২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবার প্রদর্শিত হয়েছে জাপানি তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক মিকা সাসাকির একটি প্রামাণ্যচিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্রের নাম “টেগর সংস”। রবিঠাকুরের গানের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই তাঁর এ সৃষ্টিকর্ম। বাংলার রূপবৈচিত্র্য ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মেলবন্ধন আছে এখানে। এরই মধ্যে দর্শকহৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে মিকা সাসাকির “টেগর সংস”। প্রামাণ্যচিত্রটির কিছু অংশের শুটিংও হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ও তাঁর প্রামাণ্যচিত্র সম্পর্কে কথা বলেন সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাহনিয়া ইয়াসমিন।
সংবাদ প্রকাশ : বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার শুরুর কথা জানতে চাই।
মিকা সাসাকি : শিক্ষাজীবন থেকেই। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। বাংলা পড়তে গিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জেনেছি এবং আশ্চর্য হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমি শুধু কবি মনে করতাম, কিন্তু তাঁর ওপর পড়াশোনা করে জানতে পারি, তিনি কেবল কবি নন। তিনি অসাধারণ গানও লেখেন। তখন থেকেই আমি তাঁর সংগীতের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করি। তাঁর সম্পর্কে জানতে জানতে এবং সেগুলো দেখতে দেখতে তাঁর প্রতি আমার একটা আগ্রহ তৈরি হয়।
সংবাদ প্রকাশ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘টেগর সংস’ তৈরির ভাবনা কীভাবে এলো?
মিকা সাসাকি : যখন রবীন্দ্রচর্চা করছি, তখন থেকেই তাঁর প্রতি আমার একটা আগ্রহ তৈরি হয়। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করি। এ জন্য প্রথমে রবীন্দ্রসংগীতকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে তার মূল অর্থ বোঝার চেষ্টা করি। তারপরও আমি সঠিক অর্থ বুঝতে পারছিলাম না। তখন চিন্তা করলাম, আমি তো চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাহলে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কেন কাজ করছি না? এই ভাবনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে রবীন্দ্রপ্রেমী, গায়ক, শিক্ষক সবার সঙ্গে কথা বললাম। এভাবে সবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা বলতে বলতে তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র করার ভাবনা আসে।
সংবাদ প্রকাশ : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনার প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের এ রূপবৈচিত্র্য আপনার চোখে ধরা পড়ল কীভাবে?
মিকা সাসাকি : গীতাঞ্জলি আমরা জাপানি ভাষায় পড়তে পারি। কিন্তু জাপানি ভাষায় পড়ে তার পুরোটা আমি অনুধাবন করতে পারতাম না। তখন আমার শিক্ষকের সহযোগিতায় সেটার অনুবাদ করে আমি প্রথম জানতে পারি গীতাঞ্জলির গভীরতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি কাব্যে যে গ্রামবাংলার বর্ণনা আছে, তা আমাকে আকৃষ্ট করে। আমার জানতে ইচ্ছে করে রবিঠাকুর কোথায় বসে এসব গান রচনা করেছেন। তারই সূত্র ধরে গানকে আরও বেশি করে অনুভব করতে আমি বাংলাদেশে নানা জায়গায় গিয়েছি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়োজনে। ঢাকার বাইরে খুলনা গিয়ে গ্রামের দৃশ্য দেখেছি, কী অসাধারণ সে দৃশ্য! সেখানে ধানক্ষেত, নদী, নৌকা আছে। সেখানে অনেক ভালো লেগেছে। চলচ্চিত্র তৈরির কাজে গ্রামবাংলার এ দৃশ্য তুলে ধরেছি। আর বুঝতে পেরেছি রবীন্দ্রনাথ কীভাবে আর কোথায় বসে তাঁর কবিতা বা সাহিত্য রচনা করেছেন। গ্রামের সৌন্দর্য দেখাটা আমার কাছে আনন্দের একটা অভিজ্ঞতা ছিল।
সংবাদ প্রকাশ : রবীন্দ্রনাথের গান কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করে বলে আপনি মনে করেন?
মিকা সাসাকি : রবীন্দ্রনাথের গানের যে সুর, তা তো আমাকে মুগ্ধ করেই। তা ছাড়া তাঁর রচিত গানের মধ্য দিয়ে একটা দৃশ্য কল্পনা করা যায়। আমি আগেই বলেছি, গ্রামবাংলার কথা। আমি তাঁর গানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চিনেছি।
সংবাদ প্রকাশ : এই প্রামাণ্যচিত্র করতে গিয়ে আপনার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথিতযশা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সঙ্গে আলাপ হয়। তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
মিকা সাসাকি : ইউকা উকুদা নামে আমাদের একজন অধ্যাপক আছেন। তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীতে মাস্টার্স করেছেন। ওনার কাছ থেকে আমি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার খোঁজ পাই। তারপর আমি বাংলাদেশে ওনার স্কুল “সুরের ধারা”, সেখানে গিয়ে ক্লাসগুলো দেখার সুযোগ পাই। তা ছাড়া আমি তার টিভি শোগুলো দেখে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি। উনি অনেক জনপ্রিয় একজন শিল্পী। আর আমি কেবল একজন শিক্ষার্থী, যে চলচ্চিত্র তৈরির কাজ করছি। কিন্তু উনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আমাকে অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছেন। সে জন্য তাকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই।
সংবাদ প্রকাশ : আপনার জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
মিকা সাসাকি : আমি ফুকুই নামে এক গ্রামের মেয়ে। আমার গ্রামেও নদী-ধানক্ষেত আছে। আমার মনে হয়, আমার গ্রাম অনেক সুন্দর একটি জায়গা। আসলে আমি তো অবাক হয়েছিলাম, যখন খুলনা গিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম দেখেছি। আসলে দুই দেশের গ্রামের মধ্যে অনেক মিল আছে দেখে অনেক খুশি হয়েছি। আমাদের দুই দেশের ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্যের মধ্যে ভিন্নতা আছে, কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের দুই দেশের গ্রামের মধ্যে একটা বড় মিল আছে। আমি দুই দেশের প্রকৃতির মধ্যে সেই মিল খুঁজে পেয়েছি।
সংবাদ প্রকাশ : ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসে আপনার কেমন লাগছে?
মিকা সাসাকি : বাংলাদেশ আমার বেশ ভালো লাগে। চলচ্চিত্র উৎসব আমি খুবই উপভোগ করছি। এখানে নানা দেশের মানুষ তাঁদের চলচ্চিত্র নিয়ে এসেছেন। আমি একই সঙ্গে অনেক দেশের মানুষ ও তাদের কালচার সম্পর্কে জানতে পারছি। আমি জাপানে থাকি। জাপান থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দূরত্ব আছে। আমি মনে করি, এশিয়ার মধ্যে ঢাকা একটা মিডল প্লেস। তা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এরই মধ্যে আমার পছন্দের খাবার খেয়েছি, মিষ্টি দই ও শিঙাড়া।