• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

এক যে ছিলেন হুমায়ুন আজাদ


হাসান শাওন
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৩, ১১:০০ এএম
এক যে ছিলেন হুমায়ুন আজাদ

তার ছাত্রদের ছাত্র আমরা। মানে হুমায়ুন আজাদ যাদের পড়িয়েছেন, তারা ছিলেন আমাদের শিক্ষক। সে শিক্ষকরা জোর দিতেন ব্যাকরণে। উৎসাহ দিতেন ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠে। আমাদের ভালো লাগা গুরুত্ব দিতেন না। অনেক জনপ্রিয় সাহিত্য ও সাহিত্যিককে এক কথায় বলে দিতেন এগুলো ‘অখাদ্য’। আমাদের তখন যা ইচ্ছা তাই এর বয়স। ‘খাদ্য’ আর ‘অখাদ্য’ এর তফাৎ তো বুঝি না। যা সামনে পাই তাই গিলে যাই। এই গিলতে গিলতেই হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়। সম্ভবত ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ প্রথম হাতে আসে। স্কুলবেলা তখন শেষ হয় হয়। চোখের সামনে দ্রুত মিরপুর পাল্টাচ্ছে। নতুন শতাব্দী ভূমিষ্ঠ হচ্ছে যেন অপরূপ বিল, ঝিল, খাল, পুকুর, নদ তুরাগ দখল আর ভরাটের তীব্র আর্তনাদে। রাস্তায় নামলেই বালু ভর্তি ট্রাক। সারা রাস্তায় ধুলা আর ধুলা। মহল্লার একটার পর একটা মাঠে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে। নৌকায় ঘুরতে যেতাম চাকুলি গ্রাম হয়ে। তাও নিশ্চিহ্ন। মিরপুর ১২ নম্বরের শেষ মাথায় এক কালীমন্দির বেষ্টিত গ্রাম ছিল যা। সেখানে রাতারাতি নয়, সত্য বলা হবে এক সেমিস্টার পর গিয়ে দেখি গজিয়ে উঠেছে নতুন শহর ‘মিরপুর ডিওএইচএস’। শহরের প্রতি ধিক্কার জন্মানো সে প্রহরে নিঝুম রাড়িখালের গ্রামকে পাই হুমায়ুন আজাদ স্যারের অক্ষরে।  

এসএসসির পর অনেকগুলো ঘটনা দ্রুত জীবনে ঘটে যায়। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হই। বাম ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। সিনেমা দেখার নেশা বাড়ে। যাতায়াত বেশি হতে থাকে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। চাক্ষুস হুমায়ুন আজাদকে দেখি তখন। মধুর ক্যান্টিনে দেখতাম। কলা ভবনের টিচার্স রুমে দেখতাম। একবার সংগঠনের পত্রিকাও বিক্রি করি তার কাছে। চুপচাপ জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দাম দিলেন। কথা বলেন না কোনো।  

হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি। সবচেয়ে ভালো লাগে তার কবিতা আর শিশু সাহিত্য। আর কোনো দ্বিধা ছাড়াই প্রয়াত এই মানুষটিকে নিয়ে বলতে পারি, সবচেয়ে খারাপ লাগে ওনার ধর্ম বিদ্বেষ। ‘আমার অবিশ্বাস’ এর নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাস বিরোধিতা ও বিদ্বেষ প্রচার। কারণ, সমাজ বদলের কর্মী হলে জনতার স্রোতে মিলেমিশে থাকতে হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে তাচ্ছিল্য করে তা সম্ভব না। নতুন ব্যবস্থা আকাশ থেকে পড়ে না। বিদ্যমান কাঠামোতে যা কিছু পরিবর্তনের জন্য সহায়ক তাকে কাজে লাগানোই রূপান্তরকামীর কাজ।

কিন্তু তবু হুমায়ুন আজাদকে ভালো লাগত। মজা লাগত। এমন ভাষা বিজ্ঞানীকে সমসময়ে পাওয়া সৌভাগ্য। নিজের বিশ্বাস তিনি অসংকোচে লিখে প্রকাশ করেছেন। তা কারো পছন্দ না হলে বা দ্বিমত থাকলে তিনিও লিখে তা প্রকাশ করবেন। কিন্তু এর জন্য তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুনের চেষ্টা করতে হবে? ২০০৪ সালের কলঙ্কতম এ ঘটনায় আমরা ছাত্র সংগঠনের হয়ে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করি। মনে আছে, রাত থেকেই মিছিল আর স্লোগানে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।    

সেই হামলার পর হুমায়ুন আজাদ বেঁচে ছিলেন মাত্র ছয় মাস। জার্মানি থেকে তার মৃত্যু বার্তা আসার পর বাংলা সাহিত্যের সব কিছু না হলেও অনেকটুকুই যেন ভেঙে পড়ে। আমরাও অশ্রু রোধ করতে পারিনি তার মরদেহ আসার দিনে। টিভিতে দেখেছি ওনার স্ত্রী আর সন্তানরা বারবার বলছিলেন, আপনারা তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন।

১৯৪৭ সালের আজকের দিন ২৮ এপ্রিল আমাদের সময়ের নানা কারণে আলোচিত এই ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন আজাদ জন্মেছিলেন বিক্রমপুরে। বাংলা সাহিত্যের আকাশে লাল নীল দীপাবলি হয়ে যিনি ভাস্বর। তার সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিকতা প্রকাশ পেয়েছে কবিতা, উপন্যাস, ভাষাবিজ্ঞান, সমালোচনা সাহিত্য, রাজনীতিক ভাষ্য, কিশোর সাহিত্য, গবেষণা এবং অধ্যাপনায়। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষা বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।

হুমায়ুন আজাদ এখন ঘুমিয়ে আছেন তার রাড়িখালে। তার গ্রামের জমিনে। যে গ্রামের রাতের চাঁদ তার কাছে মনে হতো প্রিয় সাদা বেলুনের মতো। মাছরাঙা নিয়ে তিনি লিখেছেন, পুকুরের আকাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করে ঝাপিয়ে পড়ে মাছরাঙা। তার লাল তলোয়ারের মতো ঠোঁট ঢুকে যায় পাবদার লাল হৃদপিণ্ডে। কচুরিফুল তার কাছে, পুকুরের ঝাড়বাতি। লাউয়ের ডগা নিয়ে লিখেছেন, সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের কিন্তু লাউয়ের ডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের। সরপুঁটি মাছকে তার মনে হয়েছে, পানির নিচের আলো।

এই হুমায়ুন আজাদহীন সময়ে সব গেছে নষ্টদের অধিকারে। তার ঘাতক চক্র বা সমমনাদের দর্শনের সঙ্গে আঁতাত করেছে দেশের ৫০ বছরে গদিতে থাকা প্রতিটি রাজনৈতিক দল। অদেখা ভূবনে হুমায়ুন আজাদ কেমন আছেন? তা জানার উপায় নেই। কিন্তু তার কবিতা খুব ভাবাচ্ছে এখনের অশনিকালে।

আগাছা ছাড়াই, আল বাঁধি, জমি চষি, মই দিই,
বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর
দিন চোখ ফেলে রাখি শুকনো আকাশের দিকে। ঘাম ঢালি
খেত ভ’রে, আসলে রক্ত ঢেলে দিই
নোনা পানিরূপে; অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হলে
খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন।
খরা, বৃষ্টি, ঝড়, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে
প্রকৃতির কৃপা হ’লে এক সময়
মুখ দেখতে পাই থোকা থোকা সোনালি শস্যের।
এতো ঘামে, নিজেকে ধানের মতোই
সিদ্ধ করে, ফলাই সামান্য, যেনো একমুঠো, গরিব শস্য।
মূর্খ মানুষ, দূরে আছি, জানতে ইচ্ছে করে
দিনরাত লেফ-রাইট লেফ-রাইট করলে ক-মণ শস্য ফলে
এক গণ্ডা জমিতে?”

(তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষীর প্রশ্ন, হুমায়ুন আজাদ)

Link copied!