দুপুর আড়াইটা। পূজার সরঞ্জাম বিক্রির দোকানের ভেতরে বসে খদ্দেরের অপেক্ষা করছিলেন সত্যব্রত চৌধুরী তপু (৫৫)। সঙ্গে দোকানের কর্মচারী গোপাল (২৫)। হঠাৎ চারদিক থেকে শোরগোল ভেসে আসতে লাগলো তাদের কানে। কী হয়েছে দেখতে কর্মচারীকে নিয়ে বাইরে এসে দেখেন, কয়েক’শ মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে উন্মাদের মতো তার দোকানের দিকেই আসছে। এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে যায় তার। প্রাণ বাঁচাতে কোনোমতে দোকানের সাটার ফেলে কর্মচারীকে নিয়ে পালিয়ে যান তিনি। আশ্রয় নেন পাশের পরিচিত এক বাড়িতে। এরপর প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা সেখানে বসেই শুনতে পান ভাঙচুরের শব্দ। যখন ফিরে আসেন, তখন দেখতে পান তার দোকানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন সেটি নেভাতে। ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে পুরো দোকান।
গত ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিজের দোকান পোড়ার এমনই বর্ণনা দেন সত্যব্রত চৌধুরী তপু। সেই সহিংসতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার ‘বঁধুয়া সাজ’ নামের পূজার সরঞ্জাম বিক্রির দোকান। সেই সঙ্গে ভেঙে গেছে এতদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন।
তপুর দোকানটি চৌমুহনীর ডিবি রোডের শেষ মাথায় রামচন্দ্র দেবের সমাধিক্ষেত্রের (আশ্রম) প্রধান ফটকের পাশে অবস্থিত। দুর্গা পূজার বিজয়া দশমীর দিন সকাল ১১টায় এই মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে খালি হতে থাকে মন্দির প্রাঙ্গণ। ছিলেন শুধু মন্দিরের সেবক ও কর্মচারীরা। দুপুরে জুমার নামাজের পর চারদিকে শোরগোল শুরু হয়। আশপাশের বিভিন্ন মন্দিরে হামলার খবর আসতে থাকে কর্মচারীদের মুঠোফোনে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তড়িঘড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয় মন্দিরের প্রধান ফটক। এর কিছুক্ষণ পরই হামলাকারীরা হাজির হয় ওই মন্দিরে। মন্দিরের প্রধান ফটক ভাঙতে না পেরে জ্বালিয়ে দেয় পাশে থাকা তপুর পূজার সরঞ্জামের দোকান। এরপর কয়েকজন মই নিয়ে এসে ফটক ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেঙে ফেলে ফটকের তালা। তারপর প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে তাণ্ডব।
তপু বলেন, “আমরা কোনোদিন ভাবিনি চৌমুহনীর মতো এত বড় বাণিজ্যিক শহরে এমন সাম্প্রদায়িক হামলা হবে। ১৯৭১ সালেও সংখ্যালঘুদের ওপর এমন হামলা হয়নি। দিনে-দুপুরে মন্দির ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।”
সেদিনের বিভীষিকার কথা মনে করে তিনি বলেন, “কুমিল্লার পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনার পর থেকে চৌমুহনীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। দুর্গা পূজার নবমীর দিন মণ্ডপগুলোতে ভক্তদের আগমন কম ছিল। দশমীর দিন সকালেও তেমন মানুষজন ছিল না। দুপুরের দিকে হঠাৎ মানুষের চিৎকার ও দৌড়াদৌড়ি দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। কোনোমতে দোকানের সাটার ফেলে আশ্রমের পেছনের একটি দেয়াল টপকে কর্মচারীকে নিয়ে পাশের এক বাসায় আশ্রয় নেই। এরপর শুরু হয় হামলাকারীদের তাণ্ডব।”
এই ব্যবসায়ী আরো বলেন, “আনুমানিক তিন-চার ঘণ্টা ধরে এই হামলা চলে। সবকিছু শান্ত হলে আমি আমার দোকানে ফিরে আসি। দেখি আমার দোকান জ্বলছে। চোখের সামনে পুড়ে যায় আমার এত পরিশ্রম করে গড়ে তোলা দোকান।”
এই ঘটনায় প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে জানিয়েছেন তপু বলেন, “চলতি বছরের পহেলা বৈশাখে আশ্রম গেইটের পাশের দোকানটিতে উঠেছি। এর আগে পাশেই একটি দোকানে প্রায় ৭-৮ বছর ধরে পূজার সরঞ্জাম বিক্রি করেছি। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, পূজা সবকিছুরই সরঞ্জাম পাওয়া যেত আমার দোকানে। সবকিছুই পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করতাম। দোকানে পিতলের দেব-দেবতার মূর্তিই ছিল সাড়ে তিনশ কেজি। লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে দেবীর ২২টি প্রতিমা এনেছিলাম। স্টিল, পিতল ও কাঁসার জিনিসপত্র ছিল। সব পুড়ে শেষ।”
দুর্বৃত্তরা শুধু তার দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে তাই নয়, দোকানের ভেতরে থাকা টাকাপয়সাসহ অনেক কিছু লুট করেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
তপু আরো বলেন, “গত দুই বছর করোনার জন্য ব্যবসায় ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে। ব্যক্তিগত ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। এখন আবার সব শেষ।”
সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তা দাবি করে তিনি বলেন, সরকার যদি আমাদের ক্ষতিপূরণ না দেয় তাহলে স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। আমরা এই দেশে অন্য আর আট-দশজনের মতো থাকার নিরাপত্তা চাই।”
কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন পাওয়ার জেরে গত ১৫ অক্টোবর দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর দিন চৌমুহনীর ১১টি পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় বিভিন্ন মন্দিরে। হামলার হাত থেকে বাদ যায়নি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। সাম্প্রদায়িকতার নামে চালানো সেই তাণ্ডবে সেদিন প্রাণ হারান যতন সাহা (৪২) ও প্রান্ত চন্দ্র দাস (২৬) নামের দুজন। আহত হন পুলিশসহ অনেকে।
তপুর দোকানটি যেই আশ্রমের সামনে অবস্থিত সেই আশ্রমের পরিচালনা কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য রঞ্জিত সাহা বলেন, “প্রায় কয়েক হাজার হামলাকারী আশ্রমের ভেতর অফিস কক্ষ, অতিথিশালা ও রামচন্দ্র দেবের সমাধিক্ষেত্রে ভাঙচুর চালায়। লুটপাট করা হয় ঠাকুরের ছবিতে থাকা স্বর্ণালংকার, প্রণামির বাক্স ও অফিসের নগদ অর্থসহ কয়েক লাখ টাকা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মন্দিরের সামনে থাকা একটি দোকান ও ভেতরে থাকা একটি ঘর। মন্দির প্রাঙ্গণের ভেতরে থাকা দুটি প্রাইভেট কারও পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হামলাকারীদের মারধরে আহত হন কর্মচারীরা।”
রঞ্জিত সাহা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, “আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান মিলে এই দেশটা স্বাধীন করলাম। যাতে সবাই শান্তিতে বসবাস করতে পারে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এখানে হামলা হয়নি। অথচ গত শুক্রবার এখানে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়। সম্প্রীতির দেশে এমন ঘটনায় সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মানে দাগ কেটেছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রত্যেকের মনে। এমনকি ওই দিনের ঘটনার পর থেকে আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখনো খুবই আতঙ্কিত।”