• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,
তাপপ্রবাহের এক মাস

দুঃসহ কষ্টে দেশের ১২ কোটি মানুষ


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০২৪, ০১:০২ পিএম
দুঃসহ কষ্টে দেশের ১২ কোটি মানুষ
তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। ছবি: সংগৃহীত

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রাও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। আবহাওয়াবিদরা এপ্রিল মাসকে ভয়ংকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গত ৩১ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত টানা তাপপ্রবাহ চলছে দেশজুড়ে। কোথাও মৃদু, কোথাও তীব্র, কোথাও অতি তীব্র তাপপ্রবাহে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। দুঃসহ কষ্ট আর বিপদে রয়েছেন দেশবাসী।

বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মাত্র ৭৬ বছরের আবহাওয়ার তথ্য সংরক্ষণ রয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, দেশের বড় অংশজুড়ে টানা ২৯ দিন তাপপ্রবাহ ছিল না সেই ইতিহাসে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসেই প্রথমবারের মতো অতি উষ্ণতার কবলে পড়ল দেশের বড় অংশ। গত বছরে টানা ১৬ দিন ধরে তাপপ্রবাহ চললেও এবারে সেই রেকর্ডের দ্বিগুণ সময় জুড়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। যাতে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে, গত এক সপ্তাহে সারা দেশে হিটস্ট্রোকে ১০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন আরও পাঁচজন। মারা যাওয়া ১০ জনের মধ্যে দুজন মাদারীপুরের। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, হবিগঞ্জ, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলায় একজন করে মারা গেছেন।

তথ্যমতে, দীর্ঘ ছুটি শেষে গত রোববার (২৮ এপ্রিল) প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুললেও উপস্থিতি ছিল তুলনামূলকভাবে কম। তবে প্রচণ্ড গরমে সারা দেশের স্কুল, কলেজের বহু শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যেই আবার হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও রেকর্ড হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (২৯ এপ্রিল) দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়, ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীতে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদিও আবহাওয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছে গিয়েছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

ইতোমধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে সবচেয়ে কষ্ট আর বিপদে আছেন সারা দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষ। যাদের বড় অংশ প্রচণ্ড গরমের কারণে ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না, দৈনন্দিন কাজও করতে পারছে না। যারা বাইরে যাচ্ছেন তাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে তাপপ্রবাহের তীব্রতার মানচিত্র প্রকাশ করেছে। যেখানে সবচেয়ে বেশি উষ্ণতার বিপদে রয়েছে দেশের ২১ জেলা। এসব জেলাগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও বাগেরহাট।

তাপপ্রবাহে বেশি কষ্টে আছেন শ্রমজীবীরা। ছবি: সংগৃহীত

রেড ক্রিসেন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ কোটিই রয়েছে তাপপ্রবাহের বিপদে। যারা দুঃসহ কষ্টে দিন পার করছেন। বিশেষ করে শ্রমজীবীরা পড়েছে সবচেয়ে বড় বিপদে। যাদের বাইরে না গেলে উপার্জন বন্ধ থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থা কৃষিশ্রমিকদের। তীব্র গরমে ক্ষেতে খামারে কাজ করতে গিয়ে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মফস্বল ও নগরের পেশাজীবীরাও রয়েছেন ঝুঁকিতে।

গত বছরের জুনে যৌথ এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, দেশের পাঁচটি প্রধান শহরের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রচণ্ড গরমের বিপদে রয়েছেন। কানাডার ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়; অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়; চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সেই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, দেশের বড় শহরগুলোতে গরমের কারণে মানুষের ভোগান্তি ও বিপদ সবচেয়ে বেশি।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মহাসচিব কাজী শফিকুল আজম বলছেন, ঢাকাসহ ৩০টি জেলায় তাপপ্রবাহ তীব্র ঝুঁকি তৈরি করছে। জরুরি ভিত্তিতে এসব এলাকার দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষদের জন্য সহায়তা দরকার। খাওয়ার পানি ও গরম থেকে রক্ষা পেতে তাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র করতে হবে। নয়তো ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদের আশঙ্কা বাড়বে।

তাপমাত্রাবিষয়ক গবেষক ও ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি, মালয়েশিয়ার অধ্যাপক শামসুদ্দিন শহিদ বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা বহুমাত্রিক বিপদ তৈরি করছে। নিয়মিতভাবে এ ধরনের অতি উষ্ণ গ্রীষ্মকাল থাকলে এ জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হবে। অধ্যাপক শামসুদ্দিন শহিদ আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার জন্য সরকার যেমন আগাম প্রস্তুতি নেয়, গ্রীষ্মকালের জন্যও রাস্তায় পানির ব্যবস্থা করা, সাধারণ মানুষকে সচেতন করা এবং স্বেচ্ছাসেবক তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

Link copied!