• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
শিল্পের সিন্দুক ৩

আমাদের জাতীয় সংগীতকে ঘিরে যত কথা


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২২, ০৫:৫৩ পিএম
আমাদের জাতীয় সংগীতকে ঘিরে যত কথা

বছর ঘুরে আবার এল আমাদের মহান বিজয়ের মাস।এই মাসটিতে বিভিন্ন আসরে, অনুষ্ঠানে, উৎসবে, উপলক্ষ্যে অজস্র ও অগুনতিবার গাওয়া হবে যে গানটি, সেটি বলাইবাহুল্য আমাদের সবার প্রিয় জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তাই ভাবলাম, এবারের ‘শিল্পের সিন্দুক’ এর বিষয় হিসেবে এই অমর গানটিকে ঘিরে যত কথা- সেটাকেই বেছে নিই না কেন। এর পেছনের চমকপ্রদ ইতিহাস, এর অসাধারণ বাণী,বাউল গানের সুর, বাঙালির জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব, ভূমিকা, অবস্থান, সর্বোপরি একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠার গল্পটি জানতে নিশ্চয়ই তোমাদের খুব ভালো লাগবে, ছোট বন্ধুরা।

 

এই গানটি যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সেটি তো তোমাদের সবারই জানা। কিন্তু তিনি এই গানটি ঠিক কখন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে রচনা করেছিলেন সেটি কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায় না, কেননা এর কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি আজও। তবে বলা হয়ে থাকে, এই গানটি তরুণ রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারিতে থাকাকালীন কুষ্টিয়ার গগন হরকরা নামের এক ডাকপিয়নের মুখে শোনা, ’আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ এই বাউলগানটির সুরে নিজের কথা বসিয়ে লিখেছিলেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা, বিশিষ্ট সঙ্গীতসংগ্রাহক ও সমাজকর্মী সরলা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ থেকে জানা যায়, এই গানটির কথা ও সুর তিনি তাঁর দাদামশায় অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চুঁচুড়ায় থাকাকালীন তাঁর নৌকার মাঝিদের মুখ থেকে শিখে নিয়ে ১৯০০ সালে প্রকাশিত ’শত গানের সংকলন’ বইয়ে উদ্ধৃত করেছিলেন প্রথম। পরে রবিমামা তাঁর মুখে গানটি শুনে সেই সুরে কথা বসিয়েই ‘আমার সোনার বাংলা গান’টি রচনা করেছিলেন।গানটি তাঁর নামে স্বাক্ষরিত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২শে ভাদ্র অর্থাৎ ১৯০৫ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর সঞ্জীবনী পত্রিকায়। একই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি পুনরায় মুদ্রিত হয়েছিল।

 

এর কিছুদিন আগেই মাত্র,১৯০৫ সারের জুলাই মাসে,তৎকালীন ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা এসেছে। তাই ধারণা করা যায়, রবীন্দ্রনাথ এই বাংলাভাগের ঘোষণায় বিষণ্ন ও বিচলিত বোধ করেন এবং এর কাছাকাছি একটা সময়েই বাংলামাতাকে নিয়ে তাঁর এই বিখ্যাত বন্দনাগীতিটি রচনা করেছিলেন।এর ঠিক একমাস আগে ৭ই আগস্ট কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথমবারের মতো গীত হয়েছিল।যদিও বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, গানটি আদতে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে আগস্ট কলকাতার টাউন হলের অপর একটি আসরেই প্রথম গাওয়া হয়েছিল।গানটির প্রথম স্বরলিপি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আরেক প্রিয় ভাইঝি, সঙ্গীতজ্ঞ ও সুলেখিকা শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী।আর গানটিকে প্রথমবারের মতো গ্রামোফোনের জন্য রেকর্ড করেছিলেন শ্রী সুরেন্দ্রবিজয় দে এইচএমভি কোম্পানির হয়ে ১৯২২ সালে। এর ঠিক দশবছর বাদে ১৯৩২ সালে এর দ্বিতীয় রেকর্ড প্রকাশিত হয় কলকাতার কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে, শ্রী গোপালচন্দ্র সেনের কণ্ঠে।

সে যাক, এবারে বরং এই গানটির আমাদের জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠার গল্পটি বলি।তোমরা অনেকেই হয়ত জানো না যে, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি বিশেষ করে ভালোবাসতেন এই ‘আমার সোনার বাংলা গানটি’। জেলে বসে সুযোগ পেলেই গানটি শুনতেন তিনি এবং ১৯৬৯ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিভিন্ন সভা-সমাবেশের শুরুতে কিংবা শেষে এই গানটি গাওয়াতেনও বত্তৃতামঞ্চ থেকে। আর এই কাজে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের শিল্পী ছিলেন প্রয়াত জাহিদুর রহিম। সত্যি বলতে কি, তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও দর্শনের মূলমন্ত্র যে ’সোনার বাংলা’র স্বপ্ন, সেই স্বপ্নটিকে তিনি এই গানের ভাব ও বাণী থেকেই খুঁজে নিয়েছিলেন। সুখ্যাত সংগীত সংগঠন ‘ছায়ানট’ এর শিল্পীরাও তখন নানান অনুষ্ঠানে এই গানটি গাইতে শুরু করেন। ততদিনে ইএমআই রেকর্ড কম্পানিতে কর্মরত বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত ও গণসংগীত শিল্পী কলিম শরাফির উদ্যোগে প্রবীণ সংগীতগুরু আবদুল আহাদ এর একটি গ্রামোফোন রেকর্ডও বার করে ফেলেছিলেন।এর ফলে গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তখন ঘরে, বাইরে সর্বত্রই সেটি শোনা যেত। এমনকি চলচ্চিত্রপরিচালক জহির রায়হানও ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’তে এই গানটিকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেন। সেই থেকেই বঙ্গবন্ধু মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন কোনো একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই গানটিকেই করা হবে তার জাতীয় সংগীত। এই কথা বিভিন্ন জায়গায় তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছেও ব্যক্ত করেছিলেন।

তো, ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। তেসরা মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভাতেই এই গানটিকে জাতীয়সংগীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত হিসেবে এই গানটি গাওয়াও হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় এ গানটির প্রথম দশ লাইনই হবে (যন্ত্রসংগীত ও সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের জন্য প্রথম চারটি লাইন মাত্র) সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত। এখানে জানিয়ে রাখি যে, এই গানটির মোট চরণসংখ্যা আসলে ২৫; পাঁচটি স্তবকে পাঁচ লাইন করে মোট ২৫টি লাইন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে শিল্পী অজিত রায়ের সংগীতপরিচালনায় এটি খুব গাওয়া হত। পরে ১৯৭২ সালে মন্ত্রিপরিষদ সভার নির্দেশনায় বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী আবদুল আহাদ, আফসারী খানম, আতিকুল ইসলাম প্রমুখ কলকাতায় গিয়ে সংগীতগুরু শান্তিদেব ঘোষের কাছ থেকে এই গানের বিশ্বভারতী অনুমোদিত স্বরলিপিটি সংগ্রহ করেন এবং সেই থেকে বাংলাদেশে গানটি সেভাবেই গীত হয়ে আসছে।

 

তোমরা জেনে আনন্দিত হবে যে, আমাদের জাতীয় সংগীতের ভাগ্যে কিন্তু অনেক অর্জন, স্বীকৃতি ও সম্মানও জুটেছে।তার দুয়েকটির কথা উল্লেখ করছি এখানে। ২০০৬ সালে বিবিসি একটি জরিপ পরিচালনা করেচির। তাতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের পছন্দে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। এছাড়া, ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ২০৫টি দেশের জাতীয়সংগীতের তুলনামূলক গুণমানের বিচারে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার ভাষ্যমতে বাংলাদেশের জাতীয়সংগীত দ্বিতীয় হয়। প্রথম হয়েছিল উরুগুয়াইয়ের জাতীয়সংগীত।তোমরা জেনে খুশি হবে যে, আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি একটি বিশ্বরেকর্ডেরও অধিকারী। সেটি ২০১৪ সালের ২৬শে মার্চে জাতীয় প্যারেড মাঠে আনুমানিক তিনলক্ষ মানুষের একসঙ্গে এই গানটি গেয়ে গিনেস বুকে নাম লেখানোর রেকর্ড।

 

আগেই জানিয়েছি আমাদের জাতীয় সংগীতটির মাত্র দশ লাইন গাওয়া হলেও এর মোট পঙক্তিসংখ্যা আসলে পঁচিশ। আমাদের ছোটবেলায় স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে কিংবা অনুষ্ঠানাদিতে আমরা কিন্তু এই পুরো গানটিই গাইতাম। লেখাটি শেষ করার আগে আমি তাই পুরো গানটিই এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না। রবীন্দ্রনাথ কী চমৎকার করেই না তাঁর অপূর্ব কথা ও সুরের রংতুলিতে আমাদের প্রিয় সোনার বাংলার সোনালি ছবিটি এঁকে রেখেছেন এই গানের অপরূপ চিত্রপটজুড়ে।

 

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥

তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥

ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥

ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব‍‍`লে গলার ফাঁসি॥

 

Link copied!