ইট বৃষ্টিতে হাসানের ঘুম ভেঙে গেল। রাতে সব গুছিয়ে রেখেছে। আজ কোনো ঝামেলা রাখেনি। লম্বা ঘুম দিয়ে বিমানে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে। বাড়ির সামনের বড় রাস্তাটায় মেরামতের জন্য এই ঝুঝকি সকালে ট্রাক থেকে ইট নামাচ্ছে লেবারগুলো। অক্সফোর্ডে আবাসিক এলাকার পরিবেশ এতটাই নীরব থাকে যে বাতাসে পাতার শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। হাসান ওই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছে— চারদিক একেবারে শান্ত না হলে ওর আর ঘুমোতে পারে না। বাড়িতে এসেই সে চার পুরুষের পুরোনো দেয়ালঘড়িটাকে বন্ধ করে দিয়েছে। এক ঘণ্টা পরপর ঢং ঢং শব্দ করে ওঠে ওটা। বোরহান উদ্দিন খোরাসানি সুদূর খোরাসান থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলায় এসেছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের কাছ থেকে জায়গির বন্দোবস্ত পায়। এভাবেই তাদের পূর্বপুরুষ বাংলার উর্বর পলিমাটিতে শিকড় পোঁতেন। ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে তেভাগা আন্দোলনে কৃষকদের রোষে পড়ে তাদের আরেক পূর্বপুরুষ জমিদার খায়রুল আহসান চৌধুরীর মৃত্যু হয়। চৌধুরী উপাধিটা তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে একশ বছরের পুরোনো রাজকীয় বাড়িটা চৌধুরী বংশের প্রতাপ ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। হাসানের বাবা অবশ্য এখন পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। ওই রাজবাড়িটা নিয়ে ওয়ারিশদের মধ্যে মামলা চলছে দীর্ঘ তিন যুগ ধরে।
হাসান বরাবরই মেধাবী ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুল-কলেজের কালচারাল প্রোগ্রামে সবার দৃষ্টি কেড়ে ছিল সে। ছোটবেলা থেকেই তার ফটোগ্রাফির শখ। শিক্ষকেরা বলতেন, হাসান, তুই একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করবি। হাসানের বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল সে ডাক্তার হবে। শৈশবে তারও তেমনটি ইচ্ছে থাকলেও কলেজে এসে অণুজীব নিয়ে পড়াশোনা করার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজে মাইক্রোবাইয়োলজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয় সে। অনার্সে ফলাফল তার ভালো হয়েছে। রেজাল্টের সাথে সাথে কেমব্রিজের একটি ল্যাবে ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজও পেয়ে গেছে। চার বছর পর এবার দেশে এসেছে হাসান। কাজে যোগদানের আগে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের দোয়া নিয়ে যাবে।
ঘুমটা যখন আর এগোল না, হাসান সিদ্ধান্ত নিল—বাংলাদেশে আজকের এই শেষ দিনটা রিকশায় পথে পথে ঘুরে কাটাবে। ছুটির দিন ঢাকার রাস্তাঘাট নিশ্চয় ফাঁকা থাকবে। ইংল্যান্ডে ফিরে আবার সেই তো ব্যস্ত জীবন। টুপ করে নাশতা সেরে হাসান বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। রিকশায় ওঠার পর হাসান লক্ষ করে বোঁটকা একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগছে। রিকশাওয়ালার জবজবে ঘামে ভেজা ময়লা শার্টটা এই দুর্গন্ধের উৎস। নাহ! এই রিকশায় বেশিক্ষণ থাকলে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। কারণ, প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ‘মামা, কোথায় যাব কহিলেন না তো।’
‘তুমি খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে নামিয়ে দিও।’ হাসান সিদ্ধান্ত নিল ওখানে গিয়ে রিকশা চেঞ্জ করবে।
‘আচ্ছা।’
রিকশাওয়ালার কথা শুনে হাসানের মনে হয় ওর বাড়ি উত্তরবঙ্গ। ‘চাচা, তোমার বাড়ি কোথায়।’
‘বাড়ি নাই।’
‘মানে কী?’
‘বাড়ি ছিল, এখুন নাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জে।’
‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের কোথায়?’
‘দিয়াড়ে। আপনি চিনবেন, ঢাকার মানুষ?’
‘আমার দেশের বাড়িও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তো বাড়ি নাই বললে যে?’
‘এখন আর নাই। নদীর ভাঙনে তলিয়ে গেছে ভিটেবাড়ি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রেলওয়ের বস্তিতে থাকে আমার পরিবার। ওখান থেকে তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবো ঠিক নাই।’
তালতলা মার্কেটে এসে রিকশা থামে। ‘আপনি দাঁড়ান আমি আসছি।’ রিকশাটা দাঁড় করিয়ে হাসান ফুটপাতের দোকানগুলোর সামনে যায়। একটা টি-শার্ট কিনে এনে রিকশাওয়ালাকে দেয়। ‘আপনি এটা পরেন। আপনার গায়েরটা খুলে এই পলিথিনে রাখেন।’ রিকশাওয়ালার চোখ দুটো আনন্দে কৃতজ্ঞতায় জ্বলজ্বল করে ওঠে। মুখে ধন্যবাদ না জানালেও চোখে তা ভীষণভাবে স্পষ্ট। অন্যকে আনন্দ দেওয়ার মাঝে এত যে আনন্দ আছে, হাসান আগে সেভাবে উপলব্ধি করেনি। ‘ঠিক আছে মামা, চলেন আপনার রিকশাতে আজ ঢাকা শহর ঘুরব।’
তারা যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস পার হচ্ছিল হাসান রিকশা দাঁড় করিয়ে একটা ছবি তোলে। ‘মামা জানেন এটা কী?’
—জানি কাকা, এটা একটা বড় থানা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস।
—হ্যাঁ এটা পুলিশ লাইনস। এটা থানা নয়। ২৫ মার্চ কালরাতে এখানে ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়েছিল।
—ও। হাসান বুঝতে পারে রিকশাওয়ালা তার কথা কিছুই বোঝেনি।
—একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা বলতে পারেন এখান থেকেই।
—বাপের কাছে শুনেছি আমার বড় চাচাসহ গ্রামের দশ-বারোজন ছেলে যুদ্ধে গেছিল তাই রাজাকাররা হামাদের গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছিল।
—আপনার কোনো স্মৃতি নাই মুক্তিযুদ্ধের?
—হামার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে।
—বলেন কী! দেখে তো মনে হয় আপনার অনেক বয়স।
—রিকশা চালালে বয়স বেড়ে যায়—রিকশার প্যাডেলে বয়স চুষে লেয়।
—তাহলে আপনার বয়স কত?
—সেটা তো জানি ন্যা।
—আপনাদের সেই গ্রাম এখন আর নাই না?
—ঠিক ধরেছেন কাকা। গ্রামটা নদীতে ভেসে গেছে।
—নতুন নতুন চর জাগে না?
—চর জাগে কিন্তু মেম্বার-মাতব্বররা লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে দখল করে হামাদের ঘর তুলতে দেয় না।
—আহা!
—এবার কোথায় যাব কাকা?
—পুরান ঢাকায় চলেন? কবে আবার দেশে ফিরব জানি না। ঢাকা শহরটা স্মৃতিতে গেঁথে নেয় ফ্রেমে। মাঝে মাঝে রিকশা থামিয়ে কিছু ছবি তুলে নেয় হাসান।
—আপনি কোথায় যাবেন?
—ইংল্যান্ডে। ওখানেই আমি পড়াশোনা করেছি। এবার গিয়ে চাকরিতে যোগ দেব। ইংল্যান্ড চেনেন?
রিকশাওয়ালা কোনো উত্তর দেয় না। হাসান বলে, ব্রিটিশদের দেশ। যারা দুই শ বছর আমাদের শাসন করেছিল সেই ব্রিটিশদের দেশ।
লক্ষ্মীবাজারে বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে হাসান রিকশা থামাতে বলে। হাসান বলে, এখানে একটু দাঁড়ান কিছু ছবি নেব।
—এটা কী কাকা?
—এটা হচ্ছে বাহাদুর শাহ পার্ক। আগে এটির নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। সিপাহি বিদ্রোহের পরে এখানে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
—আপনি বিদেশে পড়ালেখা করেছেন, কিন্তু দেশ সম্পর্কে অনেক জানেন।
হাসান উত্তরে কিছু বলে না। পুরান ঢাকার সরু রাস্তা দিয়ে রিকশা চলতে থাকে। নবাবপুর, নবরায় লেন, আওলাদ হোসেন লেন, অভয় দাস লেন, চকবাজার দিয়ে রিকশা চরকির মতো ঘুরতে থাকে। হাসান মাঝে মাঝে রিক্শা থামায়, ছবি তোলে। রিকশাওয়ালাকে সাথে নিয়ে চায়ে ডুবিয়ে বাখরখানি খায়। হাসান জিজ্ঞেস করে, চাচা আপনার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। আপনার নাম কী?
—মিজানুর।
মিজানুরের খেজুরের মতো তামাটে মুখের দিকে তাকিয়ে হাসান চায়ে চুমুক দেয়। মিজানুরের মুখে লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের মানুষগুলোর ইতিহাস খুঁজতে থাকে সে। রিকশাওয়ালাটি কি নিগ্রিয়েট, মঙ্গোলিয়েট, দ্রাবিড়? এই শঙ্কর বাঙালির পরিচয় বড় গোলমেলে। আর তাই আত্মপরিচয়ের দ্বিধা আজও কাটল না। মিজানুরের মুখজুড়ে যেন শুকনো নদীর মানচিত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ‘মিজান চাচা, আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।’
মিজানুর তার লজ্জামাখা হাসিটা মলিন গামছা দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। হাসানের কথার উত্তরে কিছু একটা বলা দরকার তাই সে বলে, ‘এখানে আর কতটা ঘুরবেন?’
—উম, ভালো কথা। আমরা হোসেনি দালানে যাব। সেখান থেকে নাজিরা বাজার যাব। হাজির বিরিয়ানি খাব দুজনে তারপর বিউটি লাচ্ছি খাব এরপর ধানমন্ডি বত্রিশে। সব শেষে বাসা ফিরব।
—ঠিক আছে কাকা চলেন।
হাসান হোসেনি দালানে ঢুকে মিজানুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। হাসান ঐতিহাসিক ইমারতটির দিকে তাকিয়ে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের বিশ্বাসের রাজনীতিগুলোর সমীকরণ মেলাতে চেষ্টা করে। ২০১৫ সালে এখানে বোমা হামলা করা হয়েছিল—আশুরার তাজিয়া মিছিলে। তারপর বোমার আঘাতে কি সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়েছে? পড়েনি। কিন্তু সে বারুদের গন্ধ মানুষের হৃদয়ে শিকড় গেড়েছে। হাসান কয়েকটি ছবি তুলে নেয়। সেখান থেকে বেরিয়ে হাসান রিকশায় উঠে ঘড়ি দেখে। সময়ের মাস্তুল দুপুর ছাড়িয়ে বিকেলের পথে এগিয়ে চলেছে। পড়াবিকেলে তারা দুপুরের খাবার খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলের সমাধি পেরিয়ে গণজাগরণের শূন্যমঞ্চকে পেছনে ফেলে রিকশা এগোতে থাকে ধানমন্ডির দিকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে প্রবেশ করে হাসানের বুকটা হু হু করে ওঠে। বাড়িটির সিঁড়িঘেঁষা দেয়ালে রক্তের ছোপ ছোপ রক্তগুলো জঘন্য ইতিহাসের বর্ণনা দিচ্ছে। যে ব্যক্তিটি বাঙারি জাতির মুক্তির জন্য জীবনের চার হাজার ছয় শ বিরাশিটা দিন হাসি মুখে জেলে কাটিয়েছেন। এটি ছিল তাঁর মোট জীবনের এক-চতুর্থাংশ। হাজার বছরের শোষণ নির্যাতন থেকে জাতিকে মুক্ত করেছিল। সেই মানুষটিকে বাঙালি সপরিবার নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। কী নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতক বাঙালি। বঙ্গবন্ধু কখনো ভাবতে পারেননি তাঁকে তাঁর দেশের মানুষ হত্যা করতে পারে। তা না হলে এমন নিরাপত্তাবেষ্টনীমুক্ত একটা সাধারণ বাড়িতে তেমন কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধান ছাড়া পরিবার নিয়ে থাকতে পারেন? হায় রে অভাগা বাঙালি! এখনো এ দেশের একশ্রেণির মানুষ ঘুষ-দুর্নীতি-ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের আখের গোছাচ্ছে। বিদেশে টাকা পাচার করছে। তারা একটি উচ্ছৃঙ্খল, বিলাসী, ভ্রষ্ট প্রজন্ম নির্মাণ করে তাদের জন্য টাকার পাহাড় রেখে যাচ্ছে। মানুষ এমনি এক জাতি যারা ইতিহাস থেকে কখনো শিক্ষা নেয় না। বঙ্গবন্ধুর মুর্যালের নিচে লেখা একটি উক্তি পড়ে হাসানের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, ‘মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।’
বনশ্রীতে ক্লান্ত রিকশাটা যখন থামে সূর্যটা ঘুমাবে বলে আয়োজন শুরু করেছে। হাসান ৫০০ টাকার একটা নোট বের করে রিকশাওয়ালা মিজানুরের হাতে দেয়। মামা এটা রাখেন। ‘খুব ভালো লাগল। ঢাকার শেষ দিনটা একজন সত্যিকারের মাটির মানুষের সাথে কাটালাম। আবার কবে আসব জানি না। দোয়া রাখবেন।’
‘যান, কাকা দোয়া করি অনেক বড় হন। আমরা তো যেতে পারব না। আমাদের এখানেই থাকতে হবে।’
রিকশাওয়ালা মিজানুরের শেষ কথাটি হাসানের কর্ণ দিয়ে হৃদয়ে গিয়ে বিঁধে, ‘আমাদের এখানেই থাকতে হবে।’