• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২, ১৫ জ্বিলকদ, ১৪৪৪

মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় বঙ্গবন্ধুবন্দনা


তপন বাগচী
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১, ০৯:০২ এএম
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় বঙ্গবন্ধুবন্দনা

কবিতায় তো মানুষ বন্দনাই করে। ঈশ্বরবন্দনাই হোক, প্রকৃতিবন্দনাই হোক আর মানববন্দনাই হোক—বন্দনার জন্য কবিতার চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কী আছে! এই ধর্মগ্রন্থের শ্লোক বা মন্ত্র, কিংবা দেশপ্রেম জাগানোর কথা বলা, কিংবা আদর্শ মানবের গুণ প্রকাশ তো বন্দনাই বটে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) কিংবা শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), নির্মলেন্দু গুণ (১৯৪৫) সবাই বন্দনাকবিতা লিখেছেন। আবার আমরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে বন্দনা করেও লিখেছি কবিতা। তবে বন্দনাকবিতার কথা মনে হলেই অক্ষয়কুমার বড়ালের (১৮৬৬-১৯১৯) নাম সামনে এসে দাঁড়ায়—

‘সেই আদি যুগে যবে অসহায় নর
নেত্র মেলি ভবে
চাহিয়া আকাশ পানে, কারে ডেকেছিল,
দেবে না মানবে?’

মানব-বন্দনা কবি এই একটি কবিতার জন্যই অমর হয়ে আছেন। এরও আগে আমরা জানি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বেশ কিছু বন্দনাকবিতা লিখেছেন। যেমন তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) নিয়ে লিখেছেন, 

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!– উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে (১৮৭০-১৯২৫) নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ / মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’। রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বা বন্দনা করে কবিতার সংখ্যা সহস্রাধিক। তবে এর মধ্যে দীনেশ দাশের (১৯১৩-৮৫) ‘প্রণমি’ কবিতাকেই আমার রবীন্দ্রপ্রশস্তির শ্রেষ্ঠ কবিতা মনে হয়— 

‘আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয় নাম
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা
কোনখানে রাখবো প্রণাম’

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বন্দনাকবিতা লেখা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (১৯২১-১৯৭৫) নিয়ে। বিশেষত তাঁর জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানমালাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার কবিতা-ছড়া-গান রচিত হচ্ছে। জীবিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের প্রচারসংগীত হিসেবে ১৯৫৩ সালে কোটালীপাড়ার চারণকবি শেখ রোকনউদ্দিন তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে নিয়ে লিখেছেন ‘বঙ্গভালে নতুন চাঁদ আজ উদয় হইয়াছে’। সেই ধারায় ভবা পাগলা, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, শাহ আবদুল করিম, বিজয় সরকার, মোসলেহউদ্দিন বয়াতী, দুরবীন শাহ, কামাল পাশাসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গীতিকবিতা রচনা করেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় আধুনিক কবিদের মধ্যে সার্থক মুজিবনামা রচনা করেছেন জসীমউদ্দীন ও নির্মলেন্দু গুণ। কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেন ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু, প্রসঙ্গ সত্তর দশক’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৯৭০-৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন দক্ষিণারঞ্জন বসু, জসীমউদ্‌দীন, সুফিয়া কামাল, অন্নদাশঙ্কর রায়, জগদীশচন্দ্র চক্রবর্তী, নির্মলেন্দু গুণ, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেশ্বর মুখোপাধ্যায়, শান্তিকুমার ঘোষ, বিনোদ বেরা, বনফুল, নিশিকান্ত মজুমদার, নির্মল আচার্য, হাবীবুর রহমান প্রমুখ লেখক।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনেকেই গোপনে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে লেখা ও সেই লেখা পাঠের সাহস দেখিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে রাজনৈতিক আবহ এমনই ভয়াবহ ছিল যে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও হতভম্ব হয়ে যান। সুবিধাবাদী একটি অংশ ঘাতকের সঙ্গে আপস করে ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খেতে ছুটে যান। সেই সময়েও অনেক কবি নীরবে কবিতা লিখেছেন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ সংকলনের কবিরাই তার প্রমাণ। তবে এই সময়ে নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, কামাল চৌধুরী প্রমুখ কবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত লেখা কবিতাগুলো নিয়ে ১৯৮৪ সালে প্রকাশ করেন ‘যিসাস মুজিব’ কবিতাগ্রন্থ। একই বছর নির্মলেন্দু গুণের ‘মুজিব লেনিন ইন্দিরা’ কবিতাগ্রন্থও প্রকাশিত হয়। এই কাব্যে বিশ্বপরিসরে ভ. ই. লেনিন, উপমহাদেশীয় পরিসরে ইন্দিরা গান্ধী এবং জাতীয় পরিসরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমান—এই তিন নেতাকে কেন্দ্রে রেখে লেখা কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে। পক্ষান্তরে মুহম্মদ নূরুল হুদা কেবল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখলেন ‘যিসাস মুজিব’। বঙ্গবন্ধুবন্দনার কাব্য হিসেবে এই গ্রন্থের তাই ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

পঁচাত্তর-পরবর্তী গুমোট আবহাওয়া, বাক্স্বাধীনতা যখন অন্তর্হিত, স্বৈরশাসকের হানা, এ রকম অস্বস্তির মধ্য থেকে মুহম্মদ নূরুল হুদা লেখেন ‘পুলিশ ও প্রজাপতি’। এখানে প্রজা যে রাজার বিপরীত প্রজা, একটু তলিয়ে দেখলে তা বোঝা যায়। ‘এইবার একহাত’ কবিতায় লেখেন ‘বিনয়কে আমি আর আস্ত রাখবো না/ এইবার একহাত দেখবো শালাকে’—এই বিনয়ও নয় ব্যক্তির প্রতীক। এই বিনয়কে আস্ত না রাখার ঘোষণার ভেতর দিয়ে কবি প্রকৃতপক্ষে দুর্বিনীত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। স্বৈরাচার এরশাদকে কটাক্ষ করে তিনি লেখেন—

‘কেউ শোনেনি এমন আকাশ-বাণী
মূর্খ দেশে এলেন কবি-জ্ঞানী
জ্ঞান মানেই রাজন
শুরু হলো চন্দ্ররাজের শাসন’।
(চন্দ্ররাজের শাসন/ যিসাস মুজিব)

সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের কর্তাব্যক্তিকে কটাক্ষ করে এ রকম কবিতা প্রকাশে সাহস কেউ দেখাতে পারেনি। ‘বাক-স্বাধীনতা’ কবিতাটিও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ ধারণ করে আছে। এটি বঙ্গবন্ধু হত্যার অব্যবহিত পরের লেখা কবিতা। ১৯৮০ সালে তিনি লিখতে পেরেছেন—

নেই তো তাহার জিব
যে বলেনি জাতির পিতা
মুজিব, শেখ মুজিব’।
(না-জিব, বাঙালির কথা)

এ রকম সাহসী কথা লেখার সাধ্য খুব কম কবিরই ছিল। এমনকি যারা বঙ্গবন্ধু আদর্শের বিরোধী ভূমিকায় ছিলেন, তারাও এখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিপরীতে গিয়ে যারা রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন, তারাও এখন বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণে তৎপর। কিন্তু সেই ১৯৮০ সালে দাঁড়িয়ে মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন যে যিনি জাতির বলছেন না, তাঁর জিহ্বা নেই, তিনি না-জিব। এই কবিতা তো সেই আবদুল হাকিমের কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ এই কবিতার মতো মুহম্মদ নূরুল হুদার লেখা তিন লাইনের ক্ষুদ্র কবিতাটিও প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছে। আবার এই কবিই লিখতে পারেন ‘বন্ধু-বিষয়ক মহত্তম কবিতা’ নামের দীর্ঘ কবিতা। এতে উঠে এসেছে ষাটের হুদার বন্ধুকবিদের কথা, কথাসাহিত্যিকদের কথা। কিন্তু ১৯৭৩ সালে লেখা কবিতায় তো বঙ্গবন্ধুর কথা উঠে আসবেই। তিনি লিখেছেন—

নতুবা
সাতই মার্চের ইন্দিরামঞ্চে দাঁড়িয়ে
আত্মগত সংগ্রাম শুরু করার পূর্বেই
সমগ্র বাংলাদেশ
আপনার বিরুদ্ধে স্লোগান দেবে—
‘বন্ধুহত্যার বিচার চাই, নইলে এবার রক্ষা নাই’।

এই বন্ধু বঙ্গবন্ধু নয়, কিন্তু সাতই মার্চের ভাষণদাতা বঙ্গবন্ধু এখানে উপস্থিত। ‘যিসাস মুজিব’ নামকবিতায় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বুকে তাঁর খুনির জন্য ক্ষমা দেখতে পেয়েছেন। নিজের পবিত্র রক্তে তিনি সন্তানের পাপ মুছে দিয়েছেন। এই কল্পনার সূত্র ধরে মহান যিশুখ্রিষ্টের ত্যাগের মহিমা স্পষ্ট হয়। এখানে বঙ্গবন্ধু যিশুখ্রিষ্টের মতো মহান হয়ে ওঠেন ত্যাগে ও ভালোবাসায়। প্রতীকী এই কবিতাটিও বঙ্গবন্ধুবন্দনার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর সারিতে স্থান করে নিয়েছে। শেষ দুই চরণ মানুষের মুখে-মুখে ফেরে—
‘ফুরাবে না গঙ্গাধারা, ফুরাবে না বঙ্গভাষী কবিদের নিব
ফুরাবে না এই রক্ত, পিতা, তুমি যিসাস মুজিব’।    

যারা এখন প্রতিদিন একটি করে কবিতা লেখেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তারা তখন কোথায় ছিলেন? কেউ ছিলেন ভয়ে জড়সড়, কেউ কেউ স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে আয়েশেই ছিলেন। আর মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ ও মুহম্মদ নূরুল হুদাকে লিখতে হয় সাহসী কবিতা।

এই মুহম্মদ নূরুল হুদাই ‘স্মৃতিপুত্র’ (১৯৯৯) কবিতাগ্রন্থে লেখেন বেশ কিছু কবিতা, যাতে বঙ্গবন্ধু, জাতিপিতা, জাতিমিতা, জাতিপুত্র অভিধাগুলো যুক্ত হয়ে পড়ে। ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস ‘জাতির পিতা’-কে ‘জাতিপিতা’ লেখাই যায়। কিন্তু মুহম্মদ নূরুল হুদার আগে কেউ কি লিখেছেন। অক্ষরবৃত্তের চারমাত্রার একটি নিটোল শব্দ তৈরি হলো। তেমনি তিনি তৈরি করলেন একই নিয়মে জাতিমাতা, জাতিপুত্র, স্মৃতিপুত্র, জন্মবন্ধু শব্দাবলি। কবি লিখেছেন—

আকাশজোড়া ফোটা সে এক শাপলামানুষ
সাগরজোড়া সাঁতারকাটা উর্মিমানুষ
গিরিচূড়ায় আরোহী এক চূড়ামানুষ
ছুড়ামানুষ বিশ্বমানুষ জন্মপিতা
শাপলাদেশে শাপলাজাতির শাপলামানুষ
সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা
পদ্মাপারে বীরবাঙালির জাতিপিতা।

এই যে স্বতঃস্ফূর্তি, এই যে জাতিপিতার বিকল্প রাষ্ট্রপিতা শব্দের ব্যবহার, কেবল সহজাত কবির পক্ষেই সম্ভবপর। মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ‘বঙ্গভূমির জন্মবন্ধু’ বলেছেন। আবার একেই ঘুরিয়ে বলা যায় ‘জন্মভূমির বঙ্গবন্ধু’। মুজিবমিনার কবিতায় তিনি জনকের তর্জনীকেই ‘মুজিবমিনার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বাংলা নামের বাগানজোড়া হাজারবরণ ফুল
সব বরণ আজ একক বরণ, মুজিবরণ ফুল।

এই বরণ দ্ব্যর্থবোধক—বর্ণ এবং সংবর্ধন অর্থে। মুহম্মদ নূরুল হুদা এ রকম অজস্র দ্ব্যর্থবোধক চরণ রচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ‘গাঙ্গেয় ভূমির পুত্র, পলিসূত্রে জাতিপুত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কবি কেবল বন্দনা কিংবা প্রশস্তি করেই ক্ষান্ত হন না, উদ্দিষ্টকে নানান অভিধা প্রদান করেন, আদর্শের একক নির্মাণ করে পাঠকের বোধে ছড়িয়ে দেন। মুহম্মদ নূরুল হুদা সেই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে কেবল কাব্যরচনার বিষয় নয়, বাঙালির জাতিসত্তা বিনির্মাণের নেতা হিসেবে আদর্শের প্রতীক। তাই জাতিসত্তার স্বরূপ সন্ধানে তিনি যেমন হাজার বছরের ঐতিহ্যের কাছে ছুটে গিয়েছেন, তেমনি অবলম্বন করেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনাও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার জাতিসত্তা সন্ধানেরই অখণ্ড ভ্রমণ।

ড. তপন বাগচী: কবি ও ফোকলোরবিদ। সদস্য, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, ঢাকা।

Link copied!