্রকাশ্য হয়েছিল পুনর্বার। ফলে জোর করে চুল-গোঁফ কাটাসহ শারীরিক সেসব নির্যাতন যে অপরাধ সেই বার্তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ এটা জরুরি ছিল।

পুলিশের কিছু সদস্য, নারী-শিশুর ওপর নির্যাতনকারী, বাউলবিদ্বেষী, এবং অদ্যকার শিক্ষার্থীদের চুল কর্তনকারীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির এই লোকজনেরা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করতে চুল-গোঁফ কাটার যে কাজগুলো করে থাকে, এটা একশ্রেণির মানুষের কাছে ব্যাপক সমর্থন পায়। এটা জনপ্রিয় ধারার বলে অন্যেরা এখান থেকে অযাচিত পুলক অনুভব করে, নিজেরাও উদ্বুদ্ধ হয়। এ জন্য চুল কাটার মতো ঘৃণ্য এই ঘটনাগুলোকে নজিরবিহীন বলা যায় না, চলমান। এ থেকে উত্তরণ দরকার আমাদের।

বারবার—বাংলায় হয়, উচ্চারণে ইংরেজিতেও হয়। বাংলায় যা পুনর্বার, ভাষান্তরে ক্ষৌরকার। পেশাজীবীদের স্বাভাবিক পেশায় কারও আপত্তি নেই, এদিকে সময়ে-সময়ে অপেশাদার ক্ষৌরকার সাজে অনেকেই, এবং সেটা বারবার। থানার ওসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কিংবা বাউলবিদ্বেষী লোকজন; সবার চোখ এক জিনিসে, ওই চুলে। ভবিষ্যতে এরা ভুলেও যাতে এই দিকে হাত না বাড়ায়, তার দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে। তা না হলে সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে। রাষ্ট্র নিশ্চয়ই তার দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হবে!

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!