• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

পাঁচ সিটিতে সুষ্ঠু ভোটের পরিকল্পনা আ.লীগের


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৩, ০৯:৫৮ পিএম
পাঁচ সিটিতে সুষ্ঠু ভোটের পরিকল্পনা আ.লীগের

গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট এই পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সরাসরি অংশ নেবে না ধরে নিয়েই নানা পরিকল্পনা হাঁটছে টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি পাঁচ সিটি ভোটে না এলে জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের। তাই ভোট যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে চায় সরকারি দলটি।

অপরদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তাদের আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়ার কথা বলছে। এমন পটভূমিতে পাঁচ সিটির নির্বাচন কোন মডেলে করা হয়, সেদিকেই নজর থাকবে সবার। এই বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে বলছেন। এতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করতে সক্ষম এটা দেখানোর একটি চেষ্টা থাকবে সরকারের।

আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বলছেন, গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এই পাঁচ সিটির নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য তাদের দল ইসিকে সর্বাত্মক সহায়তা করার অবস্থান নিয়েছে। ভোট খুবই সুষ্ঠু হবে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে। বিএনপি ভোটে অংশ নিলে ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।

দলটির বেশ কয়েকজন সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরোধীদের দাবি কোনোভাবেই মানবে না আওয়ামী লীগ। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলও বলে আসছে। এর আগে দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের ভোটেও সংঘাত, অনিয়মের অভিযোগ ছিল। এ পরিস্থিতিতে পাঁচ সিটি নির্বাচনে ভালো ভোটের ‘দৃষ্টান্ত’ হিসেবে দেখানোর চিন্তা সরকার এবং আওয়ামী লীগের ভেতরে রয়েছে। তবে নির্বাচন যা-ই হোক, দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশ পরীক্ষায় পড়তে হবে বলে মনে করছেন নেতারা। বিশেষ করে গাজীপুর ও সিলেট সিটি করপোরেশনে দলীয় প্রার্থী নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে আওয়ামী লীগ। বাকি তিন সিটিতে হয়ত বর্তমান মেয়রকেই পুনরায় দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।

সম্প্রতি বিএনপির ছেড়ে দেওয়া জাতীয় সংসদের আসনের উপনির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। বিএনপি ভোটে না এলে ভোটারের উপস্থিতি কমে যাবে, এটা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা আছে আওয়ামী লীগের। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট না হওয়ায় ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এমন একটি অভিযোগ চলে আসছে অনেক দিন ধরে।

এ পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি যাতে বেশি হয়, সেই চিন্তাও থাকবে আওয়ামী লীগের। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলর প্রার্থীর ওপর নির্ভর করতে চায় দলটি। প্রয়োজন হলে কাউন্সিলর পদে দলীয়ভাবে প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এরইমধ্যে রোববার (৯ এপ্রিল) থেকে ধানমন্ডিস্থ দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ।

গাজীপুর-সিলেট মূল চ্যালেঞ্জ

গাসিক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়রের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় পুনরায় দলে ফিরেছেন। তিনি মেয়র পদ পেতেও তৎপর। এখন গাজীপুরে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জাহাঙ্গীর হবেন নাকি নতুন কেউ, এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ। তবে দলের প্রভাবশালী একটি অংশ জাহাঙ্গীরকে পুনরায় মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে তৎপর আছে। কিন্তু অন্য অংশের মত হচ্ছে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার পর আবার তাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হলে ভুল বার্তা যাবে।

এ ক্ষেত্রে তারা গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানকে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে। আজমত উল্লা ২০১৩ সালে বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরে যান। এর পরেরবার জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত মেয়র হন প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমান (কিরন)। তবে তার ১৫ মাসের দায়িত্ব পালনের সময় নিয়ে দলের উচ্চপর্যায় সন্তুষ্ট নয়। ফলে তার মেয়র পদে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

দলীয় সূত্র বলছে, দল হয়ত আজমত উল্লাকে আরেকবার সুযোগ দেবে। তবে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে দলীয় কোন্দল আবারও মাথাচাড়া দেবে। অর্থাৎ আজমত উল্লা বা জাহাঙ্গীর যাকেই প্রার্থী করা হোক না কেন, পূর্ণ শক্তি নিয়ে দল মাঠে নামতে পারবে না। অবশ্য বিএনপি ভোটে অংশ না নিলে সমস্যা হবে না। গত নির্বাচনে পাঁচ সিটির মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হলেও সিলেটে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোট করে জয়ী হন বিএনপির আরিফুল হক। প্রয়াত বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে হারিয়ে তিনি টানা দ্বিতীয়বার মেয়র হন।

এবার সিলেটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে ইচ্ছুক ৯ নেতা। তবে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিয়ে আলোচনা বেশি। তার প্রতি দলের উচ্চপর্যায়ের বিশেষ বিবেচনা আছে। প্রার্থী হতে কয়েক বছর ধরে তৎপর সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ।

দলীয় সূত্র মতে, সিলেটে প্রবাসী বনাম দেশি প্রার্থী এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আনোয়ারুজ্জামানকে ‘অতিথি’ রাজনীতিক মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ জন্য আনোয়ার ছাড়া স্থানীয় যে কাউকে মনোনয়ন দিলে এক হয়ে কাজ করার বার্তা দিয়েছেন অন্য প্রার্থীরা। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির আরিফুল হক এবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন নেতারা।

এ বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “বহিষ্কার হওয়ার পর গাজীপুর মহানগরের রাজনীতি জাহাঙ্গীর আলমের হাতে নেই। দল পুরোপুরি আজমত উল্লার নিয়ন্ত্রণে। আবার এলাকায় জাহাঙ্গীরের একটা প্রভাব ও নানামুখী যোগাযোগ রয়েছে।”

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, “বড় দলে অনেক প্রার্থী থাকা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে জয়ী হতে পারবেন—এমন প্রার্থীকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। আর দল মনোনয়ন দিলে তাকে জয়ী করতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকবেন।”

খুলনা, বরিশাল, রাজশাহীতে প্রার্থী বদলের সম্ভাবনা কম

রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। কারণ, ইতোমধ্যে তিনি নগর উন্নয়নের মাধ্যমে বেশ শক্ত অবস্থানে আছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীরও সদস্য। জাতীয় রাজনীতিতে তাকে আরও বড় দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা না থাকলে তিনিই আবার মেয়র পদে প্রার্থী থাকবেন বলে দলের নেতারা মনে করছেন। খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক একাধিকবার মেয়র হয়েছেন। সেখানে মনোনয়ন পেতে অন্য কোনো নেতার তেমন কোনো জোরালো তৎপরতা নেই।

দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান মেয়রদের মধ্যে মাঠের জরিপে সবচেয়ে পিছিয়ে বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। সেখানে দলীয় কোন্দলও প্রকট। বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের সঙ্গে মেয়রের দ্বন্দ্ব বরিশালের সর্বস্তরে আলোচিত। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেনের (হিরণ) অনুসারীদের কেউ কেউ ভেতরে-ভেতরে সাদিক আবদুল্লাহর বিপক্ষে। এছাড়া সাদিক আবদুল্লাহর আপন চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন। তার দলীয় পদ নেই। তবে তার প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিশেষ সহানুভূতি আছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার সময় তার ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের বেশ কয়েকজন হত্যার শিকার হন। তবে পুরো বরিশাল বিভাগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাব রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর। এতে তার ছেলে সাদিক আবদুল্লাহর সম্ভাবনা বেশি দেখছেন দলের নেতারা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “প্রতিটি নির্বাচনেই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সম্ভাব্য প্রার্থীদের জরিপ করে থাকেন। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা ও দলে গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করা হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। ভোট খুবই সুষ্ঠু হবে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। বিএনপি ভোটে অংশ নিলে ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।”

ইসি ঘোষিত তফসিল অনুসারে, আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ হবে। খুলনা ও বরিশালে ভোট হবে আগামী ১২ জুন। আর ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

রোববার থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। এই কার্যক্রম চলবে বুধবার (১২ এপ্রিল) পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। এ ছাড়া ৩টি উপজেলা পরিষদ ও ৫টি পৌরসভা নির্বাচনেরও মনোনয়ন ফরম বিক্রি চলছে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।

Link copied!